এক সপ্তাহ আগে গত শনিবার বিকেলে দক্ষিণ-পূর্ব লন্ডনের এক পার্কের ভেতর খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল এক নারীর মৃতদেহ। পার্কের ভেতর দিয়ে হেঁটে যাওয়ার পর এক ব্যক্তি লাশটি দেখতে পান। সাথে সাথে বিষয়টি পুলিশকে জানানো হয়। তখনো কেউ জানে না, এই নারীর নাম, কী তার পরিচয়।
সোমবার হাতে গোনা কয়েকটি পত্রিকায় ভেতরের পাতায় ছোট্ট করে ছাপা হলো খবরটি। সাথে পুলিশের কাছ থেকে পাওয়া একটি ছবি। কালো গ্রাজুয়েশন গাউন পরে ক্যামেরার দিকে মৃদু হাসি নিয়ে তাকিয়ে থাকা এই মেয়েটির নাম সাবিনা নেসা।
পুলিশের তদন্তে এ পর্যন্ত যেসব তথ্য বেরিয়ে এসেছে, তাতে ধারণা করা হচ্ছে গত শুক্রবার সন্ধ্যায় কোন এক সময়ে সাবিনা নেসাকে হত্যা করা হয়েছিল। এরপর হত্যাকারী তার লাশটি ফেলে রেখেছিল পার্কে ঝোপঝাড়-ঘাসের আড়ালে। পরদিন বিকেলে পার্কের ভেতর দিয়ে হেঁটে যাওয়া এক ব্যক্তির নজরে আসার আগে পর্যন্ত সেখানেই পড়ে ছিল লাশটি।
এই হত্যাকাণ্ডের মিডিয়া কভারেজ, রাস্তাঘাটে নারীর নিরাপত্তাহীনতা- এসব নিয়ে ব্রিটেনে এখন চলছে তুমুল বিতর্ক। ব্রিটেনে কোন শ্বেতাঙ্গ নারী যখন একই ধরণের ঘটনার শিকার হন, তখন ব্রিটিশ মিডিয়ায় সাথে সাথে সেটি নিয়ে যেভাবে ফলাও করে খবর প্রচার হয়, সাবিনা নেসা সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠীর মানুষ হওয়ায় সেটি দেখা যায়নি বলে তীব্র সমালোচনা চলছে সোশ্যাল মিডিয়ায়।গত কয়েকদিন ধরে অবশ্য ব্রিটিশ গণমাধ্যমের শিরোনাম দখল করে আছে সাবিনা নেসার হত্যাকাণ্ড। তবে এই ঘটনার কভারেজ নিয়ে বিতর্ক এবং নারীর নিরাপত্তা-হীনতা নিয়ে ক্ষোভ এখনো থামেনি।
দক্ষিণ লন্ডনের এক স্কুলের শিক্ষক ছিলেন সাবিনা নেসা। ২৮ বছর বয়সী এই ব্রিটিশ-বাংলাদেশি পড়াশোনা করেছেন গ্রিনিচ বিশ্ববিদ্যালয়ে। তার স্কুলের প্রধান শিক্ষক সাবিনা নেসাকে একজন “মেধাবী, দয়ালু এবং নিবেদিতপ্রাণ” শিক্ষক বলে বর্ণনা করেছেন।
সাবিনা নেসার পৈতৃক বাড়ি বাংলাদেশের সুনামগঞ্জ জেলার জগন্নাথপুর উপজেলায়। যুক্তরাজ্যের বেডফোর্ডশায়ারের একটি ছোট্ট শহরে স্যান্ডিতে থাকেন তার পরিবার। বাবা আবদুর রউফ কাজ করেন স্যান্ডির একটি রেস্টুরেন্টে।
পুলিশ এবং ঘনিষ্ঠজনদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, সাবিনা নেসা শুক্রবার সন্ধ্যায় তার বাড়ি থেকে বেরিয়ে পার্কের ভেতর দিয়ে পায়ে হেঁটে খুব কাছেই এক বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছিলেন। পুলিশের ধারণা বাড়ি থেকে মাত্র পাঁচ মিনিটের দূরত্বেই হয়তো তাকে হত্যা করা হয়েছে।
হত্যাকারিকে এখনও সনাক্ত করা যায়নি:
এই হত্যাকাণ্ডের রহস্য এখনো অনুদঘাটিত, হত্যাকারী এখনো ধরা পড়েনি। পুলিশ এপর্যন্ত কয়েক জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছ। একজন সন্দেহভাজনকে হন্যে হয়ে খুঁজছে।
পুলিশের তদন্ত যেভাবে আগাচ্ছে এবং যেসব তথ্য এখনো পর্যন্ত পাওয়া গেছে, তাতে ধারণা করা হচ্ছে কোন অপরিচিত ব্যক্তির হাতেই হয়তো খুন হয়েছেন সাবিনা নেসা।
লন্ডনের মেট্রোপলিটন পুলিশ একটি সিসিটিভি ফুটেজ প্রকাশ করেছে, যাতে একজন টাক মাথার পুরুষকে হাতে কিছু একটা নিয়ে হেঁটে যেতে দেখা যাচ্ছে। পুলিশ মনে করছে সাবিনা নেসা হত্যা রহস্য উদঘাটনে এই ব্যক্তি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
ভিডিও ফুটেজের এই লোকটির পরণে ধূসর রঙের জিন্স এবং কালো জ্যাকেট। ফুটপাথ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় তাকে মাথায় হুড টেনে দিতে দেখা যায়।
সাবিনা নেসা হত্যাকাণ্ডের খবর ব্রিটিশ মিডিয়ায় শুরুতে অতটা গুরুত্ব পায়নি বলে তীব্র সমালোচনা চলছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। এক্ষেত্রে তার হত্যাকাণ্ডের খবরকে তুলনা করা হচ্ছে কয়েক মাস আগে লন্ডনে একই ধরণের ঘটনার শিকার হওয়া এক শ্বেতাঙ্গ নারী সারা এভারার্ডের হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে।
সারা এভারার্ড নিহত হন এ বছরের মার্চে দক্ষিণ লন্ডনে। তিনিও সেদিন পায়ে হেঁটে বাড়ি ফিরছিলেন রাতে, পথে তাকে অপহরণ করে এক পুলিশ, পরে তার লাশ পাওয়া যায় একটি পার্কে।
তার হত্যাকাণ্ড ব্রিটেনকে প্রচণ্ডভাবে নাড়া দেয়, দিনের পর দিন এই হত্যাকাণ্ডের খবর ব্রিটিশ গণমাধ্যমের শিরোনাম দখল করে রেখেছিল। এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে এবং ঘরের বাইরে নারীর নিরাপত্তার দাবিতে যে বড় বড় বিক্ষোভ হয়, তাতে এমনটি ব্রিটিশ রাজপরিবারের সদস্য ডাচেস অব কেমব্রিজ কেট মিডলটনও যোগ দিয়েছিলেন।
কিন্তু সাবিনা নেসার হত্যাকাণ্ডের পর অন্তত প্রথম কয়েকদিন সেধরণের কভারেজ দেখা যায়নি বলে অনেকে অভিযোগ করছেন।
লন্ডনের টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলের একজন কাউন্সিলর রাবিনা খান বিবিসি রেডিও ফোরের টুডে অনুষ্ঠানে এক সাক্ষাৎকারে বলেন, সোশ্যাল মিডিয়ায় এমন অনেক পোস্ট তিনি দেখেছেন, যেখানে অনেকে প্রশ্ন করছেন, একজন অশ্বেতাঙ্গ নারী বা সংখ্যালঘু নারী যদি সারা এভারার্ডের মতো নিখোঁজ হয়ে যান, তিনি কি আসলে মিডিয়ায় একই ধরণের মনোযোগ পাবেন?
সাবিনা নেসার হত্যাকাণ্ডের পর ব্রিটিশ-বাংলাদেশি কমিউনিটিতে ঘরের বাইরে নারীর চলাফেরার স্বাধীনতা সংকুচিত করার চেষ্টা করা হতে পারে, এমন আশংকা করেন কেউ কেউ।
কিন্তু সৈয়দা সায়মা আহমেদ বলছেন, এটি কোন সমাধান নয়।
“আমাদেরকে ভাবতে হবে, মেয়েদেরকে আটকে রেখে নয়, বরং যারা নারীকে আক্রমণ করছে, যারা নিপীড়নকারী, তাদেরকে কীভাবে শিক্ষা দেয়া যায়, সেটাই বরং ভাবতে হবে। এখানে দরকার নারীর ব্যাপারে মানসিকতার পরিবর্তন, সাংস্কৃতিক পরিবর্তন। বিবিসি