কী প্রাণ ছিল এই বাড়িতে, জীবনের কী উচ্ছ্বাস ছিল, প্রাণের কী প্রাচুর্য ছিল সর্বত্র। এখনো চোখের সামনে ভেসে ওঠে বড় একটা চেয়ারে বসে থাকা দাদা ভাইয়ের সেই বলিষ্ঠ, শান্ত-সৌম্য চেহারা, রান্নাঘরে আগুনের তাপে দাদু আর মায়ের ঘর্মাক্ত শরীর, স্নেহভরা সেই হাসিমাখা মুখ। পুরো পৃথিবীর ভালোবাসা যেন উপচে পড়ত ওই চির প্রিয় দুইটি মুখে।
দাদা ভাই,দাদু,আম্মা,জেনি,বাবা ও চাচাদের ভালোবাসার ছোঁয়ায় স্নাত হতো প্রতিদিন, প্রতি মূহূর্ত। কোমল স্নেহ, স্নিগ্ধ ভালোবাসা আর পরম মমতায় ঘেরা ছিল আমাদের সেই পারিবারিক স্নেহনীড়(হোসেন মনজিল)আজ ইতিহাস হয়ে, স্মৃতিকাতরতায় ন্যুব্জ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে প্রিয়জনদের দূরে সরে যাওয়ার সমস্ত ব্যথা বুকে নিয়ে।
জীবনের নির্মল আনন্দ-উল্লাস, বন্ধুবাৎসল্য, মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা-ভালোবাসা, সম্প্রীতি, প্রতিবেশী প্রেম, আত্মীয়দের স্নেহ-মমতা, গুরুজনদের আশীর্বাদ—সবই এসেছে জীবনের অংশ হয়ে, অথচ সময়ের আবর্তনে হারিয়ে গেছে সেই অমূল্য সময়, ছেলেবেলার সেই সুন্দর জীবন। সুস্থ জীবনধারার বিশুদ্ধ বাতাস বইতো আমাদের সেই সময়ের পারিবারিক ও সামাজিক বলয়ে, কী গভীর ছিল আত্মার বন্ধন! ভাবতেই সমস্ত অনুভূতির সীমান্তে অনুভব করি এক অনির্বচনীয় শিহরণ—প্রশান্তির ছায়ায় পরিপ্লুত ছিল সেসব দিন, সেসব ক্ষণ।
আজ মনে হয় সেদিন যদিও আজকের মতো করে উপলব্ধি করার বোধ ছিল না, কিন্তু স্মৃতির দিগন্তে সেই দিনগুলো এখনো জীবন্ত, অনুভবে আজও সেই স্পর্শ! আমি হারিয়ে গিয়েছি সেই স্বর্গলোকে, যেখানে আমার জীবনের সমস্ত সুখ, শান্তি, আনন্দ ভালোবাসা, স্নেহ, অনুভব… আমার অস্তিত্ব, আমার হারিয়ে যাওয়া ছেলেবেলা।
হঠাৎ করে থেমে গেল সুরেলা কণ্ঠে কবিগুরুর হৃদয়স্পর্শী গান। সংবিৎ ফিরে পেয়ে চোখ খুলে তাকালাম, দেখি টিভির পর্দায় নির্বাক হয়ে আটকে আছে শিল্পীর স্থিরচিত্র…রেকর্ড করা অনুষ্ঠানটি শেষ হয়ে স্থিরচিত্রটি আটকে আছে, যেমন করে আমি এই মুহূর্তে আটকে আছি স্মৃতির ক্যানভাসে অদৃশ্য ছায়াচিত্রে। টিভির পর্দায় আটকে থাকা চিত্রটি এক মুহূর্তে দূর-নিয়ন্ত্রকে বোতাম টিপে মুছে ফেলা যায়!
কিন্তু স্মৃতিকে মুছে ফেলা কিছুতেই সম্ভব নয়, চাইলেও নয়, স্মৃতির মধ্যেই আমাদের অস্তিত্বের ফেলে আসা সময়ের ছায়াচিত্র।