একসময় বাংলাদেশ ছিল ভারত ও পাকিস্তানের চেয়ে দরিদ্র। কিন্তু এখন বিস্ময়কর সফলতা অর্জন করেছে বাংলাদেশ। ফলে এ দেশটির কাছ থেকে শিক্ষা নেয়ার অনেক কিছু আছে ভারত ও পাকিস্তানের। অনলাইন ব্লুমবার্গে প্রকাশিত ‘সাউথ এশিয়া শ্যুড পে এটেনশন টু ইটস স্ট্যান্ডআউট স্টার’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এসব কথা লিখেছেন মিহির শর্মা। এতে তিনি আরো লিখেছে, অর্ধ শতাব্দী আগে ১৯৭১ সালের মার্চে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধু শেষ মুজিবুর রহমান ধনী ও অধিক শক্তিধর পাকিস্তানের কাছ থেকে নিজের দেশের স্বাধীনতা ঘোষণা দিয়েছিলেন।
যুদ্ধ আর দুর্ভিক্ষের মধ্য দিয়ে জন্ম হয়েছে এই দেশটির। লাখ লাখ মানুষ পালিয়ে ভারতে গিয়েছিলেন অথবা পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তাদেরকে হত্যা করেছে। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে সমর্থন করেছিল আমেরিকা।
এতে দৃশ্যত মনে হয়েছিল নতুন এই দেশটি গন্তব্যে যেতে ব্যর্থ হবে। তখনকার মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার এই দেশটিকে তলাবিহীন ঝুড়ি বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। সংগ্রমরত দেশটির জন্য ইউনিসেফের ত্রাণকর্মে অর্থ যোগানের জন্য প্রচেষ্টা চালান জর্জ হ্যারিসন ও রবি শঙ্কর।
এ মাসে বাংলাদেশের মন্ত্রীপরিষদ সচিব সাংবাদিকদের বলেছেন যে, দেশে গত এক বছরে মাথাপিছু জাতীয় প্রবৃদ্ধি বা জিডিপি বৃদ্ধি পেয়েছে শতকরা ৯ ভাগ। তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২২২৭ ডলারে। পক্ষান্তরে পাকিস্তানে মাথাপিছু জাতীয় আয় ১৫৪৩ ডলার। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের তুলনায় শতকরা ৭০ ভাগ ধনী ছিল পাকিস্তান। আর আজ পাকিস্তানের চেয়ে শতকরা ৪৫ ভাগ ধনী বাংলাদেশ। একজন পাকিস্তানি অর্থনীতিবিদ বলেছেন, অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে আমাদেরকে ২০৩০ সালে বাংলাদেশের কাছ থেকে সাহায্য চাইতে হতে পারে।
ভারত সবসময় আস্থাশীল যে, তারাই দক্ষিণ এশিয়ার একমাত্র অর্থনীতির দেশ। কিন্তু তারা এখন সত্যের কাছে ঝাঁকুনি খেয়েছে। কারণ, ভারতও মাথাপিছু আয়ের দিক দিয়ে বাংলাদেশের চেয়ে গরিব। ভারতে ২০২০-২১ অর্থবছরে মাথাপিছু আয় ১৯৪৭ ডলার।
মিহির শর্মা আরও লিখেছেন, ভারত বাংলাদেশের সফলতা মেনে নেবে এটা আশা করে আপনি নিশ্বাস বন্ধ করে রাখবেন না। ভারতের ডানপন্থি ব্যক্তিত্বরা এটা নিয়ে আশ্বস্ত যে, বাংলাদেশ খুব অসহায়। কারণ, বাংলাদেশের অবৈধ অভিবাসীর বিস্তার ঘটেছে সীমান্তে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, ভারতের জাতীয়তাবাদী রাজনীতিকরা বাংলাদেশিদের বিরুদ্ধে ‘উইপোকা’ শব্দ ব্যবহার করেছেন। কিন্তু হতাশায় থাকা ভারতের অনেক রাজ্যের চেয়ে বাংলাদেশ অনেক ধনী। বিষয়টা এমন যেন কানাডার অবৈধ অভিবাসী নিয়ে মিসিসিপি বিরক্ত হয়ে পড়েছে।
সম্ভবত এতেই ব্যাখ্যা করা হয়েছে যে, জিডিপির সংখ্যা ঘোষণার পর ভারতের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ক্ষোভ আর প্রত্যাখ্যান বিস্ফোরণের মতো ছড়িয়ে পড়েছে। অন্যদিকে বাংলাদেশি মিডিয়া বিষয়টি নিয়ে তুলনা করেছে খুব কমই। এটা আসে আত্মনির্ভরশীলতা থেকে, যা আসে ক্রমাগত বৃদ্ধি থেকে।
বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে তিনটি স্তম্ভের ওপর। তা হলো- রপ্তানি, সামাজিক অগ্রগতি এবং অর্থনৈতিক দূরদর্শিতা। ২০১১ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত প্রতি বছরে বাংলাদেশের রপ্তানি বৃদ্ধি পেয়েছে শতকরা ৮.৬ ভাগ হারে। এক্ষেত্রে বিশ্বে গড় ছিল শতকরা ০.৪ ভাগ। বাংলাদেশে এই সফলতার বড় অংশ এসেছে দেশের উৎপাদন খাত, বিশেষ করে তৈরি পোশাক খাতে নিরলস দৃষ্টি দেয়ার ফলে। এতে তারা তুলনামূলক বেশি সুবিধা পেয়েছে।
ইতিমধ্যে ভারত ও পাকিস্তানের মতো না হয়ে শ্রমশক্তিতে বাংলাদেশি নারীদের অংশগ্রহণ অব্যাহতভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। ভারত ও পাকিস্তানে নারীদের এ খাতে অংশগ্রহণ কমেছে। বাংলাদেশ তার জনগণের ঋণ-টু-জিডিপির অনুপাত শতকরা ৩০ ভাগ থেকে ৪০ ভাগের মধ্যে ধরে রেখেছে। ভারত ও পাকিস্তান উভয় দেশই করোনার ভিতর দিয়ে চলছে এবং তারা জিডিপির তুলনায় জনগণের ঋণ শতকরা ৯০ ভাগের কাছে নিয়ে গেছে। আর্থিক সংযম বাংলাদেশের বেসরকারি খাতকে ঋণ নিতে এবং বিনিয়োগে আস্থা সৃষ্টি করেছে।
বাংলাদেশের সফলতাই তার নিজস্ব সমস্যাগুলোকে সামনে নিয়ে আসে। এক্ষেত্রে একটি বিষয় হলো, বিভিন্ন কৌশলে যেসব দেশে বাংলাদেশ রপ্তানি করে, তাদের কাছ থেকে রপ্তানিখাতে সুবিধা পায়। এর ফলে অর্থনীতিতে উন্নত দেশগুলোতে শুল্কমুক্ত সুবিধা পায় বাংলাদেশ। যেমন যুক্তরাষ্ট্রের জেনারেলাইজড সিস্টেম অব প্রিফারেন্সেস বা জিএসপি। এই গ্রুপগুলো শুধু বিশ্বের স্বল্পোন্নত দেশগুলোর জন্য উন্মুক্ত। কিন্তু প্রবৃদ্ধির কারণে, এই সুবিধা বাংলাদেশকে হয়তো ২০১৬ সাল বা এমন কোনো এক সময়ে ত্যাগ করতে হবে।
অর্থনৈতিক পরিপক্বতার কারণে, এ দেশটির তুলনামূলক এডভান্টেজও পরিবর্তন হবে। ভিয়েতনাম ও অন্যদের মতো তারাও তখন গার্মেন্টস রপ্তানি থেকে উচ্চমূল্যের পণ্য রপ্তানির দিকে ঘুরে দাঁড়াবে। এই পটপরিবর্তন হবে বাংলাদেশের পরীক্ষা যা, অন্য দেশগুলোর মতো।
আগামী এক দশকের জন্য একটি কৌশল প্রণয়ণ করা প্রয়োজন সরকারের। তাতে দৃষ্টি দিতে হবে বৈশ্বিক একত্রীকরণের নতুন ধরণের দিকে এবং অর্থনীতির অব্যাহত রূপান্তরের দিকে। এক্ষেত্রে সবচেয়ে স্মার্ট বিষয় হবে মুক্ত বাণিজ্যিক চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে উন্নত বিশ্বের বাজারের সুবিধা আদায় করা। বাংলাদেশি কর্মকর্তাদের মতে এসোসিয়েশন অব সাউথইস্ট এশিয়ান নেশন্স-এর সঙ্গে এফটিএ নিয়ে কাজ শুরু হয়ে গেছে। তবে এখনও অনেক কিছুই করার বাকি আছে।আরও একবার বলতে হচ্ছে, ভিয়েতনামের বিপক্ষে দাঁড়াতে হবে বাংলাদেশকে। ভিয়েতনাম শুধু চীনকেন্দ্রীক রিজিয়নাল কমপ্রিহেনসিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপের অংশই নয়, ট্রান্স প্যাসিফিক পার্টনারশিপের সফলতা অর্জনকারীই নয়, একই সঙ্গে তারা ২০১৯ সালে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সঙ্গে এফটিএ চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। বাংলাদেশের বাণিজ্যের শর্তগুলো পরিবর্তন সহজ কাজ হবে না। এজন্য এখনই এ বিষয়ে কাজ শুরু করা উচিত। বিশেষ করে ঢাকাকে তার সমঝোতার সক্ষমতা বাড়াতে হবে। এমনকি তাদের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে আত্মনিবেদিত বাণিজ্যিক মধ্যস্থতাকারীও নেই।