মুহিবুল্লাহ হত্যা রহস্য জটিল হচ্ছে। বিভিন্ন এজেন্সির দায়িত্বশীল কর্মকর্তা ও তদন্ত কাজে নিয়োজিতদের ধারণা, মুহিবুল্লাহ হত্যার সঙ্গে জড়িয়ে আছে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রকারী, যাদের স্বার্থ হানি ঘটছিলো রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তন প্রশ্নে, তারাই এই উচ্চকণ্ঠ মানবতাবাদী এবং মানবাধিকারকর্মী মুহিবুল্লাহকে হত্যা করেছে।
সহজেই আমরা এটা বুঝতে পারি যে মুহিবুল্লাহ চেষ্টা করছিলেন ১১ লাখ রোহিঙ্গাকে দেশে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার। তিনি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোকে রাজি করবার কাজে নিয়োজিত ছিলেন। বেশ কয়েকটি সংস্থা, জাতিসংঘসহ বেশ কয়েকটি দেশের রাজনৈতিক নেতা ও রাষ্ট্রনায়ক মুহিবুল্লাহর যুক্তিগুলো অনুধাবন করতে পারছিলেন এবং তারা তাকে সাহায্য করতে সম্মত হয়েছিলেন। এই কারণেই কি তাকে হত্যা করা হয়েছে? নাকি আরো কিছু কারণ আছে? কারা আছে মুহিবুল্লাহ হত্যায় জড়িত? এ-প্রশ্ন দেশের সর্বত্র।
এর সঙ্গে আমরা যোগ করতে পারি স্বয়ং মিয়ানমারের সেই অপশক্তিকে, যারা রোসাঙ্গ বা আজকের রাখাইন প্রদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জনগোষ্ঠীকে হত্যা করে, ধর্ষণ, লুটপাট এবং বাড়িঘর পুড়িয়ে দিয়ে বাস্তুচ্যুত করেছে এবং বাংলাদেশের দিকে ভয়ার্ত রোহিঙ্গাদের ঠেলে দিয়েছে। তারাও তো শঙ্কিত হয়ে উঠেছিলো যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থার চাপে পড়ে মিয়ানমারের সরকারকে মানতে বাধ্য করবে যে, রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নাও এবং তাদের সাংবিধানিক অধিকার দাও। তখন মিয়ানমার যতোই চীনের তাপে থাকুক না কেন, সেই চাপ সহ্য করতে পারবে না। তারাই তাহলে পরিকল্পনা করে নিয়োগ করেছিলো রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের, যারা অস্ত্র, সোনা ও নানান মাদকের ব্যবসার সঙ্গে জড়িত কুতুপালংসহ সব রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে।
এটা বিভিন্ন সময় পত্রিকায় রিপোর্ট হয়েছে যে ওই ৩৪টি ক্যাম্পে ১২/১৪টি রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী গ্রুপ হত্যা, ধর্ষণ ও মাদকের ব্যবসাসহ সব কিছুর নিয়ন্ত্রক। বিশেষ করে রাতের বেলা নিয়ন্ত্রণ করে থাকে তারা। তারাই যে মুহিবুল্লাহ হত্যায় সরাসরি জড়িত, তা না বললেও সবাই বোঝে। কিন্তু গত কয়েকদিনের টিভি নিউজ শুনে একবারও কোনো তদন্তকারী বললেন না যে আমরা সন্ত্রাসীদের আটক করেছি। মুহিবুল্লাহর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন-প্রচেষ্টা সন্ত্রাসীদের স্বার্থে আঘাত হেনেছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। রোহিঙ্গাদের দেশে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারলে সন্ত্রাসীদের অবৈধ ও অনৈতিক ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাবে। এ-কারণে তারাও ক্ষিপ্ত ছিলো মুহিবুল্লাহর ওপর। ওই সন্ত্রাসীদের একজন বেশ কয়েকবারই মুহিবুল্লাহকে হত্যার হুমকি দিয়েছে। সেই হুমকিদাতা সন্ত্রাসী ‘ডাকাত হাকিম’ আল ইয়াকিন নামের একটি গ্রুপের লিডার। মুহিবুল্লাহর স্ত্রী নাসিমার [৪০] বিশ্বাস পরিকল্পিত এই হত্যার সঙ্গে ডাকাত হাকিম জড়িত।
উখিয়ার কুতুপালং শরণার্থী শিবিরে এখন কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা বলবৎ আছে। টিভির রিপোটিং-এ দেখেছি সেখানে তদন্তে রয়েছে পুলিশ, র্যাব, এপিবিএনসহ অনেক সংস্থা। এখন আর ওইখানে একটি মাছির পক্ষেও ভেতরে ঢোকা বা বের হওয়ার উপায় নেই। সবই এখন নিরাপত্তাবাহিনীর নখদর্পনে। সেই নখদর্পনে তারা একটি চিহ্নিত সন্ত্রাসীকেও দেখতে বা চিনতে পাচ্ছেন না। তাহলে কি ১২/১৪টি সক্রিয় সন্ত্রাসী মাদক চোরাচালানি বাহিনী গা-ঢাকা দিয়েছে। তা তারা করতেই পারে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে তারা গা-ঢাকা দিয়ে কোথায় যাবে? কোথায় পালাবে? তারা কি শিবিরগুলোর বাইরে [শিবিরগুলো কাটাতারে ঘেরা] চলে গেছে? যদি তাই সত্য হয়, তাহলে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা পুলিশ-র্যাবের চোখ এড়িয়ে কি তা সম্ভব? আর যদি তারা বাইরে চলে না গিয়ে থাকে, তাহলে তাদের সন্ধান কেন পাননি নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা সরকারি বাহিনীর সদস্যরা?
২৯ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যারাতে হত্যার শিকার হয়েছেন মুহিবুল্লাহ। এর মধ্যে ১২/১৩ দিন চলে গেছে। তদন্তকারীদের কাজের অগ্রগতি খুবই ভালো , শুধু সন্ত্রাসীদের আটক করা বাদে।। অগ্রগতি বলতে আমি বুঝাচ্ছি সন্ত্রাসীদের চিহ্নিত করা এবং তাদের ধরা। সন্ত্রাসীরা তো শিবিরেই আছে, অতএব ধরতে না পারার কোনো কারণ নেই। কিন্তু কেউ বলছেন না যে, ডাকাত হাকিমকে পাওয়া গেছে এবং তাকে আটক করা হয়েছে। আমার ধারণা, ওই সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোর যে কোনো এক সদস্যকে আটক করা গেলেই মুহিবুল্লাহ হত্যার জট খোলা সম্ভব। কিন্তু সেটা হচ্ছে না কেন?
এ-প্রশ্ন সঙ্গত কারণেই উঠে আসছে যে, তাহলে কি এই হত্যা রহস্য বের হচ্ছে না শিবিরের নিরাপত্তায় থাকা আইনশৃঙ্খলার লোকজনের কারণে? তারাই কি সন্ত্রাসীদের সহযোগী হিসেবে কাজ করছে? তাদেরকে নিরাপদে বের করে দিয়েছে কিংবা শিবিরেই আছে তারা। আর তারা আজ পুলিশের চোখে সন্ত্রাসী নয়, সাধারণ রোহিঙ্গা। তারা যদি অস্বীকার করে, তাহলে বলবো, সন্ত্রাসীরা কেন ধরা পড়ছে না, এর জবাব কি? সন্ত্রাসীদের পরিবার পরিজন শরণার্থী শিবিরেই বাস করে। তাদের আটক করলেও তারাই বলে দেবে, আসল ঘটনা কি? কেমন করে সন্ত্রাসীরা পালিয়েছে বা তারা কোথায় লুকিয়ে আছে। কারা সহযোগ দিয়েছে। তবে, সে তথ্য সংগ্রহ সেখানকার পুলিশ, র্যাব ও এপিবিএন দিয়ে হবে না। সম্পূর্ণ আলাদা তদন্ত কমিটির লোক দিয়ে ওই কাজ করলেই প্রকৃত সত্য বেরিয়ে আসবে। শিবিরগুলোতে দায়িত্বপ্রাপ্ত র্যাব-পুলিশ-এপিবিএন নিরাপত্তার দায়িত্ব থাকার পরও ১২/১৪টি সন্ত্রাসী গ্রুপ কি করে গড়ে উঠলো?
মিয়ানমার থেকে নিয়মিত ইয়াবার চালান আসছে, সোনা এবং ক্রিস্টাল আইসের মতো মারাত্মক মাদক আসছে, তারা কিছুই টের পেলো না। এর চেয়ে মিথ্যাচার আর কি হতে পারে? আসলে ওই সন্ত্রাসী চক্রের দোসর হয়ে উঠেছে পুলিশের লোকেরা। পুলিশের সততার বহু উদাহরণ আছে। সেই সঙ্গে আছে অসততারও উদাহরণ। ভালো ও মন্দের মিশ্রণে গড়ে ওঠা এই বাহিনীকে শুধরে তোলা গেলেই সমাজ থেকে অপরাধী ও সন্ত্রাসীচক্র দমন বা তাদের মূলোৎপাটন সম্ভব।
মুহিবুল্লাহ হত্যার চক্রান্ত বিদেশে হয়ে থাকুক বা বিদেশিদের চক্রান্তেই তাকে প্রাণ হারাতে হলো- এটা কোনো বাস্তবসম্মত কথা নয়। কারণ, ওই সব কথা অনুমান নির্ভর। অমনটা ঘটতেই পারে। বাস্তব হচ্ছে, সেই সব চক্রান্তের সুতো ধরে যারা খুন করেছে মুহিবুল্লাহকে, তারাই আসল খুনি। ওই খুনিরা উখিয়ার বা কক্সবাজারের শরণার্থী শিবিরেই আছে। তাদের চেনে ওই সব শিবিরের রোহিঙ্গা শরণার্থীরা। তারাই আসল খবর দিতে পারবে।
আমরা চাই মুহিবুল্লাহ হত্যার এই সূত্র ধরে বিদ্যমান সন্ত্রাসীদের শেকড়-বাকড় উৎপাটিত হোক। কারণ ওই সন্ত্রাসীদের মাদক চোরাচালানের সঙ্গে স্থানীয় রাজনীতিকরাও জড়িয়ে পড়েছে, এই অভিযোগ কেউ অস্বীকার করতে পারবে না। স্থানীয় প্রভাবশালী হচ্ছে ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীরা। অভিযোগ রয়েছে, ওই চোরাকারবারের সঙ্গে তারা জড়িত বলেই কোনো সন্ত্রাসী আটকের কোনো সংবাদ আমরা জানতে পারছি না। চেনা-জানা সন্ত্রাসীরাও আজ পুলিশের কাছে অচেনা। এই পরিস্থিতি থেকে সমাজকে উদ্ধার করতে হবে। কারণ, দেশের সামাজিক পরিস্থিতি নাজুকের শেষ প্রান্তে এসে পৌঁছেছে।সুত্র:জানি
লেখক : ডা.মাহবুব হাসান কবি, সাংবাদিক, কলামিস্ট।