জমি লিখে না দেওয়ায় ৮০ বছর বয়সী মাকে নির্যাতন করে দুই হাত ভেঙে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে ব্যাংক কর্মকর্তা ছেলের বিরুদ্ধে। হাত-পা মাথাসহ ওই মায়ের শরীরের সব জায়গায় আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। এ ঘটনায় অভিযুক্ত ছেলেকে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। মঙ্গলবার (৩ মে) দিনাজপুর শহরের বড়বন্দর নতুনপাড়া মহল্লায় ঘটনাটি ঘটে।
নির্যাতনের শিকার মা রেজিয়া খাতুন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষিকা। তিনি বড়বন্দর নতুনপাড়া মহল্লার মৃত বাহার আলীর স্ত্রী। স্বামী বাহার দিনাজপুর জিলা স্কুলের সহকারী প্রধান শিক্ষক ছিলেন। নির্যাতনকারী ছেলে মো. রাজীব আলী ডন একটি বেসরকারি ব্যাংকের সিনিয়র অফিসার।
মামলা, ভুক্তভোগী এবং স্বজনদের দেওয়া তথ্যে জানা যায়, রেজিয়া বেগমের দুই ছেলে ও দুই মেয়ের মধ্যে বড় ছেলে মারা গেছেন। স্বামীও মারা গেছেন অনেক আগে। মেয়েদের বিয়ে হয়ে গেছে। ছোট ছেলে মো. রাজীব আলী ডন ব্যাংক কর্মকর্তা। ছোট ছেলে ও বড় ছেলের রেখে যাওয়া এক সন্তানকে নিয়ে বড়বন্দর নতুনপাড়ায় থাকেন তিনি। বেশ কিছুদিন থেকে রাজীব মায়ের কাছে বসতবাড়ির ১৬ শতাংশ জমি লিখে নিতে চাচ্ছিলেন। কিন্তু মা তাতে রাজি হচ্ছিলেন না।
একসময় রাজীব বিভিন্নভাবে নির্যাতন শুরু করলে মা বাধ্য হয়ে তাকে তিন শতাংশ জমি লিখে দেন। এতেও মন ভরেনি তার। বাকি জমি লিখে না দেওয়ায় নির্যাতনের মাত্রা বেড়ে যায়। গত ১৯ রমজান মাকে আবারও নির্যাতন করেন রাজীব। সেদিন পরিবারের লোকজন ও স্থানীয়দের সমঝোতায় ছাড়া পান তিনি।
বিজ্ঞাপন
পরে গত মঙ্গলবার রাত ৮টার দিকে রাজীব ও তার স্ত্রী খালেদা ওই বৃদ্ধাকে বাকি জমি লিখে দিতে চাপ দেন। এতে রাজি না হওয়ায় ছেলে ও তার স্ত্রী বৃদ্ধার ওপর অমানবিক নির্যাতন শুরু করেন। যে লাঠির ওপর ভর করে তার মা চলাফেরা করেন, সেই লাঠি কেড়ে নিয়ে ও লোহার রড দিয়ে মাকে নির্যাতন শুরু করেন ছেলে। লাথি মেরে মাকে মেঝেতে ফেলে দেন। মায়ের শরীরের এমন কোনো জায়গা নেই যেখানে আঘাত করেননি। নির্যাতন সইতে না পেরে মা বাড়ি থেকে পালিয়ে যাওয়ার জন্য বেরিয়ে আসলে আবারও টেনেহিঁচড়ে বাড়িতে নিয়ে নির্যাতন করেন ছেলে ও তার স্ত্রী। এসময় ওই বৃদ্ধার দুই হাত ভেঙে যায়। মাথায় আঘাত পান, পায়ে তৈরি হয় আঘাতের ক্ষত। ছেলের স্ত্রী খালেদা বেগম বুকের ওপর চেপে বসে গলা চেপে ধরেন। এসময় বড় ছেলের রেখে যাওয়া সন্তান লিমন ফুফুদের খবর দিলে তারা এসে মাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করেন।
বৃহস্পতিবার (৫ মার্চ) বিকেলে বিষয়টি জানতে পেরে দিনাজপুর মেডিকেল কলেজ হাসাপাতালে যান জাগো নিউজের প্রতিবেদক। সেখানে গিয়ে অপারেশন থিয়েটারের সামনে দুই হাতে প্লাস্টার করার জন্য দুই মেয়েকে নিয়ে অপেক্ষা করতে দেখা যায় রেজিয়া বেগমকে।
এসময় রেজিয়া বেগমের ছোট মেয়ে জনতা ব্যাংকের সাবেক সিনিয়র অফিসার মোছা. সামসি জাহান বকুল বলেন, এর আগেও জমির জন্য আমার ভাই রাজীব মাকে মারধর করেছে। আবারও আমার ভাই ও ভাবি মাকে মারধর করে হাত-পা ভেঙে দিয়ে নিজেই আবার মায়ের বিরুদ্ধে থানায় মামলা করতে গিয়েছিল। এসময় পুলিশ তাকে আটক করে। আমরা তার বিচার চাই।
আরেক মেয়ে আঞ্জুমান আরা বেগম বলেন, আমরা ভাইবোন সবাই শিক্ষিত। আমার বাবা শিক্ষক ছিলেন। আমার মা সাবেক শিক্ষিকা। আমাদের পরিবারে এই ঘটনা কোনোভাবেই মানতে পারছি না। মায়ের ওপর নির্যাতনকারী আমার ভাই রাজীবের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই। যাতে করে আর কোনো সন্তান মায়ের ওপর এমন অমানবিক নির্যাতন না করে।
অপারেশন থিয়েটারের সামনে ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে মা রেজিয়া বেগম বলেন, আমি বংশের সবার বড় সন্তান, আমাকে কেউ কোনোদিন ফুলের টোকাও দেয়নি। আমি বারবার ছেলেকে বলছিলাম বাবা, তুই আমাকে মারিস না, আমি তোর মা। কিন্তু ছেলে শোনেনি। আজকে আমি হাসাপাতালে। আর যে ছেলেকে আদর-যত্ন দিয়ে মানুষ করেছি সেই ছেলে মাকে নির্যাতনের ঘটনায় জেলে। বলেন দেখি এটা কী হয়!
এখন আপনি কী চান এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি কিছু সময় চুপ থেকে কাঁপা কাঁপা গলায় বলেন, দেশের প্রচলিত আইনে ছেলের বিচার চাই। যাতে কোনো মা যেন এমন নির্যাতনের শিকার আর না হয়।
এ বিষয়ে অভিযুক্ত রাজীবের স্ত্রী খালেদার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তাকে পাওয়া যায়নি।
জানতে চাইলে কোতোয়াাল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. মোজাফফর হোসেন বলেন, অভিযোগ পেয়ে আসামিকে গ্রেফতার করা হয়েছে। মামলা রেকর্ড করে তাকে আদালতে চালান দেওয়া হলে বিচারক কারাগারে পাঠিয়েছেন। তদন্ত করে আদালতে চার্জশিট দেওয়া হবে। জানি