জুমরাত দাউতের তিন সন্তানের জন্য শুক্রবার মানেই আতঙ্কের দিন। এই দিনটিতেই স্কুলে গিয়ে সরকারি কর্মকর্তাদের প্রশ্নের মুখে পড়তে হয় তাদের। তদন্তকারীরা শিশুদের কাছে তাদের বাড়ির বিষয়ে জানতে চান। ঘরে তাদের বাবা-মা নামাজ পড়েছেন কি না, হযরত মুহাম্মদ (স)-এর কোনও কথা বলা হয়েছে কি না এ নিয়ে প্রশ্ন করা হয় শিশুদের। কোনোটার জবাব হ্যাঁ হলেই পরিবারটিকে পাঠিয়ে দেয়া হবে তথাকথিত ‘ভোকেশনাল ট্রেনিং সেন্টার’-এ। চীনের জিনজিয়া অঞ্চলে উইঘুর মুসলিমদের সঙ্গে ঠিক এমন আচরণই করা হচ্ছে বলে এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে প্রভাবশালী ব্রিটিশ সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্ট।
জুমরাত দাউতের ভাষ্য অনুসারে, জিনজিয়াংয়ে উইঘুরদের সার্বক্ষণিক নজরদারিতে রাখা হয়। এতে বড়দের মতো ভুক্তভোগী হচ্ছে শিশুরাও। প্রতি সোমবার শিশুদের উঠানে নিয়ে চীনের জাতীয় পতাকা উত্তোলন দেখান বাবা-মায়েরা। সেটা তীব্র শীতই হোক বা কড়া রোদ্দুর, পতাকা দেখানো বাদ দেয়া যাবে না। সেটি দেখার সময় সবাইকে উৎফুল্ল থাকাও বাধ্যতামূলক। আবার, শুধু নিজেদের আচরণে খেয়াল রাখলে হবে না, নজর রাখতে হবে আশপাশের আরও ১০টি পরিবারের ওপর। কারও মধ্যে কোনও ধরনের অসন্তুষ্টির চিহ্ন দেখলেই জানাতে হবে সরকারি কর্মকর্তাদের।
দাউত জানান, তিনি গত বছর সন্তানদের দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র পাড়ি জমানোর আগে দুই মাস এধরনের একটি ক্যাম্পে বন্দি ছিলেন। তার অপরাধ ছিল পাকিস্তানে থাকা স্বামীর সঙ্গে ফোনে কথা বলা, কয়েক বছর আগে পাকিস্তান যাওয়া, এক বিদেশির (চীনে বসবাসকারী পারিবারিক বন্ধু) কাছ থেকে অর্থ নেয়া এবং মার্কিন ভিসা পাওয়া।
এ নারী জানান, তাকে এমন একটা কক্ষে রাখা হয়েছিল, যেখানে ভিড়ের কারণে একপাশ ফিরে ঘুমাতে হতো। সন্তানদের ভয় ছিল, প্রতি শুক্রবারের জিজ্ঞাসাবাদে ভুল কিছু বললেই তাকে হয়তো আবার ওই অবস্থায় ফিরে যেতে হতো।
ইকোনমিস্ট বলছে, গত তিন বছর ধরে জিনজিয়াংয়ের বন্দিশিবিরে অন্তত ১০ লাখ উইঘুর যে দুর্দশায় রয়েছে তা ব্যক্তিপর্যায়ে প্রমাণ করা একপ্রকার অসম্ভব। অঞ্চলটি পরিদর্শনে যাওয়া বিদেশি সাংবাদিকদের সারাক্ষণ নজরদারিতে রাখা হয়। ফলে তাদের সঙ্গে কথা বলা স্থানীয়দের জন্য বিপদের কারণ হতে পারে। এরপরও বেশকিছু সরকারি নথিপত্র ও প্রত্যক্ষদর্শীদের দেয়া প্রমাণে এটা নিশ্চিত যে, সেখানকার পরিস্থিতি নিয়ে জুমরাত দাউতের বক্তব্য শুধু বিশ্বাসযোগ্যই নয়, নিয়মিত ঘটনাও বটে।
এসব নথিতে দেখা গেছে, চীন সরকার কীভাবে উইঘুরদের স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিক পরিচয় এবং ইসলামিক বিশ্বাস মুছে ফেলার চেষ্টা করছে, সেখানে কীভাবে লাখ লাখ শিশু ভুক্তভোগী হচ্ছে। ইকোনমিস্টের কাছে এসব নথিপত্র দিয়েছেন আদ্রিয়ান জেনজ নামে এক জার্মান গবেষক।
উইঘুর শিশুদের দুরবস্থা বোঝাতে একটি বিশেষ পরিভাষা ব্যবহার করে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো। সরকারি শিবিরগুলোতে বাবা-মায়ের একজন বা উভয়কেই পাঠানো হয়েছে কিনা তার ওপর নির্ভর করে তাদের ডানকুন (একক-কষ্ট) বা শুয়াংকুন (দ্বিগুণ-কষ্ট) বলা হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জিনজিয়াংয়ের কাশগার অঞ্চলের ইয়ারকান্দ কাউন্টির নয় লাখ বাসিন্দার মধ্যে প্রায় এক লাখ শিশু রয়েছে, যাদের বয়স সাত থেকে বড়জোর ১২ বছর। ২০১৮ সালে এদের মধ্যে অন্তত সাড়ে নয় হাজার শিশু ডানকুন বা শুয়াংকুনে ছিল। এদের মধ্যে মাত্র ১১ জন বাদে সবাই উইঘুর জাতিগোষ্ঠীর, বাকি দু’জনও মুসলিম। সেখানে হান জাতিগোষ্ঠীর একজনকেও এধরনের ‘প্রশিক্ষণ শিবিরে’ নেয়া হয়নি।
চীন সরকার অবশ্য উইঘুর নির্যাতনের দাবি অস্বীকার করেছে। তাদের মতে, সরকার সেখানকার শিশুদের ‘তিন শয়তান’- সন্ত্রাস, বিভক্তিকরণ ও ধর্মীয় উগ্রবাদ থেকে রক্ষা করছে। ২০১৮ সালে হোতানের একটি ক্যাম্পকে ‘উদার প্রি-স্কুল’ হিসেবে উল্লেখ করেছিল রাষ্ট্রীয় সংবাদপত্র জিনজিয়াং ডেইলি। স্কুলটি পরিদর্শন করে কমিউনিস্ট পার্টির জিনজিয়াং শাখার উপ-প্রধান ঝু হাইলুন বলেছিলেন, সেখানে কিছু শিশু আছে যাদের বয়স এক বছরেরও কম। তাদের বাবা-মা বিভিন্ন কারণে সন্তানদের যত্ন নিতে পারেন না।
প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছিল, স্কুলটিতে বিনামূল্যে শিশুদের প্রয়োজনীয় সুবিধা দেয়া হচ্ছে। তাদের ওজন ও উচ্চতা বাড়ছে এবং তারা দ্রুত ম্যান্ডারিন ভাষা শিখছে।
সরকারপক্ষের দাবি, তাদের এ কর্মসূচিতে ভালো কাজ হচ্ছে। ২০১৭ সালে ক্যাম্প নির্মাণ কর্মসূচি শুরুর পর থেকে জিনজিয়াংয়ে আর কোনও সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটেনি। গত বছর তারা দাবি করেছিল, ক্যাম্পের সবাই গ্রাজুয়েট হয়ে উঠেছে।
তবে ভুক্তভোগী জুমরাত দাউদ জানিয়েছেন, বন্দিশিবিরের দুঃসহ স্মৃতি এখনও তাকে তাড়া করে বেড়ায়। প্রতিদিন তাকে আরও কয়েকজন নারীর সঙ্গে একটি ক্লাসরুমে হাজির করা হতো। সেখানে তাদের ‘শি জিনপিংয়ের ভাবনা’ পড়তে দেয়া হতো। ফেরার সময় নিরাপত্তারক্ষীরা জিজ্ঞেস করত, ‘ঈশ্বর বলে কেউ আছেন?’ জবাবে হ্যাঁ বললেই শুরু হতো মারধর। এরপর প্রশ্ন করা হতো ‘শি জিনপিং আছেন?’ অশ্রুসিক্ত চোখে এর জবাব দিতেন দাউত। ‘তারা বলত, তোমার ঈশ্বর তোমাকে এখান থেকে বের করতে পারবে না। কিন্তু জিনপিং তোমাদের জন্য অনেক কিছু করেছেন।’