৯০ বছর বয়সেও থামার লক্ষণ নেই মিডিয়া মোগল রুপার্ট মারডকের। কোভিডের মধ্যেও জন্মদিন উদ্যাপন করেছেন ১১ মার্চ। এ ছাড়া সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুককে তাঁর সংবাদ প্রতিবেদন শেয়ার করার জন্য অর্থ দিতে বাধ্য করেছেন তিনি।
তবে বয়স হচ্ছে, ক্ষমতা পরবর্তী প্রজন্মের হাতে হস্তান্তর করতে হবে। সেই প্রস্তুতিও তিনি নিতে শুরু করেছেন বলে জানা গেছে। তবে এর মধ্যে আবার আকাশে নতুন মেঘের ঘনঘটা। কেবল টেলিভিশনের বাজার দ্রুত পড়ছে। চলমান এক মামলার বিরুদ্ধে গেলে বড় ধরনের ঝাঁকুনি খাবে তাঁর সাম্রাজ্য। প্রতিদ্বন্দ্বী নেটওয়ার্ক এইচবিওর সঙ্গে বিবাদ, উত্তরাধিকার নিয়ে ঝামেলা—এসব তো আছেই। ফলে এই বিশাল সাম্রাজ্য তাঁর অনুপস্থিতিতে এক না–ও থাকতে পারে বলে আশঙ্কা। সবচেয়ে বড় কথা হলো, মারডকের সব সন্তান তাঁর মতো করে ভাবেন, ওয়াকিবহাল মহল তেমনটা মনে করেন না। দ্য ইকোনমিস্ট–এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ক্ষমতা হস্তান্তর হলেই ভাঙনপ্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হবে। চার সন্তানের মধ্যে কেই–বা সেই সিদ্ধান্ত নেবে। মারডকের ছেলে লাকলান ইতিমধ্যে ফক্স টেলিভিশনের প্রধান নির্বাহী এবং নিউজ করপোরেশনের সহ-চেয়ারম্যান। ফক্স টেলিভিশনে তিনি বিজ্ঞাপনভিত্তিক স্ট্রিমিং সার্ভিস, ক্রীড়াবিষয়ক বেটিং ও ক্রেডিট স্কোরিং এজেন্সি চালু করার চেষ্টা করছেন। কিন্তু এগুলোর কোনোটি সংবাদ ব্যবসার মূল দিকের সঙ্গে জড়িত নয়। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করেন, পরিবারের সম্পদ হ্রাসে তিনি আগ্রহী হবেন না। বিশেষ করে অস্ট্রেলিয়ার সম্পদ ছাড়তে তিনি রাজি হবেন না (মারডক জাতিগতভাবে একজন অজি), কারণ অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে তাঁর গভীর সংযোগ।তবে লাকলান যা চাইবেন, তাই হয়ে যাবে, এমন সম্ভাবনা কম বলে মনে করেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। রুপার্টের মৃত্যুর পর পরিবারের ট্রাস্ট চলে যাবে মারডকের চার জ্যেষ্ঠ সন্তানের হাতে। তাঁদের মধ্যে একজন জেমস বাবার মতো ডানপন্থী লাইনে পত্রিকা চালাতে চান না। এ ছাড়া পারিবারিক ব্যবসায় তাঁর বিশেষ আগ্রহ নেই। রুপার্টের আরেক সন্তান এলিজাবেথ মনে করেন, উদ্দেশ্যবিহীন মুনাফা করা সংবাদপত্রের কাজ নয়। তিনি এর বিপদ নিয়ে সতর্ক করে গেছেন। রুপার্টের আরেক সন্তান প্রুডেন্স সাধারণ অন্তরালে থাকেন। সে জন্য ওয়াকিবহাল মহল মনে করছে, তাঁরা ফক্স ও নিউজ করপোরেশনের চরিত্র পাল্টে দিতে পারেন।
অন্যান্য গণমাধ্যমের মতো মারডকের মিডিয়া সাম্রাজ্যও নানা সমস্যা মোকাবিলা করছে। বিশেষ করে অনলাইনে বিজ্ঞাপন চলে যাওয়া তার জন্য বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাঁর এই মিডিয়া সাম্রাজ্য এত বড় হয়ে উঠেছিল যে তারা ১০ বছর আগে বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম বিজ্ঞাপনদাতা ছিল। কিন্তু এখন তারা শীর্ষ দশেও নেই। তবে উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হলো, ফক্স টেলিভিশনের চেয়ে মারডকের সংবাদপত্রগুলো বরং ডিজিটালাইজেশনে এগিয়ে আছে। ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল–এর প্রচারসংখ্যার তিন-চতুর্থাংশই অনলাইন। এমনকি নিউইয়র্ক পোস্ট–এর মতো চিরকাল অলাভজনক ট্যাবলয়েড ২০২০ সালের শেষ প্রান্তিকে কিছুটা মুনাফা করেছে। এদিকে সম্প্রতি অস্ট্রেলীয় সরকারের সঙ্গে গুগলের যে রাজস্ব ভাগাভাগির চুক্তি হয়েছে, তার পেছনেও ছিল নিউজ করপোরেশনের মালিকানাধীন পত্রিকাগুলো। তবে নিউজ করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী রবার্ট টমসন বলেছেন, ‘বাণিজ্যের শর্তগুলো মৌলিকভাবে বদলে যাচ্ছে।’ মহামারির কারণে যেন যুক্তরাষ্ট্রে কেবল টেলিভিশনের বিদায়ঘণ্টা দ্রুতলয়ে বাজতে শুরু করেছে। গত বছর দেশটিতে কেবল টেলিভিশনের দর্শক কমেছে ৭ দশমিক ৩ শতাংশ—গত ৩০ বছরে যেটা আর কখনো ঘটেনি। স্ট্রিমিং সাইটগুলোর দৌরাত্ম্যে টেলিভিশন খেই হারিয়ে ফেলছে। ফক্স টেলিভিশন গত বছর যে ২৮০ কোটি ডলার পরিচালন মুনাফা করেছে, তার মূল উৎস হচ্ছে সংবাদ ও খেলাধুলা, স্ট্রিমিং সাইটগুলো এখনো যেখানে হাত দেয়নি। অর্থাৎ বিনোদন চলে যাচ্ছে স্ট্রিমিং সাইটগুলোর হাতে। তবে এর মধ্যেও ব্যাপার আছে—কেবল টেলিভিশনের ব্যবসা করতে তাকে এখন ৩০ শতাংশ ছাড় দিতে হচ্ছে।
ফক্সের আয়ের ৮০ শতাংশ আসছে সংবাদ থেকে। কিন্তু সেই জগৎও কণ্টকমুক্ত নয়। ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে সখ্যের কারণে বিজ্ঞাপনদাতা ও বিনিয়োগকারীরা তার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। এ পরিস্থিতিতে ফক্স ট্রাম্পের কাছ থেকে কিছুটা সরে এলেও অতি ডানপন্থী দর্শকেরা নিউজম্যাক্স ও ওয়ান আমেরিকা নিউজের মতো ভুঁইফোঁড় সংবাদমাধ্যমের দিকে ঝুঁকে পড়ছে। প্রাইম টাইমে ফক্স নিউজ এখনো এক নম্বর হলেও ফেব্রুয়ারি মাসে দর্শক কমেছে ৩০ শতাংশ। যেখানে সিএনএন ও এমএসএনবিসির দর্শক বেড়েছে ৬১ ও ২৩ শতাংশ।
এখন কথা হচ্ছে, রুপার্ট মারডকের কোম্পানির ভবিষ্যৎ নিছক বাণিজ্যিক যুক্তি নয়, পারিবারিক রাজনীতি দিয়ে নির্ধারিত হয়। এই পরিবারের সম্পদ যত না অর্থনৈতিক, ততটাই রাজনৈতিক। মারডক সাম্রাজ্যের উদ্দেশ্য ছিল টাকা বানানোর পাশাপাশি রাজনৈতিক ক্ষমতাও লাভ করা, যতটা পারা যায়। ফক্স নিউজের উদ্দেশ্যে কী, সাবেক কোনো নির্বাহীকে এই প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করা হলে নিশ্চিতভাবে বলবেন, ‘রাজনৈতিক বিবাদ উসকে দেওয়া।’