ট্রাম্প আগে থেকেই বলে আসছেন, নির্বাচনে পরাজিত হলে তিনি রায় মেনে নাও নিতে পারেন। প্রয়োজনে যেতে পারেন উচ্চ আদালতে। এজন্য প্রস্তুতিও নিয়েছেন। ফল বিলম্বিত হলেই জালিয়াতির অভিযোগ তোলার ইঙ্গিত দিয়ে রেখেছেন তিনি। এমন প্রেক্ষাপটে ডাকযোগে পাঠানো ব্যালট গ্রহণের সময়সীমা বাড়ানো নিয়ে আদালতের রায়ের কারণে নির্বাচনের পর আইনি লড়াইয়ের ঝুঁকি বেড়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিশেষ করে পেনসিলভানিয়া এবং আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ রাজ্য মিনেসোটায় নির্বাচনের ফল কাছাকাছি হলে তেমনটা ঘটতে পারে। ট্রাম্প ও তার রিপাবলিকান শিবির মেইল-ইন বা ডাকযোগে পাঠানো ব্যালট ভোট ৩ নভেম্বরের পর গ্রহণ করার ব্যাপারে আপত্তি করে আসছে। এ নিয়ে এরই মধ্যে একের পর এক মামলায় আদালতের শরণাপন্ন হয়েছে রিপাবলিকান এবং ডেমোক্র্যাট শিবির। ধারণা করা হচ্ছে, পেনসিলভানিয়ার ভোট নিয়ে এমন বিরোধ চাঙা হয়ে উঠতে পারে। এ রাজ্যের আগাম ভোটে ডেমোক্র্যাটরা এগিয়ে থাকবেন বলে জরিপে আভাস মিলেছে। তবে নির্বাচনের দিন কেন্দ্রে উপস্থিত হয়ে ভোট দেওয়া ভোটারদের মধ্যে ট্রাম্প এগিয়ে থাকলেই তিনি নিজেকে বিজয়ী ঘোষণা করে দিতে পারেন বলে আশঙ্কার কথা বলা হচ্ছে।
লস অ্যাঞ্জেলেসের একটি ল’ স্কুলের নির্বাচনী আইন বিষয়ের শিক্ষক জেসিকা লেভিনসন বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে বলেন, ‘যদি পেনসিলভানিয়া ও ফ্লোরিডায় ফলাফল সমান হয় বা ব্যবধান খুব সামান্যও হয়, তহলেই হয়তো আমরা প্রাণপণ আইনি লড়াইয়ে পড়ে যেতে পারি।’
ব্যালট নিয়ে এই আইনি লড়াইয়ের মতো ভোটের লড়াইও আদালত পর্যন্ত গড়ানোর আভাস আগেভাগেই দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। ইতোমধ্যে রক্ষণশীল বিচারকের সংখ্যা বাড়িয়ে সুপ্রিম কোর্টকে নিজের অনুকূলে রাখার বন্দোবস্ত করে রেখেছেন তিনি।
টেক্সাসের হিউস্টন এলাকায় ডেমোক্র্যাটদের প্রাধান্য দেখা গেছে এবারের নির্বাচন-পূর্ববর্তী জরিপে। করোনা মহামারির কারণে এসব এলাকায় এবার ‘ড্রাইভ থ্রো’ (গাড়ি চালিয়ে চালিয়ে ভোট দেওয়া) ভোটকেন্দ্রে ভোট গ্রহণ করা হয়েছে। এমন ভোট গ্রহণের পর ১ লাখ ২৭ হাজার ভোটকে গণনায় না আনার জন্য রিপাবলিকান পার্টির পক্ষ থেকে আদালতে আবেদন জানানো হয়। সোমবার টেক্সাসের এক ফেডারেল বিচারক রিপাবলিকান পার্টির সেই আবেদন বাতিল করে দিয়েছেন। আদালতের এ রায় রিপাবলিকানদের প্রয়াসের বিরুদ্ধে গিয়েছে। একই ধরনের আরেকটি মামলায় গতকাল আদালতের হস্তক্ষেপ করতে হয়েছে নেভাদা অঙ্গরাজ্যে। নেভাদার ক্লার্ক কাউন্টিতে আগাম ভোট গণনার ওপর আপত্তি উত্থাপন করে রিপাবলিকান পার্টির পক্ষ থেকে আদালতে আবেদন জানানো হয়। ভোটারদের স্বাক্ষর শনাক্ত করার সফটওয়্যার নিয়ে রিপাবলিকান পার্টি তাদের আপত্তির কথা জানায়। নেভাদার বিচারক রিপাবলিকান পার্টির এ আবেদনও বাতিল করে দিয়েছেন।
ভোট গ্রহণ শুরু হওয়ার অন্তত ১২ ঘণ্টা আগেই আইনযুদ্ধের পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। শেষ মুহূর্তেও ডোনাল্ড ট্রাম্প ও জো বাইডেন শিবিরের পক্ষ থেকে নির্বাচনি ফল নিয়ে তাদের বিরোধপূর্ণ অবস্থানের কথা জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। ট্রাম্পের প্রচারণা শিবির থেকে বলা হয়েছে, বাইডেন শিবির ভোটকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে চায়। বাইডেনের প্রচারণা শিবির থেকে বলা হয়েছে, সব ভোট গণনার আগে ডোনাল্ড ট্রাম্প কোনোভাবেই মঙ্গলবার রাতে নিজের বিজয় ঘোষণা করতে পারেন না। এদিকে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ডেপুটি প্রচারণা ব্যবস্থাপক জাস্টিন ক্লার্কের দাবি, ডেমোক্র্যাট পার্টি এখন ভয় পাচ্ছে। কারণ, সুইং স্টেটগুলোয় আগাম ভোটে জো বাইডেন যথেষ্ট এগিয়ে থাকার মতো ভোট পাননি। জাস্টিন ক্লার্ক বলেছেন, ডেমোক্র্যাট পার্টি জানে, সশরীরে ভোটে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এগিয়ে থাকবেন।
মার্কিন সুপ্রিম কোর্ট এখন পর্যন্ত নির্বাচন সংক্রান্ত মামলাগুলো হালকাভাবে নাড়াচাড়া করছে—তবে আগামী ৩ নভেম্বরের পর পরিস্থিতি বদলে যেতে পারে। প্রাক নির্বাচনি রায়গুলোতে সুপ্রিম কোর্ট মূলত স্থিতাবস্থা ধরে রেখেছে। তবে এসব সিদ্ধান্তের বিস্তারিত এবং সূক্ষ্ম বিষয়গুলো নির্বাচন সংক্রান্ত মামলার পরবর্তী প্রবাহতে বেশি রক্ষণশীল মনোভাবের ভিত্তি হিসেবে বিবেচিত হয়ে উঠতে পারে। প্রাক নির্বাচনি মামলার ক্ষেত্রে বিচারকেরা জটিল পথে হেঁটেছেন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তাদের মনোযোগ ছিল ডাক ব্যালট গ্রহণের সময়সীমা বাড়ানোর দিকে। চূড়ান্তভাবে তারা পেনসিলভানিয়া এবং নর্থ ক্যারোলিনায় ভোট গণনার সময় বাড়িয়েছেন, কিন্তু উইসকিনসনে তা প্রত্যাখ্যান করেছেন। উভয় রাজ্যেই ভোটগ্রহণের দিনের পরেও পৌঁছানো ডাক ভোট গণনা করবে, যদিও দুই রাজ্যের একটি করে আদালত বলেছেন, তা গণনা উচিত নয়।
রিপাবলিকানরা বলছে নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হলে এসব ব্যালট বিরোধের বিষয় হয়ে উঠবে। প্রাক-নির্বাচনি রায়ের বেশিরভাগই পূর্ণাঙ্গ নয়—এগুলোই সুপ্রিম কোর্টের সিদ্ধান্তের উদাহরণ হয়ে ওঠে। এসব পূর্ণাঙ্গ রায় স্পষ্ট এবং সরাসরি নির্বাচনের ওপর নির্ভর করবে, কিন্তু সেগুলো আইন এবং সাংবিধানিক ইস্যুতে স্পষ্ট কোনও জায়গায় পৌঁছাতে পারবে না। উদাহরণ হিসেবে পেনসিলভানিয়ায় আদালত সময়সীমা বাড়ানোর পক্ষে রায় দিয়েছেন, কিন্তু এই সময়সীমা বাড়ানো বৈধ কিনা সে বিষয়ে সুস্পষ্ট রায় দেননি। পেনসিলভানিয়ার ফলাফল নিয়ে বিরোধ হলে এটি পুনর্বিবেচনার ইস্যু হয়ে উঠতে পারে।
বাইডেনের প্রচার শিবিরের আইনি পরামর্শক বব বাউয়ার বলেছেন, ‘আদালত দেখিয়েছেন যে ভোটারদের ওপর নির্ভর করার মৌলিক ইস্যু খুবই স্পর্শকাতর।’ তিনি বলেন, কর্তৃপক্ষ যেভাবে বলেছে মানুষ যদি সেভাবে ভোট দেয় তাহলে আদালত বিপরীতমুখী অবস্থান নিয়ে হাজার হাজার ভোট বাতিল করে দেবে বলে মনে হয় না।
তবে নির্বাচন পরবর্তী মামলায় আদালত কঠোর পথ বেছে নিতে পারেন বলে চিন্তা করার ভালো কারণ আছে।
প্রাক নির্বাচনি কোনও মামলাতেই অংশ নেননি ট্রাম্প মনোনয়নে নতুন নিয়োগ পাওয়া বিচারপতি অ্যামি কোনি ব্যারেট। তবে নতুন বিতর্কে আদালতে পৌঁছালে তিনি সম্ভবত রক্ষণশীল বিচারপতিদের জোটকেই শক্তিশালী করবেন। প্রতিটি মামলাতেই রক্ষণশীল বিচারকেরা সময়সীমা বাড়ানোর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। বিচারপতি ক্লারেন্স থমাস, স্যামুয়েলস অ্যালিটো এবং নেইল গরসাচ সবাই পেনসিলভানিয়া এবং নর্থ ক্যারোলিনায় ভোটের পরে পৌঁছানো ব্যালট গণনা আটকাতে চেয়েছেন। উইসকিনসনের মামলায় রিচারপতি ব্রেপ কাভানাফ একটি দীর্ঘ চিঠিতে ডাক ভোটের সমালোচনা করেছেন। যাতে জোরালো ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে যে নির্বাচন পরবর্তী কোনও চ্যালেঞ্জ হলে তিন হয়তো নেতিবাচক মতামত দেবেন।
সূত্র: সিএনএন, রয়টার্স, ইক্সিওস, এনবিসি