করোনাভাইরাসের তান্ডব শেষ হতে না হতেই শুরু হয় রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। এতে হু হু করে বাড়তে থাকে নিত্যপণ্যের দাম। ভোজ্যতেল দিয়ে বাজারে অস্থিরতার শুরু। ভোজ্যতেলের পর ধীরে ধীরে চিনি, গম, পেঁয়াজ, রসুনের পর এবার ভরা মৌসুমেও চালের বাজারে শুরু হয়েছে অস্থিরতা। চট্টগ্রামের অন্যতম পাইকারি বাজার চাক্তাই ও পাহাড়তলীতে এক মাসের ব্যবধানে ৫০ কেজির চালের বস্তার দাম বেড়েছে ৩০০ থেকে ৬০০ টাকা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাজারে চালের দাম বেশি হওয়ার কারণে চলতি বোরো মৌসুমেও সরকারের চাল সংগ্রহে ধস নেমেছে। আবার বড় বড় শিল্প গ্রুপের মজুতদারি, উত্তরাঞ্চলের মিলার সিন্ডিকেট এবং ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সীতাকুণ্ডের ওজন স্কেলের কারণেও বাজারে চালের দাম হু হু করে বাড়ছে বলে অভিমত অনেকের।
চাক্তাই পাইকারি বাজারের ব্যবসায়ী এবং চট্টগ্রাম চাল ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক ওমর আজম বলেন, কখনো ভরা মৌসুমে চালের দাম বাড়ে না। কিন্তু এবারের চিত্র উল্টো। এবার বোরো মৌসুমের শুরু থেকে চালের দাম বাড়তে শুরু করেছে। আমি গত এক বছর ধরে বলে আসছি, বড় শিল্প গ্রুপগুলোর ধানের মজুতদারির কারণে বাজারে চালের কৃত্রিম সংকট তৈরি হচ্ছে। এখন সরকার ও চাল ব্যবসায়ীরা বিষয়টি টের পাচ্ছেন।
তিনি বলেন, কখনো মৌসুমের শুরুতে চালের দাম বাড়ে না। মৌসুম শেষের দিকে চালের স্টক কমে আসলে বাজারে দাম বাড়ার কথা ছিল। কিন্তু ওই শিল্প গ্রুপগুলো আগেভাগে ধান কিনে নেওয়ার কারণে বাজারে হঠাৎ করে চালের দাম বেড়েছে। তিনি আরও বলেন, এবার বোরো মৌসুমে ফলন ভালো হয়েছে। কিন্তু ফলন তোলার আগ মুহূর্তে সিলেট, সুনামগঞ্জ এলাকায় বন্যায় ফসল নষ্ট হয়েছে। এর প্রভাবও বাজারে পড়েছে।
পাহাড়তলী বাজার চাল আড়তদার ব্যবসায়ী সমিতির সহ-সভাপতি জাফর উদ্দিন বলেন, রমজানের ঈদের পর থেকে এক মাসের ব্যবধানে ৫০ কেজির প্রতি বস্তায় দাম বেড়েছে ৪০০ থেকে ৬০০ টাকা পর্যন্ত। গত দুইদিন জেলা প্রশাসনের অভিযানের কারণে বস্তা প্রতি ২০-৫০ টাকা কমলেও সামনে আর কমবে না।
তিনি বলেন, বোরো মৌসুমের ধান কৃষকরা ইতোমধ্যে তুলে ফেলেছেন। যতটুকু বিক্রি করার অধিকাংশ কৃষক তা বিক্রি করে দিয়েছেন। এখন কৃষকদের কাছে ধান নেই। এ অবস্থায় সরকারের উচিত চাল আমদানির অনুমতি দেওয়া। তাহলে যাদের মজুতদারির কারণে বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি হয়েছে, তারা ধরাশায়ী হবে। বাজারে চালের দামও কমে যাবে।
চাক্তাই ও পাহাড়তলী পাইকারি বাজারের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বাজারে মোটা চাল হিসেবে পরিচিত নুরজাহান স্বর্ণা সেদ্ধ চাল। বর্তমান বাজারে প্রতি ৫০ কেজির নুরজাহান স্বর্ণা সেদ্ধ চালের দাম ২২৫০ থেকে ২৩০০ টাকা। এই চাল গত রমজানের ঈদের পর (এক মাস আগে) ছিল ১৮০০ থেকে ১৯০০ টাকা। আবার বাজারে জিরাশাইল জাতের চালের কদর রয়েছে। চট্টগ্রাম এলাকায় মেজবানসহ বড় আচার অনুষ্ঠানে জিরাশাইল চাল বেশি ব্যবহার হয়। বর্তমানে বাজারে ৫০ কেজি জিরাশাইল সেদ্ধ চালের দাম ৩২০০ থেকে ৩৪০০ টাকা। এক মাস আগেও এই চালের দাম ছিল ২৭০০ থেকে ২৮০০ টাকা। গত একমাস আগে কাটারিভোগ (৫০ কেজি) চালের দাম ছিল ৩২০০ থেকে ৩৩৫০ টাকা। বর্তমানে এ জাতের চালের দাম ৩৬০০ থেকে ৩৬৫০ টাকা। একইভাবে ৫০ কেজি মিটিকেট আতপ চালের দাম ছিল ২৩০০ থেকে ২৪৫০ টাকা। বর্তমানে তা বেড়ে ২৬০০ থেকে ২৭০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
কথা হলে চাক্তাইয়ের মেসার্স সেকান্দার হোসেন নামের আড়তের পরিচালক জাহেদুল ইসলাম শাওন বলেন, চট্টগ্রামের বাজারে বেশিভাগ চাল আসে দেশের উত্তরাঞ্চল থেকে। দেশের মহাসড়কগুলোতে তেমন ওজন স্কেল নেই। কিন্তু ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সীতাকুণ্ড ও মেঘনায় ওজন স্কেল রয়েছে। স্কেলের কারণে ১৩ টনের বেশি পণ্য পরিবহন করা সম্ভব হয় না। যে কারণে চট্টগ্রামে পণ্য আনা-নেওয়ার ব্যয় বেশি। চালের বাজারেও তাই। আবার পাহাড়তলী বাজারের চেয়ে চাক্তাইয়ে আনতে পরিবহন ব্যয় আরেকটু বেশি। চাক্তাই এলাকায় ট্রাক আসতে চায় না। এখানে শ্রমিক সংগঠনের নামে চাঁদাবাজি হচ্ছে। চাক্তাইয়ে আনতে পাহাড়তলীর চেয়ে প্রতি ট্রাকে তিন থেকে চার হাজার টাকা ভাড়া বেশি দিতে হয় বলে জানান তিনি।
চাক্তাইয়ের আরেক ব্যবসায়ী মক্কা রাইস এজেন্সির মালিক হাজী মো. রাসেল বলেন, এবার বোরো মৌসুমের শুরুতে সিলেট এলাকায় ফলন নষ্ট হয়েছে। ধান পুরোপুরি পাকার আগে বন্যার কারণে অনেক কৃষককে ধান কাটতে হয়েছে। অনেকের ধান বন্যার পানিয়ে তলিয়ে গেছে। এটার প্রভাবও বাজারে পড়েছে। গত বছর মৌসুমের মধ্যেও চাল আমদানি হয়েছে। তবে এবার আমদানি হচ্ছে না। তাছাড়া বড় মোকামগুলো বলছে, কৃষক পর্যায়ে এবার ধানের দাম বেশি হওয়ায় চালের দাম বেড়েছে।
খাদ্য বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বোরো মৌসুমে সাড়ে ৬ লাখ মেট্রিক টন ধান, ১১ লাখ মেট্রিক টন সেদ্ধ চাল এবং ৫০ হাজার মেট্রিক টন আতপ চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। চলতি মৌসুমে বোরো ধান প্রতিকেজি ২৭ টাকা, সেদ্ধ চাল ৪০ টাকা এং আতপ চাল ৩৯ টাকা করে সংগ্রহ করা হচ্ছে। গত ২৮ এপ্রিল থেকে ধান এবং ৭ মে থেকে চাল সংগ্রহ শুরু হয়েছে। আগামী ৩১ আগস্ট পর্যন্ত ধান-চাল সংগ্রহ চলবে বলে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের খাদ্য পরিকল্পনা ও পরিধারণ ইউনিট (এফপিএমইউ) সূত্র জানিয়েছে।
এফপিএমইউ’র তথ্য অনুযায়ী, ১ জুন পর্যন্ত সারাদেশে এক লাখ ৯৭ হাজার ৪৯৩ মেট্রিক টন ধান-চাল সংগৃহীত হয়েছে। এর মধ্যে ধান ৩১ হাজার ৫০৯ মেট্রিক টন, সেদ্ধ চাল এক লাখ ৭৬ হাজার ৫৬২ মেট্রিক টন এবং আতপ চাল ৪৫০ মেট্রিক টন। তবে বিগত ২০২১ সালের বোরো মৌসুমে একই সময়ে সংগ্রহ হয়েছিল ১৩ লাখ ৮১ হাজার ৫৫২ মেট্রিক টন ধান-চাল। তার মধ্যে ধান তিন লাখ ৬২ হাজার ৪৪৫ মেট্রিক টন এবং চাল (সেদ্ধ ও আতপ মিলিয়ে) ১১ লাখ ৪৫ হাজার ৯৬৩ মেট্রিক টন। এই হিসাবে গত বছরের বোরো মৌসুমের তুলনায় চলতি বোরো মৌসুমে একই সময়ে প্রায় ৮৫ শতাংশ সংগ্রহ কম হয়েছে।
চট্টগ্রাম আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রক জহিরুল ইসলাম খান শুক্রবার (৩ জুন) বিকেলে বলেন, বোরো মৌসুমে আমাদের ধান-চাল সংগ্রহ শুরু হয়ে গেছে। সরবরাহকারীদের সঙ্গে চুক্তিও হয়ে গেছে। ইতোমধ্যে ১৮ শতাংশ সেদ্ধ চাল সংগ্রহ হয়েছে। আতপ চালও কেনা হচ্ছে। তবে গত বছরের এই সময়ের তুলনায় এবার সংগ্রহ কিছুটা কম বলে তিনি জানান। তিনি বলেন, বোরো মৌসুমে এবার ফলন বিলম্বিত হওয়ার কারণে সংগ্রহ কিছুটা পিছিয়েছে। তারপরেও এখনো সংগ্রহের অনেক সময় রয়েছে।
বড় শিল্প গ্রুপের ধান-চাল মজুতের বিষয়ে জানতে চাইলে জহিরুল ইসলাম খান বলেন, বিষয়টি নিয়ে আমরা কোনো মন্তব্য করতে চাচ্ছি না। তারপরেও চালের মূল্য স্থিতিশীল রাখার জন্য বাজারে আমাদের ব্যাপক আকারে মনিটরিং রয়ে