তালেবান বাহিনী উত্তর আফগানিস্তানের তিনটি জেলা পুনরায় দখল করেছে, যেগুলো গত সপ্তাহে স্থানীয় মিলিশিয়া গোষ্ঠীর হাতে পড়ে। গতকাল তালেবানের এক মুখপাত্র এ তথ্য জানিয়েছেন। জেলা তিনটি হচ্ছে বাঘলান প্রদেশের বনো, দেহ সালেহ এবং পুল-ই-হেসার। এছাড়াও পাঞ্জশির উপত্যকা অবরোধ করে রেখেছে তারা। বিদেশী বাহিনী প্রত্যাহারের নির্ধারিত সময়সীমা ৩১ আগস্টের পর আফগানিস্তানে অবস্থানের ব্যাপারে কেঠোর হুশিয়ারি উচ্চারণ করেছে তালেবান।
তালেবান নেতারা বলেন, নির্ধারিত সময়সীমার পর অবস্থান করা মানে আগ্রাসনকে দীর্ঘায়িত করা। কাবুল বিমানবন্দরে গোলাগুলিতে আফগান নিরাপত্তা বাহিনীর ১ জন সদস্য নিহত হয়েছে। এ গোলাগুলিতে মার্কিন ও জার্মান সেনারাও জড়িত বলে জানা গেছে।
তালেবানরা গত ১৫ আগস্ট রাজধানী কাবুল দখল করার পর স্থানীয় মিলিশিয়া গোষ্ঠীগুলো পাঞ্জশিরে কয়েকটি জেলা দখল করে নেয়। একে তালেবানদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধের প্রথম লক্ষণ হিসাবে দেখা হচ্ছিল। তালেবান বাহিনী জেলাগুলো দখল করে ফেলেছে এবং নিকটবর্তী বাদাখশান, তাখার এবং আন্দরে অবস্থান নিয়ে পাঞ্জশির উপত্যকা অবরোধ করে রেখেছে। গতকাল তালেবানের মুখপাত্র জবিউল্লাহ মুজাহিদ টুইটারে এই তথ্য জানান। সোভিয়েত বিরোধী মুজাহিদীন কমান্ডার আহমদ শাহ মাসুদের পুত্র আহমদ মাসুদের অনুগত বাহিনী, কাবুলের উত্তর-পশ্চিমে একটি পাহাড়ি এলাকা পাঞ্জশির উপত্যকায় নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছে, যা ২০০১ সালের আগে তালেবানদের প্রতিরোধ করেছিল। মাসুদের বাহিনীতে নিয়মিত সেনাবাহিনী এবং বিশেষ বাহিনীর ইউনিট রয়েছে। তিনি আফগানিস্তানের জন্য একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক সরকার গঠনের জন্য আলোচনার আহ্বান জানিয়েছে কিন্তু তালেবান বাহিনী উপত্যকায় প্রবেশের চেষ্টা করলে প্রতিহত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
এর আগে রোববার রাতে তালেবানের আলেমারা তথ্য সার্ভিস জানিয়েছে যে, শত শত যোদ্ধা পাঞ্জশিরের দিকে যাচ্ছে কিন্তু তাৎক্ষণিকভাবে কোন যুদ্ধের বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যায়নি। জবিহুল্লাহ মুজাহিদ বলেন, দক্ষিণ আফগানিস্তান থেকে উত্তরে চলা প্রধান মহাসড়কের সালং পাস খোলা ছিল এবং শত্রু বাহিনী পাঞ্জশির উপত্যকায় অবরুদ্ধ ছিল। কিন্তু তার বক্তব্য থেকে বোঝা যায় যে, সেই মুহূর্তে কোন লড়াই নেই। তিনি বলেন, ‘ইসলামী আমিরাত শান্তিপূর্ণভাবে সমস্যার সমাধান করার চেষ্টা করছে।’
মাসুদের ঘনিষ্ঠরা বলছেন, উপত্যকায় ৬ হাজারেরও বেশি যোদ্ধা জড়ো হয়েছে। তাদের কিছু হেলিকপ্টার এবং সামরিক যান রয়েছে এবং সোভিয়েতদের রেখে যাওয়া কিছু সাঁজোয়া যানও তারা মেরামত করে নিয়েছে। তাদের সংগৃহীত শক্তি তালেবানদের দ্রুত বিজয়কে সুসংহত করতে শুরু করার সময় যেসব সমস্যার সম্মুখীন হতে পারে সেগুলোকে তুলে ধরে। তবে পশ্চিমা কূটনীতিক এবং বিশ্লেষকরা পাঞ্জশিরের গোষ্ঠীর বাহ্যিক সহায়তার অভাব এবং অস্ত্র মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণের প্রয়োজনের কারণে কার্যকর প্রতিরোধ গড়ে তোলার ক্ষমতা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন।
এদিকে তালেবান জানিয়েছে, তারা পশ্চিমা দেশগুলোকে তাদের নাগরিকদের উদ্ধার অভিযান চালাতে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত যে সময়সীমা বেঁধে দিয়েছিল, সেটি আর বাড়ানো হবে না। তালেবানের মুখপাত্র সুহাইল শাহীন বলেছেন, এ সময়সীমা লঙ্ঘনের কোন সুযোগ নেই। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বাইডেন কথা দিয়েছিলেন ৩১ আগস্টের মধ্যে সৈন্যদের ফিরিয়ে নেয়া হবে। যদি এরপরও মার্কিন সৈন্যরা আফগানিস্তানে থেকে যায়, তার মানে হচ্ছে আফগানিস্তানে তাদের দখলদারিত্বের সময় আরও বাড়ানো। যদি এই সিদ্ধান্তের কোন পরিবর্তন হয়, তাহলে এর পরিণাম সম্পর্কে তিনি যুক্তরাষ্ট্রকে হুঁশিয়ার করে দেন।
ওদিকে কাবুল থেকে সরিয়ে আনার সময়সীমা যাতে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ৩১ আগস্টের পরও বৃদ্ধি করেন তার জন্য ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন জি-৭ বৈঠককে ব্যবহার করবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। এ বৈঠক আজ অনুষ্ঠিত হতে পারে । কিন্তু যুক্তরাজ্যের প্রতিরক্ষামন্ত্রী স্বীকার করেন যে, তালেবানরা মাসের শেষের পরেও উদ্ধার প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে নাও দিতে পারে। সোমবার সশস্ত্র বাহিনীর মন্ত্রী জেমস হ্যাপী বলেন, ‘আমরা আমেরিকানদের সাথে এ বিষয়ে আলোচনা করছি। এটা শুধু ওয়াশিংটনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার বিষয় নয়, তালেবানেরও সমর্থন প্রয়োজন।
মন্ত্রী স্কাই নিউজকে বলেছেন: ‘আমি মনে করি, এটা নিশ্চিত নয় যে, তালেবানরা আন্তর্জাতিক স¤প্রদায়কে মাস শেষের পরও সময়সীমা বাড়ানোর অনুমতি দিতে ইচ্ছুক হবে’। তালেবানরা এখন পর্যন্ত সরিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে ‘কার্যকর অংশীদার’ ছিল বলে স্বীকার করে মন্ত্রী হ্যাপী তালেবানদের ফ্লাইট পরিচালনা অব্যাহত রাখার অনুমতি দিয়ে ‘তারা যে আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার একটি অংশ হতে চান’ তা দেখানোর আহ্বান জানান।
সশস্ত্র বাহিনীর মন্ত্রীও স্বীকার করেছেন যে, একটি ‘কঠিন বাস্তবতা’ আছে যে, যুক্তরাজ্য কাবুল বিমানবন্দর থেকে প্রত্যাশিত সব শরণার্থীকে সরিয়ে নিতে পারবে না।
অপরদিকে কাবুল বিমানবন্দরের একটি প্রবেশ পথে অজ্ঞাতপরিচয় বন্দুকধারী এবং নিরাপত্তা বাহিনীর মধ্যে গোলাগুলি শুরু হয়েছে বলে জানিয়েছেন জার্মান সামরিক কর্মকর্তারা। এ গোলাগুলির সময় একজন আফগান রক্ষী নিহত এবং অপর তিনজন আহত হন। বলা হচ্ছে, জার্মান এবং মার্কিন বাহিনীও এই ঘটনায় জড়িত ছিল। কীভাবে এই গোলাগুলি শুরু হয়েছিল তা এখনো পরিস্কার নয়।
বিমানবন্দরে এখন যে আফগান বাহিনী রয়েছে, তারা একটি সামরিক ইউনিটের অংশ। এ ইউনিটটি তালেবানের কাছে আত্মসমর্পণে অস্বীকৃতি জানায় এবং তারা বিমানবন্দরে আন্তর্জাতিক বাহিনীকে সহায়তা করছে।
তালেবান কাবুলের নিয়ন্ত্রণ নেয়ার পর গত এক সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে কাবুল বিমানবন্দরে চরম বিশৃঙ্খলা চলছে। হাজার হাজার আফগান এবং পশ্চিমা নাগরিক মরিয়া হয়ে আফগানিস্তান ছেড়ে পালানোর চেষ্টা করছেন। বিমানবন্দরের নিরাপত্তা পরিস্থিতির অবনতির পর মাত্র গত রোববারই যুক্তরাষ্ট্র তার নাগরিকদের পরামর্শ দিয়েছিল সেখানে না যাওয়ার জন্য। যুক্তরাষ্ট্র কাবুল বিমানবন্দরে জঙ্গি হামলার আশঙ্কা আছে বলে তারা মনে করছে। সূত্র : বিবিসি, ডন, এক্সপ্রেস ট্রিবিউন।