মতের সাথে অমিল হলেই অনেকে মা, বাবা, ভাই, বোনসহ স্ত্রী-সন্তানকে নিয়েও গালাগালা করে, নোংরা মন্তব্য করে, এমনকি হত্যার হুমকি পর্যন্ত দেয়। আবার এমন অনেককে পেয়েছি, চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা পর্যন্ত করেছে, তারা এখন জেলখানায় বন্দি।
কারণ কি..?
আমি ব্যক্তিগতভাবে অনুসন্ধান করেছি, জানার চেষ্টা করেছি। একটি মানুষের মধ্যে এমন নোংরা মন্তব্য বা গালাগালাসহ আরেকজন মানুষকে শুধু অপছন্দের কারণে হত্যা করতে ইচ্ছে হয় কেন? কিংবা যারা ফেসবুকে কমেন্ট বক্সে গালাগালা করে, আমি তাদের টাইমলাইনে গিয়ে কারণ খোঁজার চেষ্টা করেছি, করি।
আগেরকার সময় বংশ পরম্পনা দেখতে হলে তাদের সাথে মিশতে হতো, আড্ডা দিতে হতো, সময় ব্যয় করতে হতো, তাদের সংসার-ঘরেও যেতে হয়েছে। কিন্তু বর্তমান সময়ে শুধু একটা মানুষের ফেসবুকের টাইমলাইলটা দেখলেই আপনি/আমি পর্যবেক্ষণ করতে পারি, অনুসন্ধান করে জানতে পারি-ওই ব্যক্তির শিক্ষা-দীক্ষা, পারিবারিক ঐতিহ্য, শিল্প-সাহিত্য চর্চার বিষয়গুলোর সাথে, সে কী চায়, কী পছন্দ করে, কী তার বর্তমান অবস্থান, কী তার দৃষ্টিভঙ্গি!
আবার শুধু ফেসবুক টাইমলাইন দেখেই আমি-আপনি বুঝে নিতে পারবো (যদি বোঝার ক্ষমতা থাকে) কী ওই ব্যক্তির রাজনৈতিক আদর্শ কী! এমনকি, আপনি চেষ্টা করলে এটিও বুঝে যাবেন, ওই ব্যক্তি কি নতুন টাকা ওয়ালা নাকি ঐতিহ্যগতভাবেই সে অর্থনৈতিকভাবে ধনী।
আমি যতটুকু জানি, ঐতিহাসিক ও বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণীত, একমাত্র প্রাণী ‘মানুষ’কে জন্মের পর থেকেই শিক্ষা গ্রহণ করতে হয়। অন্ধকার, কুসংস্কার, বর্বরতার বিষয়গুলো-একমাত্র শিক্ষার মাধ্যমেই দূর করে মানুষ সভ্যতায় এসেছে, মানুষই সভ্যতা সৃষ্টি করেছে।
যেমন, আমরা স্কুলে একটা সময় পড়েছি বন্য মানুষ কিভাবে আগুন তৈরি করে, কিভাবে জীবন-যাপন করে। সেই বন্য মানুষ আজ সামাজিকতা গড়েছে, সমাজ আর সংসারবদ্ধ জীবন-যাপনে অভ্যস্থ হয়ে পড়েছে।
এই যে সমাজ-সংসার-এটি অতি গুরুত্বপূর্ণ। ছোটকাল থেকে যে যত ভালো ও সভ্য পরিবার পেয়েছে, শিক্ষিত ও মার্জিত অভিভাবক পেয়েছে, সে ততই মানুষ হয়েছে, মানুষ হওয়ার শিক্ষা পেয়েছে।
আমরা অনেকেই মনেকরি, একাডেমিক শিক্ষাই মূল শিক্ষা। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনেকরি এবং এই জীবনেও দেখেছি, চাকরি-বাকরি কিংবা দাপ্তরিক কাজের জন্য একাডেমিক শিক্ষা যতটা গুরুত্বপূর্ণ, তারচেয়েও গুরুত্বপূর্ণ পারিবারিক শিক্ষা, শিল্প-সাহিত্য চর্চা এবং ইতিহাস-ঐতিহ্যের ধারক-বাহক অভিভাবক।
এ কারণেই যারা গালাগাল করে, নোংরা মন্তব্য করে কিংবা হত্যা করতে চায়-ফেসবুক টাইমলাইন দেখে অবশেষে শান্তনা খুঁজে পাই। ভাবি, এই ভাইয়ের তো দোষ নেই। তিনি তো শুরু থেকেই সভ্যতা, শিল্প-সাহিত্য চর্চা থেকে বঞ্চিত। ইতিহাস ঐতিহ্য নিয়ে তার তো খুব বেশি জানাশোনা নেই।
যেমন, যে ছেলেটা সাকিব আল হাসানকে হত্যা করতে চেয়েছে, তার ব্যাপারে খোঁজ-খবর নিয়েও আমি হতাশ হয়েছি। আবার এও জেনেছি, ওই ছেলে নিজে তার হিন্দু বন্ধুর বিয়েতে গিয়েছে, ওই ছেলে নিজে পূজা মন্ডবে গিয়েছে।
আমি ব্যক্তিগতভাবে ওই ছেলেকে দোষারূপ করছি না কারণ, আমাদের দেশে নোংরা রাজনীতি, ধর্ম ব্যবসা করা কতিপয় মানুষ মিথ্যাচার আর ধর্মের অপব্যাখ্যা দিয়ে ওইসব অন্ধকার-কুসংস্কারে নিমজ্জিত মানুষগুলোকে দিয়ে ‘গেইম’ খেলে। তাদের ব্যবহার করে নিজেদের নোংরা এজেন্ডা বাস্তবায়ন করে।
ধরুন, দেলওয়ার হোসাইন সাঈদীকে চাঁদে দেখা গেছে-এই কথাটি কারা ছড়িয়েছে? কি কারণে ছড়িয়েছে? আর সাধারণ চিন্তা-ধারার মানুষগুলোকে কিভাবে হত্যা করা হয়েছে-এইসব বিষয়গুলো নিশ্চয় আপনারা ভুলেননি।
আবার, যারা চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে এখন জেলখানায় আছে-তাদের অনেকের সাথে কথা বলেছি। তারাও বলেছে এবং স্বীকার করেছে, যাঁকে হত্যা করেছে সে কী অপরাধ করেছে কিংবা ব্লগে বা ফেসবুকে কী লেখেছে-তাও তারা জানে না। শুধু হুজুর বলেছে, ওই লোক নাস্তিাক! তাকে হত্যা করলে সোজা বেহেস্ত।
চিন্তা করুন, যে লোক বলেছে, সে কিন্তু হত্যা করেনি বরং কোমলমতি বা কম বয়সি ছেলেকে ব্যবহার করেছে। বেহেস্ত যদি এতোই সোজা, তাহলে যে লোক বা হুজুর বলেছে, সে কেন নাস্তিককে হত্যা করেনি…?
আবার দেখবেন বা অতীতের কর্মকান্ড নিয়ে খোঁজ-খবর নিয়ে দেখলে আপনি জেনে যাবেন, যারা আত্মঘাতী বোমা হামলায় মারা যায়, তারা বরাবরই কম বয়সি, কারণ তাদের হুজুর তাদের বলেছে, এই কাজ করলে, নিজে বোমায় উড়ে অন্যকে উড়িয়ে দিলে সওয়াব বা সোজা বেহেস্তে যাওয়া যায়।
তাহলে ওই হুজুর যায় না কেন? কেন নিজে আত্মঘাতি বোমা হামলায় শহীদ হননা? আর কিছু একটা হলেই প্রশ্ন করে, আপনি কি মুসলিম?
আরে ভাই, তুমি তো জন্মসুত্রে মুসলিম। এখানে তোমার বাহাদুরী কোথায়? বরং যারা অন্য ধর্মবিশ্বাস ত্যাগ করে মুসলমান হয়েছে, তাদের বাহাদুরী আপনার চেয়েও অধিক থাকার কথা। আর আপনার কর্মকান্ডে ইসলামের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে-এটি কি ভেবেছেন..?
লম্বা হয়ে যাচ্ছে, তাই বলছি-ফেসবুকটা এখন মানুষের বংশগত পরম্পনা আর চারিত্রিক সনদপত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে।কারণ, আপনি যেখানে স্ট্যাটাস লিখবেন, ছবি/ভিডিও আপলোড করবেন, সেখানে ঝাপসা করে লেখা আছে, What’s on your mind যার বাংলা অর্থ হলো-তুমি কি ভাবছ?
আর এই ভাবনা কিন্তু আপনার/আমার ভেতরের ভাবনা। আর ভেতরটা আলোকিত না হলে আপনি অপরকে অন্ধকার ভাবতেই পারেন, গালাগাল করতেই পারেন, হত্যারও হুমকি দিতে পারেন। “তাই ভেতরটা আলোকিত করা অতি জরুরী।
লেখক:
কবীর চৌধুরী তন্ময়
সভাপতি (বোয়াফ)