আমি বাংলাদেশের কথা বলি। আমি বাংলাদেশের ছেলে।বাংলাদেশের সুর লয় তালের মধ্যে আমার জীবন, আমার প্রাণ; আমার বেঁচে থাকার সবটুকু আনন্দ। বাংলাদেশের আকাশে বাতাসে আমার নিঃশ্বাসের ছড়াছড়ি, তারই প্রশ্বাসে জীবন খুঁজে বেড়াই। আমার সুখদুঃখ আনন্দবেদনা বাংলাদেশকেই ঘিরে। আমি স্বপ্ন দেখি বাংলাদেশের, স্বপ্ন দেখি স্বাধীন সার্বোভৌম বাংলাদেশের, যেখানে বাংলার প্রতিটি মানুষের পাখির নীড়ের মত একটি আবাস থাকবে, থাকবে জীবনের নিশ্চয়তা। শান্তির এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে থাকবে আমার বাংলাদেশ মনেপ্রাণে এ আমার একান্ত চাওয়া।
বাংলা ভাষা আর বাংলা মা’য়ের প্রতি দূর্বলতার কারণে যেখানে এর সুর শব্দ ভাষা শুনতে পাই সেখানেই বিগলিত হই। আমি তখন বুঝিনা কে বিএনপি, কে আওয়ামীলীগ,কে নাস্তিক অথবা আস্তিক। আমি দেখি এক বাংলার মুখ, এক ভাষার মানুষ। অথচ ছোট্ট একটি দেশ এই বাংলাদেশ, তাতে কতজনের কত মত, কত পথ, কত অভিমত। আমরা কখনো এক হতে পারছি না।
এক ভাষায় কথা বললেও মনের দূরত্ব থেকে যাচ্ছে লক্ষ যোজন দূরে। কিন্তু একটি জায়গায় আমরা সবাই দূর্বল, ঐ জায়গায় নাড়া খেয়ে মাঝে মাঝে একত্রিত হই। দেশকে সবাই ভালোবাসি, অবশ্য জামায়াতী দল বাদে। সবাই দেশের জন্য আকুল হয়ে থাকি। মা’য়ের মত ভালোবাসার এই অনুভূতি কমবেশি অনেক বাঙালির মধ্যে আছে। যে অনুভূতি আমাকেও পুড়িয়ে মারে।
আমার দেশে কী নেই! আকাশ বাতাস সবুজ বন-বনানী,নদ-নদী, সাগর পাহাড়…কী নেই আমাদের! আছে প্রাকৃতিক সম্পদ, খনিজ সম্পদ,সামুদ্রিক সম্পদ,মৎস্য সম্পদ। সেই সাথে আছে হাজার বছরের কৃষ্টি সংস্কৃতি শিল্প সাহিত্য। আছে হাছন রাজা, লালন ফকির; জয়নুল আবেদিন, জীবনানন্দ,নজরুল,আরো কত কত ঋষি মনিষীর নাম। আরো আছে কুটির শিল্প, বেদবেদান্ত আরও কত কী ঐতিহ্য! আমরা কী আমাদের সবটুকু নিয়ে এগিয়ে যেতে পারি না! আমাদের মাটি থেকে উৎসারিত যে কৃষ্টি সংস্কৃতি শিল্প, সে সবই তো আমাদের অহঙ্কার।
এখনো আমরা এসব মাথায় তুলে নিয়ে বিশ্বের দরবারে স্বমহিমায় এগিয়ে যেতে পারি। কিন্তু সেই মানসিকতা ক’জন বাঙালি পোষণ করেন? এত সুন্দর সমৃদ্ধ বাংলাদেশ, যেখানে বিদেশী বেনিয়ানদের দৃষ্টি সব সময় পড়ে থাকে,ইচ্ছেমত ছিড়েকুড়ে খাওয়ার হিংস্রতা নিয়ে এসব বিদেশীরা সব সময় ওত পেতে থাকে, অথচ সেখানে আমরা কী করছি? চোখের সামনে দিয়ে সব হারিয়ে যাচ্ছে!
আসলে আমরা নিজের দেশটাকে এতটুকুও ভালোবাসিনি। না ভালোবাসার কারণ, আমাদের আন্তরিকতা আর একতার অভাব। অনেক বাঙালিকে দেখেছি নিজেকে বাংলাদেশী বলে পরিচয় দিতে এড়িয়ে যেতে। এমনকি বাংলাদেশের কোনো পণ্য ব্যবহার না করতেও দেখেছি তাঁদের। বাংলাদেশের কোনো কিছুই নাকি মানসম্মত নয়। এমনকি শিল্পীদের গান নিয়েও সমালোচনা হয়, সমালোচনা হয় কবি সাহিত্যিকদের সৃষ্টিশীল মননশীল জায়গাটি নিয়েও। তাঁরা নির্ভর করে থাকেন বিদেশী শিল্প সাহিত্যের উপর। জানি না বাংলার মানুষের মনের এই বৈকল্য,করুণ দূর্দশা কবে দূর হবে! খুব খারাপ লাগে যখন বাঙালি হয়ে নিজেকে বাঙালি বলে গালিগালাজ করি, খারাপ লাগে যখন দেখি কেউ নিজ শিল্প সংস্কৃতিকে ঘৃণা করে।
যখন নিজ ছোট ভাইয়ের মুখের দিকে তাকাই তখন ষোলকোটি মানুষের মুখ ভেসে ওঠে। কী অসহায়,কী নিরুপায় সেই মুখগুলো। আমার ভাইএর মত ষোলকোটি বাঙালিকে নিয়ে আমি ভাবি না। এমন ভাবনাচিত্র বাস্তবে অকল্পনীয় ,হয়তো ক্ষেত্র বিশেষে অপরাধও হবে। নিজের মত করে অন্যকে ভাবতে না পারার কারণেই আজ আমাদের এমন অধঃপতন। এই অধঃপতনের রূপ দেখতে পাই পারস্পরিক সহমর্মিতার অভাবের মধ্যে। প্রতিটি ঘরের সমস্যা পুঞ্জিভূত হতে হতে হয়ে গেছে এখন রাষ্ট্রীয় সমস্যা। যা ঘটেছে হলি আর্টিজানে,তা এরই ফল। হলি আর্টিজানের নির্মম ঘটনা এই সময়ের, এই সমাজের বীভৎস চিত্র এবং কালের কলঙ্ক। প্রতিটি মানুষের হৃদয় প্রতিকুল অবস্থার সাথে লড়াই করে রক্তাক্ত হতে হতে হলি আর্টিজানের নির্মম ঘটনায় তা বিস্ফোরিত হলো। যা একটি দেশকে তলিয়ে নেওয়ার পূর্বাভাস। আমাদের এ অবস্থান থেকে উদ্ধারের উপায় কি কারো জানা নেই? কারণ সমস্যা এখন শিকড়ে গেড়ে গেছে। এই শিকড় উপড়ে ফেলতে কি পরিমান রক্তাক্ত হবে এই বাংলার বুক, তার কি ইয়ত্তা আছে?
আমি বাংলাদেশ নিয়ে ভাবি। সমগ্র বাংলাদেশ নিয়ে কথা বলি। আমার কোনো রাজনৈতিক পরিচয় নেই। কোনো দলের ছত্রছায়ায় চলি না। মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা, ভাষা দিবস এবং অসাম্প্রদায়িক চিন্তা চেতনায় উদবুদ্ধ হয়ে দেশ ও মানুষের স্বার্থে কথা বলি, মানবতার পাশে থাকার চেষ্টা করি।
আমাকে অনেকেই নির্দিষ্ট কোন দলীয় রাজনীতির আদলে ভাবতে চান। তার তীব্র প্রতিবাদ করি। যে কোনো দলের চেয়ে দেশ বড়, তাই দেশের স্বার্থে বাংলাদেশের একজন হয়ে আজীবন আছি এবং থাকবো। কারণ আমি বাংলাদেশের ছেলে,বাংলাদেশের মানুষ, বাংলাদেশ আমার জন্মভূমি, বাংলাদেশই আমার পরিচয়। আমার রাজনৈতিক আদর্শ শুধুই বাংলাদেশ।