কিংবদন্তি বিনিয়োগকারী ওয়ারেন বাফেটের পরিচয়ের শেষ নেই। যুক্তরাষ্ট্রের নেবারস্কা অঙ্গরাজ্যের শহর ওহামার বাসিন্দা বাফেটকে কখনো বলা হয় ‘ওরাকল অব ওহামা’, কখনোবা বিনিয়োগগুরু। বিশ্বের অন্যতম এই শীর্ষ ধনী সমাজসেবী হিসেবেও বড় পরিচয় ধারণ করেন। তবে এত পরিচয়ের মধ্যে বাফেটের যে বিষয় সারা বিশ্বের বিনিয়োগকারীদের জন্য পাঠ্য হয়ে রয়েছে, তা হলো তাঁর বিপুল অভিজ্ঞতা। বাফেটও মনে করেন, অভিজ্ঞতাই সফল বিনিয়োগকারী হওয়ার চাবিকাঠি। নতুন বিনিয়োগকারীরা অভিজ্ঞদের কাছ থেকে শিখতে পারেন। অভিজ্ঞতার কথাই যখন এল, তখন প্রথমেই প্রশ্ন আসে কত বছর বয়স থেকে বিনিয়োগ শুরু করেছেন বাফেট? উত্তর হলো ১১ বছর বয়স থেকে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ শুরু করেন বাফেট। যে বয়সে অন্য কিশোরেরা খেলায় মেতে থাকে, বাফেট তখন স্টক কিনতেন। ১৯৪২ সালে মাত্র ১১ বছর বয়সের বাফেট ৩৮ ডলারের বিনিময়ে সিটিস সার্ভিস প্রেফার্ডের (বর্তমানে সিআইটিজিও হিসাবে পরিচিত) ছয়টি শেয়ার কিনেছিলেন। সে সময় দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ চলছিল আর পার্ল হারবার আক্রান্ত হয়েছিল। আর এতে কমে গিয়েছিল শেয়ারের দাম। সে সুযোগই কাজে লাগিয়েছিলেন কিশোর বাফেট। তবে ব্যবসা বাফেট শুরু করেছিলেন আরও ছোট বয়সে। মাত্র ছয় বছর বয়সে প্রতিবেশীর বাসায় গিয়ে গিয়ে টুকিটাকি জিনিস বিক্রি করতেন তিনি। এমনকি বাফেটের বাবা যখন কংগ্রেসম্যান হয়ে ওমাহা থেকে ওয়াশিংটন ডিসিতে যান, সেখানে গিয়েও কাজ শুরু করেন বাফেট। ভোরে খবরের কাগজ বিলির কাজ নেন তিনি। এ কাজ করে মাসে ১৭৫ ডলার আয় করতেন। মাত্র ১৬ বছর বয়সে ৫৩ হাজার ডলার জমিয়ে ফেলেন তিনি। খুব কৌশলী মানুষ ছিলেন না বাফেট, তবে ছিলেন কঠোর পরিশ্রমী। তবে এই সফল মানুষও পেয়েছেন ব্যর্থতার স্বাদ। নেবারস্কা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক শেষে হার্ভার্ডের ব্যবসা অনুষদে ভর্তি হতে গিয়ে প্রত্যাখ্যাত হয়েছিলেন বাফেট। ইন্টারভিউ বোর্ডে বাফেটকে হার্ভার্ডের স্টাফ বলেন, ‘ভুলে যাও, তুমি হার্ভার্ডে যেতে পারছ না।’ এই প্রত্যাখ্যানের পর বেশ কষ্ট পান বাফেট। তবে কিছুদিনের মধ্যে তিনি আবিষ্কার করেন তাঁর আদর্শ ব্যক্তিত্ব ‘ভ্যালু ইনভেস্টিং’–এর জনক বেন-জামিন গ্রাহাম ও ডেভিড ডড কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় অনুষদের শিক্ষক। এটা জানার পর তাঁদের দুজনকে চিঠি লেখেন বাফেট। অধ্যাপক ডডকে লেখা চিঠির ভাষা ছিল অনেকটা এমন, ‘প্রিয় প্রফেসর ডড, আমি মনে করতাম আপনার বেঁচে নেই। তবে এখন আমি জানি যে আপনারা বেঁচে আছেন এবং কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াচ্ছেন। আমি খুব চাই আপনাদের এখানে পড়তে।’ ডড বাফেটের এই আবেদন গ্রহণ করেন।
বাফেটের জীবনের আরও কিছু মজার তথ্য
১. বাফেটের ছিমছাম জীবনের অন্যতম রহস্য হলো কোকাকোলা ও আইসক্রিম। ফরচুনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বাফেট দাবি করেন, দিনে প্রায় এক কোয়ার্টার কোকাকোলা পান করেন তিনি। দিনে যদি ২৭০০ ক্যালরি নেন, তার বড় অংশই হলো কোকাকোলা। ১২ আউন্স করে দিনে পাঁচবার কোলা পান করেন। আরেকটি মজার তথ্য হলো শেয়ারবাজারে যেদিন সূচক বাড়ে, সেদিন বাফেটের সকালের নাশতায় থাকে ম্যাকডোনাল্ডস থেকে আনা এক টুকরো বেকন, একটি ডিম ও পনির মাখানো বিস্কুট খান। আর যেদিন সূচক কমতে থাকে, সেদিন কেবল দুটো সসেজ প্যাটিস খেয়েই সকালটা চালিয়ে দেন বাফেট।
২. টাকাপয়সা হলেই মানুষ প্রথমে কী করে। ভালো দেখে একটা বাড়ি কেনে, দামি গাড়ি কেনে। তবে বাফেটের চিন্তা এমনটায় সীমাবদ্ধ না। এত সম্পদের মালিক হয়েও সেই ১৯৫৮ সাল থেকে বাস করছেন একই বাড়িতে। পাঁচ বেড ও আড়াই বাথরুমের সেই বাড়ি সে সময় ৩১ হাজার ৫০০ ডলারে কিনেছিলেন বাফেট।
৩. বাফেট তাঁর স্ত্রীকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলেন ১৯৫১ সালে। সে সময় বাফেটের হবু শ্বশুর তাঁকে কথা বলার জন্য ডাকেন। বাফেটের ওপর তাঁর আসলে তেমন বিশ্বাস ছিল না। বাফেটের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা জানতেই তাঁকে ডেকেছিলেন তিনি। তবে কথা বলেও প্রভাবিত হতে পারেননি হবু শ্বশুর। তিনি বলেন, ‘তুমি জীবনে কিচ্ছু করতে পারবে না। আর আমার মেয়ে না খেয়ে মরবে। তবে আমি তোমাকে দোষারোপ করব না, কারণ ডেমোক্র্যাটরা শাসনে রয়েছে, আর এরা সবাই কমিউনিস্ট।’ ৪. বাফেটের সঙ্গে দুপুরের খাবার খাওয়ার জন্য লাখ ডলার ব্যয় করতে দ্বিধা করে না মানুষ। কোনো সন্দেহ নেই, এই ভোজনের মাধ্যমে অনেক কিছু শেখার থাকে। সান ফ্রান্সিসকোর একটি দাতব্য সংস্থা ‘গ্লিড’-এর সহায়তায় এই দুপুরের খাবারের জন্য নিলামের আয়োজন করা হয়। এই নিলাম থেকে পাওয়া অর্থ গ্লিড ব্যয় করে গৃহহীন ও দরিদ্র মানুষের কল্যাণে। ওই ব্যক্তি নিউইয়র্কের স্মিথ অ্যান্ড উলেনস্কাই নামের খাবার দোকানে ওয়ারেন বাফেটের সঙ্গে দুপুরের খাবার খেতে পারবেন। এ সময় তিনি আমন্ত্রণ জানাতে পারবেন নিজের অন্তত সাত বন্ধুকেও। ২০০০ সাল থেকে এই দাতব্য সংস্থাটির সঙ্গে কাজ করছেন ওয়ারেন বাফেট। ই-বের ব্যবস্থাপনায় ২০০০ সাল থেকে এখন পর্যন্ত এই নিলাম থেকে দাতব্য কাজের ব্যয়ের জন্য অর্থ এসেছে ২৯০ লাখ মার্কিন ডলার।
৫.২০১৩ সালের শেষে এসে বাফেটের নেট সম্পদের পরিমাণ হয় ৫ হাজার ৯০০ কোটি ডলার, যা বছরের শুরুতে ছিল ৪ হাজার ৬০০ কোটি ডলার। সে হিসাবে ওই বছর বাফেটের দৈনিক আয় ছিল ৩ কোটি ৭০ লাখ ডলার। মূলত, শেয়ারের দর বাড়ায় লাভবান হন বাফেট।
৬. জীবনের ৯৪ শতাংশ সম্পদই বাফেট গড়েছেন ৬০ বছর বয়স পার হওয়ার পর। যখন তাঁর ৫২ বছর বয়স, তখন তাঁর সম্পদের পরিমাণ ছিল ৩৭ কোটি ৬০ লাখ ডলার। ৮৯ বছর বয়সে এসে বাফেটের সম্পদের পরিমাণ ৮ হাজার ১৭০ কোটি ডলার।
৭. বাফেটের টুইটারে অ্যাকাউন্ট আছে। তাঁর অনুসারীর সংখ্যাও নেহাত কম নয়, সাড়ে ১২ লাখ। তবে এখন পর্যন্ত মাত্র নয়বার বাফেটের অ্যাকাউন্ট থেকে টুইট করা হয়েছে। জানা যায়, এই টুইটগুলোর একটাও বাফেট নিজে করেননি। তাঁর হয়ে তাঁর এক বন্ধু টুইট করে দেন।
৮. পোশাক–আশাকের বিষয়ে খুব শৌখিন নন বাফেট। তারপরও কেউ বললে হয়তো বিশ্বাস করবেন না, এ ধনকুবেরের স্যুট মাত্র ২০টি এবং এগুলোর কোনোটির দাম তাঁকে দিতে হয়নি। চীনের এক ডিজাইনার মাদাম লি এগুলো বানিয়ে দেন। এ ডিজাইনার পরে বিল গেটসসহ অন্যদের স্যুটও তৈরি করে দেওয়ার সুযোগ পান বাফেটের কল্যাণে।
৯. দিনের অধিকাংশ সময় এ প্রজ্ঞাবান ব্যবসায়ী বই পড়ে কাটান। সফলতার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি দিনে অন্তত ৫০০ পৃষ্ঠা পড়ার পরামর্শ দেন।
১০. স্মার্টফোনের এ চাকচিক্যের যুগেও ২০২০ সাল পর্যন্ত নকিয়া ফ্লিপ ফোন ব্যবহার করেছেন বাফেট। গত বছর অ্যাপলের প্রধান নির্বাহী টিম কুক বাফেটকে একটি আইফোন ১১ উপহার দেন। এমনকি বাফেটকে ফোন ব্যবহারের জন্য প্রযুক্তি সহায়তা দিতেও প্রস্তাব করেছিলেন কুক। তবে বাফেট জোর দিয়ে বলেছেন, তিনি কেবল কথা বলার জন্য আইফোন ব্যবহার করবেন।
১১. শিশুদের সঙ্গে সময় কাটাতে দারুণ পছন্দ করেন এ বিলিয়নিয়ার। প্রতি রোববার
১২ জন শিশুকে তাঁর আইসক্রিম ও ফাস্ট ফুডের চেইন শপ ডেইরি কুইনে নিয়ে যান। তবে গত বছর থেকে বাফেট খুব অবাক হয়ে লক্ষ করেন, আইফোন নিয়ে এই শিশুদের আগ্রহ। বাফেটের ফোন নিয়েই মেতে থাকে তারা, কথা বলারই যেন সময় পায় না।
১২. জীবনে মাত্র একবার ই–মেইল করেছেন বাফেট। তাও আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছিল।
১৩. ১৮ বছর বয়সে এক তরুণীর প্রেমে দিওয়ানা হয়ে বাফেট ‘ইউকালেলে’ নামের একধরনের হাওয়াইয়ান গিটার বাজানো শেখেন। ওই তরুণীর প্রেমিক এটি বাজাতে পারতেন না। এটি শিখেও তিনি তরুণীর মন জয়ের ব্যর্থ চেষ্টা করেন।
১৪. ২০০৬ সালে তাঁর আয়ের বলতে গেলে প্রায় পুরোটা দান করার ঘোষণা দেন বাফেট। বার্কশায়ার হ্যাথওয়ের ৮৫ শতাংশ পর্যায়ক্রমে পাঁচ দাতব্য প্রতিষ্ঠানকে দেওয়ার কথা জানান। বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে দানশীল ধনী ব্যক্তি বাফেট।
১৫. ২০১৭ সালের মার্চে চেরি ফ্লেভারের কোকাকোলা বাজারে আসে। এই কোলার ক্যানে কিছুদিন বাফেটের মুখাবয়ব ব্যবহার করা হয়েছিল।
১৬. টুইটারে কখনো কাউকে অনুসরণ করেন না বাফেট।
১৭. মার্কিন টিভি শো ‘ব্রেকিং ব্যাড’–এর বড় ফ্যান বাফেট।
১৮. তিনি চারপাশের মানুষের সঙ্গে রসিকতা করতে পছন্দ করেন।
১৯. আরেকটি মজার তথ্য হলো শেয়ারবাজার যেদিন পড়ে, সেদিন কবিতা পড়েন বাফেট। ২০১৭ সালে শেয়ারহোল্ডারদের উদ্দেশে এক চিঠিতে বাফেট বলেন, যখন শেয়ারবাজারে বড় পতন হয়, তখন তিনি রুয়ার্ড কিপলিংয়ের ১৮৯৫ সালের ‘যদি’ কবিতার লাইনগুলো নিয়ে ভাবেন।