সামাজিক মাধ্যমসহ আধুনিক যুগে অধিকাংশ নারীর ব্যক্তিগত তথ্য, একান্ত গোপন ও অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ছবি এবং ভিডিও সামাজিক মাধ্যমের রেডিট প্ল্যাটফর্মে ছড়ানোর পর এসব নারী অজ্ঞাতপরিচয় একদল মানুষের কাছ থেকে হুমকি আর ব্ল্যাকমেইলের শিকার হয়েছেন। হুমকি দেয়া এরকম একটি দলের এক ব্যক্তির মুখোশ খুলে দিয়েছে বিবিসি- আর এই রহস্য উদঘাটনের পেছনে সূত্র হিসাবে কাজ করেছে পুরনো একটি সিগারেট লাইটার।
অনলাইনে এসব মন্তব্য ও চ্যাট পড়তে গিয়ে এবং ছবিগুলো দেখে আমার রীতিমত অসুস্থ লাগছিল।
অনলাইনে নারীদের এধরনের হাজার হাজার ছবি। সম্পূর্ণ নগ্ন এবং অর্ধনগ্ন নারীদের ছবির অফুরন্ত ভাণ্ডার। আর এসব ছবির নিচে রয়েছে নারীদের নিয়ে পুরুষদের কুরুচিপূর্ণ, অশ্লীল সব মন্তব্য- এমনকি ধর্ষণের হুমকিও। এসব মন্তব্য এতটাই অশ্লীল ও খোলামেলা যে তা এখানে শেয়ার করা অসম্ভব।
এই জগতের খবর প্রথম আমার নজরে আনেন আমার এক বান্ধবী। তার একটি ছবি ইনস্টাগ্রাম থেকে তুলে কেউ পোস্ট করেছিলেন রেডিট প্ল্যাটফর্মে। ওটি তার নগ্ন কোন ছবি ছিল না। তারপরেও ওই ছবির সাথে যৌন ইঙ্গিতপূর্ণ এবং কুরুচি ভাষায় মন্তব্য জুড়ে দেয়া হয়েছিল। ওই নারী তার নিজের এবং অন্যান্য নারী সম্পর্কে আমার কাছে উদ্বেগ প্রকাশ করেন।
এরপর খোঁজ নিয়ে আমি একটা বাজারের সন্ধান পাই। সেখানে রয়েছে শত শত অজ্ঞাত পরিচয় নারীর ছবি এবং তাদের সম্পর্কে তথ্য। এগুলো দেয়া হয়েছে শেয়ার করার জন্য, ব্যবসা করার লক্ষ্যে এবং তাদের নগ্ন ও অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ছবিগুলো বিক্রি করার জন্য। এবং সব কিছুই কার্যত এসব নারীর অনুমতি না নিয়েই।
ডোক্সিং
দেখে মনে হয়েছে তথাকথিত রিভেঞ্জ পর্নের এক নতুন বিবর্তন এই বাজার, যেখানে নারীদের ব্যক্তিগত যৌন জীবনের ছবি বিনা সম্মতিতে অনলাইনে প্রকাশ করা হচ্ছে। এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই একাজ করছে নারীদের সাবেক জীবনসঙ্গীরা তাদের ভেঙে যাওয়া সম্পর্কের তিক্ত বহিঃপ্রকাশ হিসাবে।
এসব অন্তরঙ্গ ছবি শুধু যে হাজার হাজার মানুষের সাথে শেয়ার করা হচ্ছে তাই নয়, কিছু পুরুষ পরিচয় আড়াল করা মুখোশের পেছনে থেকে জোট বেঁধে এই নারীদের আসল পরিচয় ফাঁস করে দেবার জন্য হুমকি দিচ্ছে, ব্ল্যাকমেইল করছে। সাইবার দুনিয়ায় যা পরিচিত ‘ডোক্সিং’ নামে।
এভাবে অনলাইনে তাদের ঠিকানা, ফোন নম্বর এবং সামাজিক মাধ্যম টুইটারে তাদের পরিচিতি হ্যান্ডেল অন্যদের কাছে ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। এরপর ওই নারীদের লক্ষ্য করে কুরুচিকর যৌন মন্তব্য করা হচ্ছে এবং তাদের হুমকি দেয়া ও ব্ল্যাকমেইল করা হচ্ছে।
এসব দেখে মনে হয়েছিল আমি বোধহয় ইন্টারনেটের খুবই অন্ধকার এক কোনায় হঠাৎ করে ঢুকে পড়েছি। কিন্তু, না – এসব ঘটছে বড় একটি সামাজিক মাধ্যম প্ল্যাটফর্মে।
সামাজিক প্ল্যাটফর্ম রেডিট
এই প্ল্যাটফর্ম রেডিট নিজেদের “ইন্টারনেটের প্রথম পাতার” মাধ্যম হিসাবে তুলে ধরে। তাদের অনুসারীর সংখ্যা বিশ্বব্যাপী প্রতিদিন প্রায় পাঁচ কোটি, যার মধ্যে ব্রিটেনে তাদের ব্যবহারকারী রয়েছে প্রায় ৪০ লাখ।
রেডিট কিছু ব্যক্তিকে ফোরাম চালানোর অনুমতি দেয়, যেগুলোকে বলা হয় ‘সাবরেডিট’। এই ফোরামগুলো নানা ধরনের বিষয় নিয়ে এবং নানা স্বার্থের সাথে জড়িত। কিন্তু এর বেশিরভাগই তেমন ক্ষতিকারক নয়।
তবে বিতর্কিত যৌন কন্টেন্টকে জায়গা দেবার ইতিহাস রয়েছে এই রেডিট প্ল্যাটফর্মের।
এই সাইটে ২০১৪ সালে বিভিন্ন তারকার ব্যক্তিগত ছবি শেয়ার করার একটি ঘটনা ধরা পড়েছিল। এবং এর চার বছর পর রেডিট “ডিপফেক” প্রযুক্তি ব্যবহার করার কারণে একটি গোষ্ঠীকে তাদের প্ল্যাটফর্ম থেকে নিষিদ্ধ করে দেয়। এই “ডিপফেক” প্রযুক্তি হল এমন একধরনের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তি (এআই) যা “চরম ভুয়া” জিনিস তৈরি করতে সক্ষম। এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে গোষ্ঠীটি সেলিব্রিটি তারকাদের ছবি বসিয়ে পর্ন ভিডিও বানাচ্ছিল।
এনিয়ে বিতর্কের জেরে আমেরিকান এই সংস্থাটি তাদের আইনকানুন কঠোর করে, এবং তাদের সাইটে সম্মতি ছাড়া কারোর অন্তরঙ্গ বা নগ্ন ছবি এবং খোলামেলা যৌনতার কোন জিনিসপত্র প্রকাশ বা প্রকাশ করার কোনরকম হুমকি প্রকাশ নিষিদ্ধ করার আইন আরো জোরদার করে।
ফলে আমি বোঝার চেষ্টা করি এরপরেও নারীদের নগ্ন ও অন্তরঙ্গ সব ছবি কীভাবে রেডিট প্ল্যাটফর্মে শেয়ার করা হচ্ছে এবং যাদের ছবি প্রকাশ করা হচ্ছে তাদের ওপর এর কী প্রভাব পড়ছে।
আমি আরও জানার চেষ্টা করি এসব ছবি প্রকাশের পেছনে আছে কারা।
দক্ষিণ এশিয় নারী
আমি স্পষ্ট দেখি যে রেডিটের জারি করা ওই নিষেধাজ্ঞা কাজ করছে না।
আমাদের অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে কয়েক ডজন ‘সাবরেডিট’ বা মূল রেডিট প্ল্যাটফর্মের আওতার বাইরে থাকা সাইট থেকে যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন জায়গা থেকে নারীদের অন্তরঙ্গ ছবি ছড়ানো হচ্ছে।
প্রথম যে সাইটটির দিকে আমি নজর দিই সেটিতে টার্গেট করা হয় দক্ষিণ এশিয় নারীদের। ওই গ্রুপে ব্যবহারকারীর সংখ্যা ছিল বিশ হাজারের ওপর, যাদের বেশিরভাগই আপাতদৃষ্টিতে একই সম্প্রদায়ের পুরুষ। তারা কমেন্ট করেছে ইংরেজি, হিন্দি, ঊর্দু এবং পাঞ্জাবি ভাষায়।
এদের মধ্যে কিছু কিছু নারীকে আমি চিনতে পারি, কারণ সামাজিক মাধ্যমে তাদের ভক্ত রয়েছে বিশাল। এদের কাউকে কাউকে আমি ব্যক্তিগতভাবেও চিনতাম।
সব মিলিয়ে সেখানে ছিল ১৫,০০০ ছবি। আমরা এর মধ্যে যে এক হাজার ছবি আমরা দেখি তার মধ্যে ছিল ১৫০জন ভিন্ন নারীর খোলামেলা যৌনতার ছবি। সবগুলো ছবির কমেন্টে তাদের যৌন সামগ্রী হিসাবে তুলে ধরে তাদের নিকৃষ্ট শ্রেণির নারী হিসাবে তুলে ধরা হয়েছে।
আমি নিশ্চিত ছিলাম যে এই নারীদের কেউই তাদের ছবিগুলো এই ফোরামে প্রকাশ করার অনুমতি দেয়নি।
রেডিটের স্ক্রিন থেকে নেয়া নিচের ছবিতে দেখা যাচ্ছে নারীদের অনুমতিহীন ছবিগুলো পোট করে তার সাথে কী ধরনের মন্তব্য করা হয়েছে-এমনকী নারীকে ধর্ষণের হুমকি দিয়েছে একজন ব্যবহারকারী। আরেকজন ব্যবহারকারী বলছেন তার কাছে এই নারীর ৫০০টির বেশি ছবি আছে।
আমার বান্ধবী নিজের যে ছবি এই সাইটে দেখতে পেয়েছিলেন, সেটির মত এসব সাইটের কিছু ছবি এসব নারীদের সামাজিক মাধ্যম থেকে সংগ্রহ করা এবং সবগুলো নগ্ন বা অন্তরঙ্গ কোন মুহূর্তের নয়। কিন্তু তারপরেও এসব ছবির সাথে ওই নারীদের খাটো করে, তাদের সম্মানহানি করে কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য করা হয়েছে এবং কখনও কখনও তাদের ফোন এবং কম্পিউটার হ্যাক করে তাদের নগ্ন ছবি তুলে আনার কথাও বলা হয়েছে।
এরকম একজন নারীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন যে, একটি গোষ্ঠী ইন্সটাগ্রাম থেকে স্বল্পবাস পরা তার একটি ছবি সংগ্রহ করে সেটি পোস্ট করার পর থেকে তিনি এখন “প্রতিদিন” অন্তরঙ্গ এবং যৌন বার্তা পাচ্ছেন- এমনকি তাকে ধর্ষণ করা হবে এমন মন্তব্যও করা হয়েছে।
সাবরেডিট সাইটে পুরুষরা নারীদের নগ্ন ছবি শেয়ার করছেন এবং এধরনের ছবি বিক্রিও করছেন। এসব ছবি দেখে মনে হচ্ছে সেগুলো সেলফি এবং সম্ভবত তোলা হয়েছিল জীবনসঙ্গী বা পুরুষ বন্ধুদের পাঠানোর লক্ষ্য নিয়ে। সেগুলো গণহারে ছড়ানোর জন্য তোলা হয়নি।
এসব সাইটে রয়েছে এমন ভিডিও যেগুলো আরও খোলামেলা – মনে করা হচ্ছে যৌন সঙ্গমের সময় গোপনে এইসব নারীর ছবি তোলা হয়েছে।
তোমাকে আমি খুঁজে বের করব’
একটি পোস্টের এক গুচ্ছ বার্তার সঙ্গে একজন নগ্ন নারীর ওরাল সেক্সের ছবি দেয়া হয়েছে।
“এর (এই সেক্সের) কোন ভিডিও আছে নাকি?” অজ্ঞাতনামা এক ব্যবহারকারী প্রশ্ন করেছেন। সঙ্গে তিনি এই নারীর একটা অসম্মানজনক নাম ব্যবহার করেছেন।
“আমার কাছে এই নারীর একটা পুরো ফোল্ডার-ভর্তি ছবি আছে- দাম ৫ পাউন্ড। যোগাযোগ করুন,” লিখেছেন আরেকজন।
“তার সামাজিক অবস্থান কী?” জানতে চেয়েছেন তৃতীয় আরেক ব্যক্তি।
আয়েশা – তার আসল নাম নয় – গত বছর জানতে পারেন তার ভিডিও সাবরেডিট প্ল্যাটফর্মে শেয়ার হচ্ছে। তার বিশ্বাস তার সাবেক প্রেমিক গোপনে এই ছবি তুলেছেন।
তাকে যে শুধু বিশ্বাস ভঙ্গের সমস্যার মোকাবেলা করতে হয়েছে তাই নয়, ফোরামে তার ব্যক্তিগত সব তথ্য পোস্ট করে দেয়ায় সামাজিক মাধ্যমে তাকে হয়রানি আর হুমকির শিকার হতে হয়েছে।
“আমার সাথে তুমি যৌন সম্পর্ক না করলে এই ছবি তোমার বাপমায়ের কাছে পাঠিয়ে দেব। আমি আসব, তোমাকে আমি খুঁজে বের করব… আমার সাথে যৌন সম্পর্ক করতে যদি রাজি না হও, আমি তোমাকে ধর্ষণ করব।” তাকে ব্ল্যাকমেইল করা এই পুরুষ তাকে ভয় দেখানোর চেষ্টা করে হুমকি দেয় “এরকম আরও ছবি আমি ফাঁস করে দেব”।
“আমি পাকিস্তানি মেয়ে। বিয়ের আগে সেক্স করা বা এরকম কিছু করা আমাদের সমাজে একেবারেই গ্রহণযোগ্য নয়,” তিনি বলেন।
আয়েশা এরপর সামাজিকভাবে মেলামেশা, এমনকি ঘর থেকে বেরুনো বন্ধ করে দেন। শেষ পর্যন্ত আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। আত্মহত্যার চেষ্টা ব্যর্থ হবার পর বাবা মাকে বলতে হয় কী ঘটেছিল। তার বাবা মা দুজনেই মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন বলে আয়েশা জানান।
“সব কিছু নিয়ে এবং তাদের এই অবস্থায় ফেলার জন্য আমার লজ্জায় মুখ দেখানোর জায়গা ছিল না।”
আয়েশা রেডিটের সঙ্গে বেশ কয়েকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেন। একটি ঘটনায় ভিডিওটা প্রায় সাথে সাথেই সরিয়ে ফেলা হয়, কিন্তু আরেকটি ভিডিওর ক্ষেত্রে সেটা সরাতে চার মাস লেগে যায়। আর সেখানেই ঘটনার শেষ নয়। যে ভিডিওটি শেষ পর্যন্ত সরানো হয়, সেটি ততক্ষণে অন্যান্য সামাজিক মাধ্যমে শেয়ার করা হয়েছে এবং এক মাস পর আবার সেটি মূল সাবরেডিট সাইটে এসে হাজির হয়েছে।
যে সাবরেডিট সাইটে আয়েশাকে হেনস্থা ও হয়রানি করা হয়, সেটি তৈরি করেছিলেন এবং চালাতেন এক ব্যক্তি যিনি নিজেকে ‘জিপ্পোম্যাড’ নামে পরিচয় দিতেন।
আর এই নামের সূত্র ধরেই বিবিসি ওই ব্যক্তিকে খুঁজে বের করতে সক্ষম হয়।
নগ্ন ও যৌনতার ছবির ব্যবসা
জিপ্পোম্যাড যেহেতু গ্রুপটির মডারেটার, তাই তার সাবরেডিট আলোচনা গ্রুপ রেডিটের নিয়মকানুন মেনে চলছে কিনা সেটা দেখা তারই দায়িত্ব। কিন্তু তিনি আদৌ তা না করে উল্টোটা করেছেন।
তার সাবরেডিট গ্রুপের সন্ধান পাবার পর আমি দেখেছি অভিযোগ পেয়ে রেডিট তার গ্রুপ বন্ধ করে দেবার পর তিনি তিনবার নতুন করে আবার গ্রুপ খুলেছেন। নতুন ভার্সানগুলোর প্রত্যেকটিতে তিনি মূল নাম সামান্য হেরফের করে ব্যবহার করেছেন। তার প্রত্যেকটা গ্রুপের নামে বর্ণবাদের চিহ্ণ রয়েছে- যেসব নাম উচ্চারণ করা যাবে না। প্রত্যেক ভার্সানে তিনি একই ধরনের কন্টেন্ট পোস্ট করেছেন এবং প্রত্যেকটিতে সক্রিয় অনুসারীর সংখ্যা কয়েক হাজার।
নগ্ন ছবি নিয়ে ব্যবসা এখন এতটাই ব্যাপক হয়েছে যে, হয়রানি ও নির্যাতন বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা এর একটা নাম দিয়েছেন – কালেক্টার কালচার (সংগ্রহের সংস্কৃতি)।
ব্রিটেনে ডারহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের অধ্যাপক ক্লেয়ার ম্যাকগ্লিন অনলাইনে এধরনের হয়রানি নির্যাতন বিষয়ে একজন বিশেষজ্ঞ। তিনি বলছেন: “এগুলো কোন বিকৃত মনের মানুষের বা অদ্ভুত বা কোন বিকৃত রুচির মানুষের কাজ নয়। এদের সংখ্যা বিশাল- হাজার হাজার মানুষ এধরনের আচরণের সাথে জড়িত।”
নগ্ন শরীরের যেসব ছবি ও যৌনতার খোলামেলা যেসব ছবি নিয়ে ব্যবসা চলে, সেগুলো হয় অনলাইনে মেসেজিং অ্যাপ বা ওয়েবসাইটের ব্যক্তিগত চ্যাটরুমে। সেখানে হাজার হাজার পুরুষ এসে জড়ো হয়, বলছেন অধ্যাপক ম্যাকগ্লিন।
তিনি বলছেন, বহু পুরুষ এধরনের সম্মতিবিহীন ছবির বিশাল সংগ্রহ গড়ে তুলে এই গোষ্ঠীর মধ্যে নিজের কদর বাড়াতে চান। এধরনের ছবি ও ভিডিও সংগ্রহের নেশা এদের এতটাই প্রবল যে এগুলো একেবারে বন্ধ করা কঠিন। আয়েশার ক্ষেত্রেও সেটাই দেখা গেছে। তিনি দেখেছেন সরিয়ে নেয়া তার ভিডিও অন্যের সংগ্রহ থেকে ওয়েবসাইটে আবার ফিরে এসেছে।
রেডিট আন্তরিক নয়
রেডিট থেকে তাদের ছবি সরানোর চেষ্টা করেছেন এমন সাতজন নারী আমাকে বলেছেন সংস্থাটি তাদের সাহায্য করতে আন্তরিক বলে তাদের মনে হয়নি। চারজন বলেছেন এসব কন্টেন্ট রেডিট কখনই সরায়নি। কাউকে কন্টেন্ট তুলে নেবার জন্য দীর্ঘ আট মাস অপেক্ষা করতে হয়েছে।
রেডিট আমাদের প্যানোরামা অনুষ্ঠানে বলেছে গত বছর বিনা অনুমতিতে পোস্ট করা ৮৮ হাজারের ওপর সেক্সের ছবি তারা সরিয়ে নিয়েছে এবং বলেছে এধরনের বিষয়কে তারা “খুবই গুরুত্বের” সঙ্গে নিয়ে থাকে।
রেডিট বলেছে অনুমতি ছাড়া প্রকাশ করা অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ছবি খুঁজে বের করার ও সেগুলো সরিয়ে নেবার জন্য তাদের স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রপাতি আছে এবং একটি দল এই কাজে নিযুক্ত আছে। তারা এধরনের ফোরাম বন্ধ করে দেয়াসহ নিয়মিত পদক্ষেপ নিয়ে থাকে বলে সংস্থাটি জানিয়েছে।
“আমরা জানি এধরনের কন্টেন্ট পোস্ট করা ঠেকানো, সেগুলো খুঁজে বের করা এবং পদক্ষেপ নেয়ার বিষয়গুলো যাতে আরও আরও দ্রুত এবং নির্ভুলভাবে করা যায়, তার জন্য আমাদের আরও করণীয় রয়েছে। এই লক্ষ্য অর্জনে আমরা আরও কর্মী নিয়োগে, যন্ত্র ও প্রযুক্তি উন্নত করতে এবং প্রক্রিয়া আরও মজবুত করতে আরও অর্থ বিনিয়োগ করছি,” জানান সংস্থার একজন মুখপাত্র।
পাশাপাশি নারীদের একান্ত ব্যক্তিগত ছবি অনলাইনে ছড়িয়ে দেওয়ার এই সংস্কৃতি থেকে নারীদের সুরক্ষা দিতেও হিমশিম খাচ্ছে ব্রিটেনের আইন।
জর্জির সাবেক জীবনসঙ্গী তাদের অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ছবি অনলাইনে শেয়াার করার পর পুলিশের স্বারস্থ হন জর্জি
আইনের ফাঁক
জর্জির সঙ্গে যোগাযোগ করে একজন অপরিচিত ব্যক্তি যখন তাকে জানান যে তার একান্ত অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ছবি ইন্টারনেটে শেয়ার করা হচ্ছে, জর্জি তখন পুলিশের দ্বারস্থ হন। তিনি জানতেন এসব ছবি শুধু একজনের কাছেই থাকা সম্ভব।
“আমি বলতে পারব না এর মধ্যেই কত লোক এসব ছবি দেখে ফেলেছে। আরও মানুষের দেখা ঠেকানোর জন্য কিছুই তখন আর করার নেই।”
জর্জি বিবিসিকে বলেন, তার সাবেক জীবনসঙ্গী তাকে টেক্সট করে স্বীকার করেন যে ছবিগুলো তিনি শেয়ার করেছেন। কিন্তু তিনি তার মনে আঘাত দিতে বা তাকে বিব্রত করতে চাননি বলে তিনি জর্জিকে জানান।
জানা যায়, তার এই স্বীকারোক্তিই আইনের একটা ফাঁক। ব্রিটেনে রিভেঞ্জ পর্নের বিরুদ্ধে বর্তমানে যে আইন রয়েছে সেই আইন অনুযায়ী এটা প্রমাণ করতে হবে যে, যে ব্যক্তি এসব ফটো বিনা অনুমতিতে শেয়ার করেছে তা ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিকে মানসিকভাবে আঘাত দেবার জন্য ইচ্ছাকৃতভাবে করা হয়েছে।
কিন্তু জর্জির সাবেক জীবনসঙ্গী সেটা করতে চাননি বলে আইনের হাত থেকে পার পেয়ে যান।
সরকারের একটি নিরপেক্ষ উপদেষ্টা সংস্থা, ল কমিশন, আইন থেকে এই অংশটি বাদ দেয়ার সুপারিশ করেছিল। কিন্তু অনলাইন নিরাপত্তা সংক্রান্ত যে আইনটি বর্তমানে সংসদে অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে তাতে এই পরিবর্তন রাখা হয়নি।
কে এই জিপ্পোম্যাড?
জিপ্পোম্যাড নামে রেডিট ব্যবহারকারী যে ব্যক্তি একটি ফোরাম তৈরি করে সেটা চালান ব্রিটেনে দক্ষিণ এশিয় নারীদের টার্গেট করে- যার শিকার ছিলেন আয়েশা- আমি তার খোঁজ শুরু করি।
সাইটে তার মন্তব্য থেকে যে ইতিহাস আমি সংগ্রহ করি, তাতে দেখি জিপ্পোম্যাড তার আসল নাম নয়। সেখানে তার ইমেল ঠিকানা নেই, নেই তার কোন ছবি। তার ইউজারনেম ‘জিপ্পোম্যাড’ থেকে শুধু একটা সূত্র পাই – একটা ধারণা যে ওই ব্যক্তি জিপ্পো সিগারেট লাইটারের সংগ্রাহক। তিনি জানান এরকম একটি লাইটার তিনি বিক্রি করতে চান।
আমি একটা ভুয়া অ্যাকাউন্ট তৈরি করে সেখান থেকে তার সাথে যোগাযোগ করি এবং জানাই যে আমি লাইটারটা কিনতে আগ্রহী।
তিনি দেখা করতে রাজি হন এবং আমাদের রিপোর্টার বিক্রেতার ভুয়া পরিচয়ে তার সঙ্গে মুখোমুখি দেখা করতে যান। এই ব্যক্তি সেই ফোরামের স্রষ্টা যেখানে বহু নারীর ব্যক্তি স্বাধীনতা লংঘন করে তাদের হয়রানি, নির্যাতনের মুখে ঠেলে দেয়া হচ্ছে।
তার নাম হিমেশ শিংগাড়িয়া। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করা ব্যক্তি এবং বড় একটি প্রতিষ্ঠানে ম্যানেজারের কাজ করেন। আমি স্বপ্নেও ভাবিনি ইনি এমন একজন ব্যক্তি হতে পারেন।
প্যানোরামা মি. সিংগাড়িয়ার সাথে যোগাযোগ করার পর তিনি সাবরেডিটে তার সাইট মুছে দেন। এক বিবৃতিতে তিনি বলেন এই গ্রুপ তিনি তৈরি করেছিলেন “দক্ষিণ এশিয়ার নারীদের কদর” বোঝানোর জন্য। তিনি বলেন এই ফোরামে ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রচুর হওয়ায় ফোরামে সব কমেন্টের ওপর নজর রাখা তার পক্ষে অসম্ভব ছিল।
তিনি বলেন তিনি কারো ব্যক্তিগত ছবি ফোরামে শেয়ার করেননি। অথবা কারও ছবি নিয়ে তিনি নিজে কোনরকম ব্যবসা করেননি। তিনি বলেন নারীরা যখনই তাদের খোলামেলা যৌনতার কোন ছবি সরিয়ে নিতে বলেছে, তিনি তা সরিয়ে নেবার কাজে তাদের সাহায্য করেছেন।
“জিপ্পোম্যাড তার কাজের জন্য গভীরভাবে বিব্রত এবং লজ্জিত। তার ব্যক্তিসত্ত্বার সাথে এর কোন মিল নেই,” ওই বিবৃতিতে বলা হয়।
বিবিসি রেডিটের কাছে একই ধরনের অন্য গ্রুপগুলোর অস্তিত্ব তুলে ধরলে রেডিট সেগুলো সরিয়ে নিয়েছে।
এর অর্থ হল, অবশেষে প্রায় এক হাজার নারীর ছবি সংস্থাটি সরিয়ে নিয়েছে। কিন্তু তাদের অকারণ যে লাঞ্ছনা ও হয়রানির শিকার হতে হয়েছে তারপর এটা তাদের জন্য কতটুকু স্বস্তির তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়।
আগামীতে প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো এবং আইন প্রণেতারা অনলাইনে এধরনের ব্যবসায় নারীদের জীবন বিধ্বস্ত হওয়া ঠেকাতে পরিবর্তন আনতে সক্ষম হলে তবেই একমাত্র এসব নারীরা শেষ পর্যন্ত স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারবেন। সুত্র: বিবিসি