1. nagorikkhobor@gmail.com : admi2017 :
  2. shobozcomilla2011@gmail.com : Nagorik Khobor Khobor : Nagorik Khobor Khobor
শনিবার, ০২ নভেম্বর ২০২৪, ১০:৩৩ অপরাহ্ন

ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট-ফার্স্ট লেডির নাটকীয় দিনগুলো

নাগরিক খবর অনলাইন ডেস্কঃ
  • আপডেট টাইম : মঙ্গলবার, ২১ জুন, ২০২২
  • ১৮৪ বার পঠিত

চারদিকে কাঁটাতারের বেড়া, সারিবদ্ধভাবে সাজানো বালুর বস্তা, আর একটু পরপরই অস্ত্র তাক করে রয়েছে স্নাইপাররা- এমন পরিবেশ অবশ্যই সাক্ষাৎকার কিংবা ফটোশুটের জন্য আদর্শ নয়। কিন্তু এর মধ্যেই পুরোপুরি প্রস্তুত হয়ে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভবন প্রাঙ্গণে হাজির হন ফার্স্ট লেডি ওলেনা জেলেনস্কা। বিখ্যাত ব্রিটিশ সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্টের প্রতিনিধির সঙ্গে সাক্ষাৎকারের শিডিউল ছিল তার। আলাপচারিতায় ধীরে ধীরে উঠে আসে ভলোদিমির জেলেনস্কির সঙ্গে পরিচয় থেকে প্রণয়, সংসার জীবন থেকে যুদ্ধকালীন ভয়ংকর অভিজ্ঞতার বর্ণনা। তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে সাক্ষাৎকার দিতে যে মোটেও স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছেন না, তা গোপন করেননি জেলেনস্কা।

ইউক্রেনীয় ফার্স্ট লেডি জানান, ভলোদিমির জেলেনস্কির সঙ্গে থাকা মানেই তার কাছে অ্যাডভেঞ্চার মনে হয়। এমনকি তাকে বিয়ের প্রস্তাব দেওয়ার ঘটনাও ছিল বেশ নাটকীয়। বয়স তখন বিশের আশপাশে, জেলেনস্কার সঙ্গে ছিল দুই বান্ধবী এবং জেলেনস্কির সঙ্গে দুই বন্ধু। সবাই মিলে একটি মিনিবাসে চড়ে কোথাও যাচ্ছিলেন। ওই সময় হঠাৎ তিন বন্ধু তিন বান্ধবীকে একসঙ্গে বিয়ের প্রস্তাব দেন। ততদিনে অবশ্য জেলেনস্কি-জেলেনস্কার প্রেমের বয়স আট বছর হয়ে গেছে।

৪৪ বছর বয়সী ওলেনা জেলেনস্কা জানান, তাদের প্রেম প্রথম দর্শনেই হয়নি। এমনকি শুরুর দিকে নিশ্চিতও ছিলেন না যে, জেলেনস্কিকে তিনি পছন্দ করেন কি না। জেলেনস্কার কথায়, সে (জেলেনস্কি) শুধু এমন একটা ছেলে ছিল যাকে আমি সপ্তম গ্রেড থেকে একাদশ গ্রেডে উঠতে দেখেছি।

তবে তাদের মধ্যে খুব শিগগির মেলবন্ধন গড়ে দেয় দুজনের দুর্দান্ত ‘সেন্স অব হিউমার’। অবশ্য জেলেনস্কার দাবি, স্বামীর চেয়ে তার সেন্স অব হিউমার বেশি ভালো। ওই সময় কয়েক বন্ধু মিলে ‘কেভারটাল ৯৫’ নামে একটি বিনোদন প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন তারা। এই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমেই বিখ্যাত হয়ে ওঠেন ভলোদিমির জেলেনস্কি।

সেদিন মিনিবাসের প্রস্তাবে জেলেনস্কার রাজি হওয়া না হওয়ার কোনো প্রশ্নই ছিল না। তার মতে, এটি ভাগ্য এবং এটিই সব। ২০০৩ সালের গ্রীষ্মে মাত্র এক সপ্তাহের ব্যবধানে বিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ হয় ওই তিন জুটিই।

ইউক্রেনের দক্ষিণে ক্রিভি রিহ শহরে পাশাপাশি বেড়ে উঠেছেন তারা সবাই। গুরুত্বপূর্ণ এই শহরটি এখন যুদ্ধের সম্মুখ সারিতে। জেলেনস্কার আজও মনে পড়ে, প্রিয়তম ও বন্ধুদের সঙ্গে নদীর পাড়ে আড্ডা দেওয়া বা গান শোনার সেই মধুর সময়গুলো। কমেডিতে উজ্জ্বল ক্যারিয়ার গড়ার লক্ষ্যে একসময় রাজধানী কিয়েভে চলে আসেন তারা, যা এখন তাদের স্থায়ী ঠিকানা।

ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে স্ক্রিপ্ট লিখে দিতেন জেলেনস্কা আর তাতে পারফর্ম করতেন জেলেনস্কি। তারই ধারাবাহিকতায় ২০১৯ সালে জেলেনস্কি ‘সার্ভেন্ট অব দ্য পিপল’ নামে একটি জনপ্রিয় টিভি সিরিজে অভিনয় করেন, যেখানে তাকে শিক্ষক থেকে দেশের প্রেসিডেন্ট হতে দেখা যায়। তার বাস্তবে প্রেসিডেন্ট হওয়ার ক্ষেত্রেও এটি বেশ ভূমিকা রেখেছিল। তবে ভবিষ্যতে কী ঘটতে যাচ্ছে, তা ওই সময় ঘুণাক্ষরেও কল্পনা করেননি কেউ।

২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি। ভোরের আলো ফোটার আগেই ঘুম ভেঙে যায় জেলেনস্কার। তিনি ভেবেছিলেন, হয়তো আতশবাজি ফোটার শব্দ শুনেছেন। কিন্তু ততক্ষণে কাপড়-চোপড় পরে পুরোপুরি তৈরি হয়ে পাশের ঘরে পৌঁছে গেছেন প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি। মুখে শুধু বললেন, ‘শুরু হয়ে গেছে (রাশিয়ার আক্রমণ)।’ আর তারপরই বেরিয়ে যান তিনি। ফলে দেশে কী শুরু হয়েছে তা সন্তানদের বোঝানোর দায়িত্ব পড়ে জেলেনস্কার কাঁধে।

তিনি করিডোর ধরে এগোনোর সময় রীতিমতো কাঁপছিলেন, বারবার নিজেকে বোঝাচ্ছিলেন, কিছুতেই কাঁদা যাবে না। কিন্তু সন্তানদের ঘরে পৌঁছে দেখেন তাদের নয় বছরের ছেলে কিরিরো ও ১৭ বছরের মেয়ে ওলেকসান্দ্রা এরই মধ্যে জেগে উঠেছে এবং সবই জানে।

তখন সন্তানদের দ্রুত তৈরি হতে বলেন ইউক্রেনীয় ফার্স্ট লেডি। কিয়েভ ছেড়ে দূরে যেতে হবে তাদের। জেলেনস্কা বলেন, আমাকে দেখাতে হচ্ছিল, সব ঠিকঠাক রয়েছে আর এটি একটি অ্যাডভেঞ্চার মাত্র। এর জন্য কৃত্রিম হাসি হাসতে হাসতে গাল ব্যথা হয়ে গিয়েছিল আমার। সেদিন সন্ধ্যার মধ্যে রাজধানী থেকে অনেক দূরে একটি গোপন স্থানে আশ্রয় নেন তারা তিনজন।

ইউক্রেনীয় ফার্স্ট লেডি জানান, যুদ্ধের প্রথম কয়েকদিন দমবন্ধ পরিস্থিতিতে কাটাতে হয়েছে তাদের। শত্রুদের এক নম্বর টার্গেট স্বামী এবং তারা হয়তো দুই নম্বর, এটি যথাসাধ্য না ভাবার চেষ্টা করছিলেন সবসময়। তাদের নিরাপদ রাখতে প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা নিয়েছিলেন পেশাদার লোকজন। জেলেনস্কা বলেন, বুঝতে পারছিলাম যে, আমি কিছুই বুঝতে পারিনি।

সারা দেশের ইউক্রেনীয়দের মতো প্রেসিডেন্ট পরিবারও হঠাৎ বিভক্ত হয়ে পড়ে। জেলেনস্কি সামরিক সবুজ পোশাক পরে বিশ্বের সামনে মুখ দেখান আর জেলেনস্কা ও সন্তানেরা গোপন স্থানে লুকিয়ে থাকেন। ওইসময় যতবার সতর্কতা সাইরেন বেজে উঠতো, জেলেনস্কা ও তার দুই সন্তান দৌড়ে বোম্ব শেল্টারে আশ্রয় নিতেন। এভাবে দিনভর চলতো ওঠানামার খেলা। ঘুমানোর সুযোগ ছিল না জেলেনস্কার। সারাক্ষণ বাচ্চাদের দিকে নজর রাখতে হতো। কখনো হয়তো চোখ বুজে এসেছে, ঠিক তখনই ছেলে অথবা মেয়ে দৌড়ে এসে বলেছে ‘মা, শেল্টারে যাওয়ার সময় হয়েছে।’

প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি ইউক্রেনে সামরিক আইন জারি করলে ১৮ থেকে ৬০ বছর বয়সী পুরুষদের দেশত্যাগ নিষিদ্ধ হয়ে যায়। তখন অনেক নারীই সন্তানদের নিয়ে পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে চলে যান। আর জেলেনস্কার মতো বাকি নারীরা সম্মুখ যুদ্ধ থেকে দূরে থাকার ভূমিকা নেন।

ইউক্রেন যুদ্ধের ভয়াবহতার মধ্যে ধীরে ধীরে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সবচেয়ে আলোচিত ব্যক্তিত্বে পরিণত হন ভলোদিমির জেলেনস্কি। সাধারণ এক কমেডিয়ান থেকে তার অসাধারণ বিশ্বনেতা হয়ে ওঠায় আশ্চর্য হন অনেকেই। তবে স্ত্রী জেলেনস্কা এতে মোটেও অবাক হননি। তার কথায়, জেলেনস্কি সবসময় এমন মানুষ ছিল, যার ওপর আমি নির্ভর করতে পারি। এটি এখন আরও বেশি লোকের কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে মাত্র।

জেলেনস্কির জীবনসঙ্গী বলেন, একজন অভিনেতা চিরকাল অভিনেতাই থেকে যায়, এটি মিথ্যা। একজন মানুষের পক্ষে যতটা খোলামেলা হওয়া সম্ভব, তিনি (জেলেনস্কি) ঠিক ততটাই। আমি তার মুখ একটা খোলা বইয়ের মতো পড়তে পারি এবং আমি নিশ্চিত, আপনারাও পারবেন।

দুই মাসের বেশি সময় এই দম্পতি একে অপরকে সামনাসামনি দেখতে পাননি। অন্যদের মতো জেলেনস্কাও তার স্বামীকে টেলিভিশন অথবা সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাষণ দিতে দেখতেন। ভাষণে মুগ্ধ হলেও ইউক্রেনীয় ফার্স্ট লেডির মতে, এর সময় আরও সংক্ষিপ্ত হওয়া উচিত ছিল। মুখে আবছা হাসি নিয়ে জেলেনস্কা বলেন, সে (জেলেনস্কি) সবসময় বলে, আমি নাকি তার খুব বেশি সমালোচনা করি, কখনোই যথেষ্ট প্রশংসা করি না।

স্বামীর মুখে যে দাঁড়ি বড় হয়ে গেছে, ভিডিওতে তা চোখ এড়ায় না জেলেনস্কার। কিছু দিন আগে কিয়েভে ফিরে অবশ্য জেলেনস্কির দাঁড়ি ছাটানোর ব্যবস্থা করেছেন তিনি। তবে স্বামীর দাঁড়ি জেলেনস্কাকে পুরোনো সুখের সময়ের কথা মনে করিয়ে দেয়, যখন গ্রীষ্মের ছুটিতে কোনো কাজ থাকতো না জেলেনস্কির, তিনি যেমন খুশি তেমন থাকতে পারতেন। কিন্তু যুদ্ধের সময় এর অর্থ এখন অন্য কিছু।

এখন আপাতত স্ক্রিপ্ট লেখা বন্ধ রেখেছেন ওলেনা জেলেনস্কা। কারণ এটি কমেডির সময় নয়। বরং এই শক্তিটুকু তিনি অরক্ষিত শিশুদের নিরাপদ আশ্রয়ে পাঠানো ও মানসিক সাহায্যের কাজে ব্যয় করছেন।

ফার্স্ট লেডির মতে, বিপুল সংখ্যক ইউক্রেনীয় দেশত্যাগ করায় ইউক্রেনের সম্ভাবনা অনেক কমে গেছে। দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবতেও তার ভয় হচ্ছে। তবে এই মুহূর্তে প্রত্যেক ইউক্রেনীয়র কাছে যা রয়েছে তা রক্ষার জন্য লড়াই করতে হবে।

অন্য বাবা-মায়ের মতো জেলেনস্কাও তার সন্তানদের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন। তার মতে, ব্যাগে ভরা সন্তানের মরদেহ গ্রহণ করার চেয়ে দুর্ভাগ্যজনক আর কিছু নেই। সেই তুলনায় তিনি অনেক ভাগ্যবতী যে, তার সন্তানেরা পাশে রয়েছে। আর কিছুদিনের মধ্যে মেয়ের বয়স ১৮ হবে, হয়তো কিয়েভ ইউনিভার্সিটিতে পড়াশোনা করবে। ছেলের সেই পর্যায়ে পৌঁছাতে আরও অনেক দেরি। জেলেনস্কা চান, তার সন্তানেরা যেন স্বাধীন ও শান্তিপূর্ণ দেশে আরও বহু বছর বেঁচে থাকতে পারে। তবে ইউক্রেনের বর্তমান পরিস্থিতিতে সেটি বহু দূরের বিষয় মনে হয়। ফার্স্ট লেডি বলেন, সবচেয়ে ভয়ের বিষয়, সে (ছেলে) সবাইকে বলে বেড়ায়, সে-ও সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে চায়।

নিউজটি শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2020 nagorikkhobor.Com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com