পাহাড়ে নতুন আবির্ভাব হওয়া সশস্ত্র সংগঠন কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (কেএনএফ) প্রধান নাথান লনচেও বম। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে এখন পর্যন্ত এটি রহস্যময় নাম।
যদিও এরই মধ্যে কেএনএফ দাবি করেছে, পার্বত্য চট্টগ্রামের কয়েকটি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করছে কেএনএফ। কুকি-চিন রাজ্য নামে স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল চেয়ে তারা বলেছে, ওই রাজ্যে বম, খিয়াং, পাংখুয়া, লুসাই, খুমি ও ম্রোরা থাকবে। সেখানে চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরারা থাকবে না।
পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক কমিটি সূত্রে জানা গেছে, মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার (এমএন লারমা) গঠিত জনসংহতি সমিতি ভেঙে কয়েকটি গ্রুপের সৃষ্টি হয়েছিল। কেএনএফ সেগুলোর মধ্য থেকে আসা একটি গ্রুপ। ইতোমধ্যে সশস্ত্র সংগঠন হিসেবে নিজেদের অবস্থান জানান দিয়েছে। উগ্রবাদীদের সঙ্গে সম্পৃক্ততা থাকায় বিচ্ছিন্নতাবাদী এই সংগঠনের সদস্যদের ধরতে পাহাড়ে চিরুনি অভিযান চালাচ্ছে যৌথবাহিনী। এ অবস্থায় পিছু হটেছে এই সংগঠনের সদস্য ও নেতারা। এরই মধ্যে তিন সদস্যকে আটক করা হয়েছে।
পাহাড়ে নতুন আবির্ভাব হওয়া সশস্ত্র সংগঠন কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) সংগঠনের সদস্যদের ধরতে পাহাড়ে চিরুনি অভিযান চালাচ্ছে যৌথবাহিনী। এ অবস্থায় পিছু হটেছে সশস্ত্র এই সংগঠনের সদস্য ও নেতারা।
যৌথবাহিনী জানিয়েছে, অভিযান শুরুর পর বান্দরবান ও রাঙামাটির সীমান্তবর্তী দুর্গম পাহাড়ি এলাকাগুলো থেকে নতুন জঙ্গি সংগঠন জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার সাত সদস্য ও কেএনএফের তিন সদস্যকে আটক করা হয়েছে। তাদের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধার করা হয়েছে।
আঞ্চলিক সংগঠনগুলোর নেতারা বলছেন, পাহাড়ে এর আগে পাঁচটি আঞ্চলিক সংগঠন রয়েছে। সেগুলো হলো—সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি, প্রসীত বিকাশ খীসার নেতৃত্বাধীন ইউনাইটেড ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ), ২০১০ সালে সন্তু লারমার নেতৃত্বকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে নানা অভিযোগে সুধাসিন্ধু খীসা ও তাতিন্দ্র লাল চাকমার নেতৃত্বে আবির্ভাব হয় পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (এমএন লারমা), ২০১৭ সালের নভেম্বরে খাগড়াছড়ি জেলায় সংবাদ সম্মেলন করে ইউনাইটেড ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) ভেঙে ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ-গণতান্ত্রিক) নামের সংগঠনের জন্ম হয় এবং মগ লিবারেশন পার্টি।
জানা গেছে, পার্বত্য অঞ্চলের দলছুট কিছু তরুণকে নিয়ে গঠিত হয় মগ লিবারেশন পার্টি। যার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে মিয়ানমারের বিচ্ছিন্নতাবাদী কিছু গ্রুপ ও পার্বত্য চট্টগ্রামের বিচ্ছিন্নতাবাদী কিছু গ্রুপ। মগ লিবারেশন পার্টির কথিত সামরিক শাখা মগ লিবারেশন আর্মি। তবে কে এই সংগঠনের নেতৃত্ব দিচ্ছেন সে বিষয়ে বিস্তারিত জানা যায়নি। এ নিয়ে এখন পাহাড়ে পাঁচটি আঞ্চলিক সংগঠনের তৎপরতা রয়েছে।
এরই মধ্যে নতুন করে কেএনএফ নামে নতুন সংগঠনের নাম সামনে এসেছে। গত ২৪ মে সশস্ত্র এই সংগঠনের আত্মপ্রকাশ ঘটে। সেইসঙ্গে সাংগঠনিক প্রধান হিসেবে নাথান বমের নাম ঘোষণা করা হয়। বান্দরবানের বম জাতিগোষ্ঠীর কয়েকজন ব্যক্তি এটি গড়ে তুলেছেন বলে জানা গেছে।
কে এই নাথাম বম?
পুরো নাম নাথান লনচেও বম। এখন পর্যন্ত রহস্যময় নাম। কেএনএফের দাবি, নাথান লনচেও বম-ই কেএনএফের প্রধান। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৩০০ নম্বর আসন বান্দরবান থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মনোয়নপত্র সংগ্রহ করেছিলেন নাথান বম।
স্থানীয় সূত্রগুলো বলছে, নাথান বম রুমা উপজেলার হেডের পাড়ার বাসিন্দা। বয়স আনুমানিক ৪২ বছর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ভাস্কর্য বিভাগে পড়াশোনা করেছেন। সেখান থেকে সম্পন্ন করেছেন স্নাতকোত্তর। নাথান এক সন্তানের জনক। তার স্ত্রী স্থানীয় এক স্কুলের শিক্ষক। পাশাপাশি পরিবার পরিকল্পনা কর্মী হিসেবে কাজ করেন।
পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, নাথান ছাত্রজীবন থেকে বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। প্রথমে যুক্ত ছিলেন সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন জনসংহতি সমিতির সমর্থিত পাহাড়ি ছাত্র পরিষদে। তবে ভাস্কর্য বিভাগের ছাত্র হিসেবে শিখেছিলেন ভাস্কর্য নির্মাণের কাজ। পার্বত্য শান্তিচুক্তির পর খাগড়াছড়ি শহরের মহাজন পাড়া এলাকায় লারমা স্কয়ারে এমএন লারমার একটি ভাস্কর্য নির্মাণ করেন। ভাস্কর্যটি উদ্বোধন করা হয় ২০০০ সালে। এরপর শিল্পী হিসেবে খ্যাতি বাড়ে। সে সময় হিল আর্টিস্ট গ্রুপেও যুক্ত ছিলেন। পাশাপাশি বম বিষয়ে লেখালেখি করেছেন। কুকি-চিনভুক্ত জাতিগোষ্ঠীর পরিচিতি নিয়ে ‘দ্য বমজৌ’ নামে একটি বই প্রকাশ করেন। এছাড়া গবেষণামূলক আরও পাঁচটি বই প্রকাশিত হয়। এই কারণে নাথান লেখক হিসেবেও পরিচিত। তবে বর্তমানে তার অবস্থান কোথায় তা জানা যায়নি।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তথ্যমতে, নাথানের অবস্থান নিশ্চিত করতে কাজ করছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। ২০০৮ সালে অনগ্রসর ও সুবিধাবঞ্চিত কুকি-চিন জনগোষ্ঠীর শিক্ষিত ব্যক্তিদের নিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন কুকি-চিন জাতীয় ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (কেএনডিও)। সংগঠনের উদ্দেশ্য ছিল পার্বত্য চট্টগ্রামের অনগ্রসর ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য রক্ষা করা। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তার রূপ বদলাতে থাকে। ২০১৭ সালের পর থেকে নতুন রূপ ধারণ করেন নাথান। তারই ধারাবাহিকতায় প্রতিষ্ঠা করেন কেএনএফ।
বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, প্রথমে কুকি-চিন ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (কেএনডিও) নামে সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন নাথান। ২০১৬ সালে সশস্ত্র একটি গ্রুপ তৈরি করেন। পরে কেএনডিওর বদলে কুকি-চিন ন্যাশনাল ভলান্টিয়ার্স (কেএনভি) নাম দিয়ে কার্যক্রম চালান। ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে চান। মনোনয়নপত্র বাতিল হওয়ায় নির্বাচনে অংশ নিতে পারেননি। এরপর ভারতের মণিপুর ও বার্মার চীন রাজ্যের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলেন। কেএনভির প্রথম ব্যাচে সংগঠনের শতাধিক সদস্যকে মণিপুরে প্রশিক্ষণে পাঠান। এরপর ১০০ সদস্যকে মণিপুর, বার্মার কারেন ও কাচিন রাজ্যে গেরিলা প্রশিক্ষণের জন্য পাঠানো হয়। ২০২০ সালে কেএনভির নাম বদলে কেএনএফ হয়। তাদের সশস্ত্র উইংয়ের নাম দেওয়া হয় কুকি-চিন ন্যাশনাল আর্মি (কেএনএ)।
কেএনএফ সংগঠনের নামে ফেসবুক পেজ খুলে কার্যক্রম চালাচ্ছে তারা। ফেসবুক পেজে সংগঠনের প্রধান হিসেবে নাথান বমের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। সর্বশেষ গত বুধবার (১৯ অক্টোবর) বিকালে দুর্গম পাহাড়ের অজ্ঞাত স্থান থেকে দুই মিনিট ৫১ সেকেন্ডের এ ভিডিও বার্তা ফেসবুক পেজে দেওয়া হয়। ভিডিওতে দেখা যায়, পেছনে দুজন সশস্ত্র সদস্যকে পাহারায় রেখে কালো মুখোশ পরে সংগঠনের নিজস্ব পোশাক পরিহিত অবস্থায় বক্তব্য দিচ্ছেন এক নেতা। তবে তিনি সংগঠনের কোন পদে রয়েছেন কিংবা তার নাম কি তা জানাননি।
এর আগে চলতি বছরের মে মাসে সংগঠনের প্রধানের নাম ঘোষণা করে সশস্ত্র হামলার জানান দেয় কেএনএফ। তখন থেকে ফেসবুকে নিয়মিত তাদের সশস্ত্র প্রশিক্ষণের নানা ছবি ও ভিডিও দিয়ে অস্তিত্বের জানান দিচ্ছে। তবে চট্টগ্রামে জেএসএস ও ইউপিডিএফফের মতো কয়েকটি বিচ্ছিন্নতাবাদী সশস্ত্রগোষ্ঠী থাকলেও কেএনএফের মতো এভাবে ঘোষণা দিতে দেখা যায়নি।
কেএনএফ সূত্রে জানা গেছে, কেএনএফ নিজেদের দাবি আদায়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে পার্বত্য চট্টগ্রামের কুকি-চিন রাজ্যে হস্তক্ষেপ ও অনুপ্রবেশের আহ্বান জানিয়েছে। বাংলাদেশ সরকারের প্রতি দাবি পূরণের আহ্বান জানিয়ে কেএনএফ বলেছে, দাবি পূরণ না হলে সশস্ত্র হামলা চালাবে।
কেএনএফ সূত্রমতে, কেএনএফের সশস্ত্র গ্রুপের সদস্য তিন-চার হাজার। যারা পার্বত্য চট্টগ্রাম ও মিজোরামে সক্রিয়। তবে ২৮ মে তাদের প্রস্তাবিত রাজ্যের মানচিত্র ফেসবুক পেজে প্রকাশ করে আলোচনার জন্ম দেয় তারা।
এসব বিষয়ে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক সদস্য নিরুপা দেওয়ান বলেন, ‘পত্রপত্রিকায় প্রথম কেএনএফের নাম শুনি। পরে ফেসবুকে তাদের নানা কর্মকাণ্ড দেখতে পাই। হঠাৎ কীভাবে কোথায় থেকে এলো নাথান? তাদের কর্মকাণ্ড দেখে মনে হচ্ছে, পার্বত্য অঞ্চলকে অশান্ত করতে নতুনভাবে ষড়যন্ত্র করছে। তাদের কোনও দাবি থাকলে আগে সরকারের সঙ্গে আলোচনা করুক। কোনও ধরনের আলোচনা ছাড়াই এভাবে যুদ্ধ ঘোষণা করলে তো সমাধান হবে না। তাদের একটি বিষয় মনে রাখা উচিত ছিল, পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি সরকারের সঙ্গে দাবি নিয়ে আলোচনা করে পরে যুদ্ধ ঘোষণা করে।
দুই যুগ যুদ্ধ করার পর আলোচনার টেবিলে আসতে হয়েছে আমাদের। তাই তাদের কোনও দাবি থাকলে আলোচনার টেবিলে সমাধান করতে হবে। অন্য কোনও উদ্দেশ্য থাকলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে দিয়ে তাদের দমন করা উচিত। তবে এক্ষেত্রে স্থানীয় মানুষ যাতে ক্ষতির মুখে না পড়ে সে বিষয়ে খেয়াল রাখতে হবে।’
বড়থলি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আতো মং মারমা বলেন, ‘তাদের এসব কর্মকাণ্ডের পর থেকে এলাকার মানুষ আতঙ্কে আছেন। যৌথবাহিনী আছে বলে কিছুটা ভয় কম আমাদের। কিন্তু যৌথবাহিনী চলে গেলে আবার কি করে বসে তারা সে আতঙ্কে আছি। এলাকার মানুষজন তাদের ভয়ে জুম চাষে যেতে পারছেন না। এখন অভিযানের কারণে কুকি-চিনরা আত্মগোপনে। কিন্তু অভিযান শেষে যৌথবাহিনী চলে গেলে কি হবে তা নিয়ে চিন্তিত আমরা। এখানে নিরাপত্তা বাড়ানো জরুরি।’
রাঙামাটির পুলিশ সুপার মীর আবু তৌহিদ বলেন, ‘সরকার সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে আগেও কঠোর অবস্থানে ছিল, এখনও কঠোর অবস্থানে রয়েছে। কাউকে জঙ্গিবাদের উদ্দেশ্যে দেশের মাটি ব্যবহার করতে দেওয়া হবে না। যেহেতু পার্বত্য এলাকাটি দুর্গম, তাই সবসময় সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করে পাহাড়ি সন্ত্রাসীরা। তাদের দমনে সবসময় কাজ করে যাচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। সশস্ত্র সংগঠনের সদস্যদের গ্রেফতারে অভিযান চলছে। স্থানীয়দের ভয়ের কোনও কারণ নেই। এটি সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে অভিযান।