কুমিল্লা বরুড়া থানাধীন ডেউয়াতলী গ্রামে হত্যার পর স্ত্রীকে আগুনে জ্বালিয়ে দেওয়ার রহস্য উদ্ঘাটন ও ঘাতক স্বামী রেজাউল করিমকে(৩০) গ্রেফতার করে র্যাব-১১, সিপিসি-২ এর সদস্যরা ।
মঙ্গলবার সকালে কুমিল্লা র্যাব ১১ সিপিসি ২ এর ইনচার্জ মেজর মোহাম্মদ সাকিব হোসেন এক প্রেস ব্রিফিং এ বিষয়টি নিশ্চিত করেন।
তিনি বলেন, চলতি মাসের ১১ মার্চ কুমিল্লা বরুড়া থানাধীন ডেউয়াতলী এলাকায় অগ্নিদগ্ধ হয়ে ইয়াসমিন আক্তার(২২) নামে একজন গৃহবধূ মারা যায়। যার প্রেক্ষিতে ভিকটিমের ভাই মোঃ রাকিব হোসেন ১২/০৩/২০২২ইং তারিখ বাদী হয়ে কুমিল্লা বরুড়া থানায় একটি অপমৃত্যু মামলা দায়ের করেন, যার অপমৃত্যু মামলা নং-০২ তারিখ ১২/০৩/২০২২ইং।
ঘটনাটি বিভিন্ন ইলেক্ট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ায় প্রকাশিত হলে কুমিল্লাসহ সারা দেশে ব্যাপক চাঞ্চল্যর সৃষ্টি হয়। কিছু গণমাধ্যম দূর্ঘটনার বিষয় নিয়ে নানাবিদ প্রশ্ন উৎথাপন হলে একই সাথে ঘটনাটি অত্যন্ত নির্মম ও হৃদয় বিদারক হওয়ায় র্যাব-১১, সিপিসি-২ এর একাধিক গোয়েন্দা টিম ঘটনার সঠিক তথ্য উদ্ঘাটনের জন্য তদন্ত শুরু করে।
প্রাথমিকভাবে ভিকটিমের স্বামী রেজাউল করিমের সাথে
যোগাযোগের চেষ্টা করলে তার সাথে যোগাযোগ করা সম্ভব না হওয়ায় রেজাউলের পরিবারের সাথে যোগাযোগ করা হলে তাদের দেওয়া তথ্যে গরমিল পাওয়াযোওয়ায় র্যাব সদস্যদের সন্দেহ আরও বেড়ে যায়।
র্যাবের গোয়েন্দা সদস্যরা ভিকটিমের মা, ভাই ও আত্মীয় স্বজনের সাথে যোগাযোগ করে জানা যায় ২০১৭ সালের শুরুতে রেজাউল করিম ভিকটিম ইয়াসমিন আক্তার এর বাড়ির (চাঁদপুর জেলার মতলব দক্ষিণ থানার ডিংগাভাঙ্গা) পাশে “পেইজ” নামক একটি বেসরকারি সংস্থায় চাকুরীরত ছিলেন। উক্ত বেসরকারি সংস্থা থেকে ঋণ নেওয়ার সুবাদে রেজাউল করিমের সাথে ভিকটিমের মা বেবী আক্তারের পরিচয় হয়। পরিচয়ের সুবাদে আসামী রেজাউল করিম ঋণের কিস্তির টাকা নিতে ভিকটিমের বাড়িতে আসা যাওয়া করতো। আসা যাওয়ার একপর্যায়ে ভিকটিম ইয়াসমিন আক্তার এর সাথে রেজাউল করিমের প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠে। উক্ত প্রেমের সম্পর্কটি এলাকায় জানাজানি হলে ভিকটিমের পূর্বের স্বামী আনোয়ার হোসেনের সাথে তালাক হয়ে যায়। তাই খুব অল্প পরিসরে তাৎক্ষনিকভাবে কোন প্রকার কাবিন ও
ইসলামিক প্রক্রিয়া অনুসরণ না করেই রেজাউল করিম ভিকটিম ইয়াসমিন আক্তারকে বিয়ে করতে বাধ্য হয়।
রেজাউল করিম ভিকটিমকে আনুষ্ঠানিকভাবে উঠিয়ে নেয়ার কথা বলে ভিকটিমের মাকে আশ্বস্ত করে তড়িঘড়ি করে
মালদ্বীপ চলে যায়। রেজাউল মালদ্বীপ গিয়ে ভিকটিমের সাথে যোগাযোগ বিচিছন্ন করার চেষ্টা করলেও ভিকটিমের চাপে
যোগাযোগ করে ভিকটিম বিভিন্নভাবে রেজাউলকে দেশে এসে আনুষ্ঠানিকভাবে বিয়ে করতে চাপ প্রয়োগ করে।
একপর্যায় এ বছরের ৭ জানুয়ারি মালদ্বীপ থেকে দেশে ফিরে আসে রেজাউল অনেকটা বাধ্য হয়ে পরিবারের অমতে ১০ জানুয়ারি ভিকটিম ইয়াসমিন আক্তার, পিতা-মৃত আক্তার হোসেন, মাতা-বেবী আক্তার, সাং-ডিংগাভাঙ্গা, থানা-মতলব দক্ষিণ,জেলা-চাঁদপুর এর সাথে রেজাউল করিম অনেকটা
বাধ্য হয়েই বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়। বিবাহের পর রেজাউল করিম ভিকটিমকে তার বাড়ি বরুড়া থানাধীন ডেউয়াতলী
গ্রামে নিয়ে আসে। যেহেতু রেজাউল পরিবারের অমতে বিয়ে করেছে সেহেতু রেজাউল এর পরিবার ভিকটিমকে মন
থেকে মেনে নেয়নি অপরদিকে রেজাউলও ভিকটিমের সাথে দীর্ঘস্থায়ী পারিবারিক জীবনে অনাগ্রহী ছিল। তাই ভিকটিমের
পরিবার অর্থনৈতিভাবে অসচছল যেনেও রেজাউল ভিকটিমকে যৌতুকের জন্য চাপ প্রয়োগ করতে থাকায় পারিবারিক কলহ শুরু হয়।
একদিকে রেজাউলের পরিবার অপর দিকে যৌতুকের চাপের কারণে তাদের পারিবারিক কলহ মাত্রারিক্ত পর্যায়ে চলতে থাকে। সর্বশেষ ১৫ ফেব্রুয়ারি স্থানীয় চেয়ারম্যান, মেম্বারসহ সমাজের ব্যক্তিবর্গ সালিশে বসে বিষয়টি সমাধান করেন এবং তাদেরকে একত্রে থাকতে বলেন। সালিশে রেজাউল বিষয়টি মেনে নিয়ে একত্রে থাকতে শুরু করে। কিছুদিন যেতে না যেতেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটতে থাকে।
ভিকটিমের পরিবার ও স্থানীয় এসব তথ্য প্রাপ্তির পর র্যাব-১১, সিপিসি-২, কুমিল্লা এর গোয়েন্দা দল আরও গভীরভাবে তদন্ত কার্যক্রম শুরু করে এবং ভিকটিমের স্বামীর সন্ধানে একাধিক টিম নিয়োগ করে। পরবর্তীতে মাঠ পর্যায়ে গোয়েন্দা নজরদারীর সূত্র ধরে গোপন সংবাদের ভিত্তিতে র্যাব-১১, সিপিসি-২ এর একটি আভিযানিক দল ২৮ মার্চ নয়টার সময় বিশেষ অভিযান পরিচালনা করে কুমিল্লা কোতয়ালী থানাধীন ইপিজেড এলাকা থেকে আত্মগোপনে
থাকা অবস্য়থায় রেজাউল করিম(৩০), পিতা-আলতাফ হোসেন, সাং-ডেউয়াতলী (মোল্লাবাড়ী), থানা-বরুড়া, জেলা কুমিল্লাকে সনাক্ত করতে সক্ষম হয়।
ঘটনার সংশ্লিষ্ট বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদে তিনি বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে বিস্তারিত জিজ্ঞাসাবাদের জন্য র্যাব ক্যাম্পে নিয়ে আসা হয়।
একপর্যায়ে গ্রেফতারকৃত রেজাউল করিম জিজ্ঞাসাবাদে জানায় যে,চলতি বছরের ১০ মার্চ বিকেলে রেজাউলের সাথে
ভিকটিম ইয়াসমিন আক্তারের বিভিন্ন বিষয়ে কথা কাটাকাটি হলে রেজাউল ভিকটিমকে চড়থাপ্পড় দিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে যায়। রেজাউল ভিকটিমকে চড়থাপ্পড় মারলে রেজাউলের নখের আঁচড়ে ভিকটিমের গালের নিচে আঁচর পড়ে।
সন্ধা আনুমানিক সাতটার সময় পুনরায় তাদের মধ্যে ঝগড়াঝাটি হলে রেজাউলের বাবা মা তাদেরকে চুপ থাকতে বলে। রাত ১০ টার সময় রেজাউলের বাবা মা ঘুমিয়ে গেলে পুনরায় তাদের মধ্যে কথা কাটাকাটি হয়। কথা কাটাকাটির একপর্যায়ে রেজাউল ক্ষীপ্ত হয়ে ভিকটিম ইয়াসমিন বেগমের গলায় দুই হাত দিয়ে চেপে ধরলে ভিকটিম জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। রেজাউল তার স্ত্রী ভিকটিম ইয়াসমিন আক্তার এর চোখে মুখে পানি দিয়ে জ্ঞান ফিরানোর চেষ্টা করে এবং
ভিকটিমের শ্বাস ঠিক আছে বলে অনুধাবন করে। কিছুক্ষণ পরেই রেজাউল ভিকটিমের গায়ে হাত দিয়ে দেখে ভিকটিমের শরীর ঠান্ডা হয়ে যাওয়ায় সে বুজতে পারে তার স্ত্রী আর বেঁচে নেই। এমতবস্থায় সে সারারাত চিন্তা করতে থাকে তার স্ত্রীর মৃত্যুর বিষয়টি পরিবার ও লোকমুখে জানাজানি হলে সে কি জবাব দিবে।
একপর্যায়ে সকাল হলে ১১ মার্চ ভোর ৫ টার সময় তার স্ত্রী ভিকটিম মৃত ইয়াসমিন আক্তারের সারা শরীরে ঘরে থাকা কেরোসিন তৈল ঢেলে আগুন লাগিয়ে দিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে ফজরের নামাজ পড়তে মসজিদে চলে যায়।
নামাজ শেষে আগুন লাগার বিষয়ে কোন সাড়া না পাওয়ায় মসজিদ থেকে জিয়ারতের উদ্দেশ্যে পারিবারিক কবরস্থানে চলে যায়। রেজাউল কবরস্থানে থাকা অবস্থায় স্থানীয় লোক জনের মাধ্যমে আগুন লাগার বিষয়ে শোরচিৎকার ও লোকজনের মুখে শুনামাত্র দ্রুত তার বাড়িতে যায়।
স্থানীয় লোকজন আগুন নিভানোর সময় রেজাউলও তাদের সাথে আগুন নিভানোর অভিনয় করতে করতে বলতে থাকে ঘরের ভিতর তার স্ত্রী ও বিদেশ যাওয়ার সকল কাগজপত্রসহ
টাকা পয়সা রয়েছে। কথাগুলো বলতে বলতে রেজাউল জ্ঞান হারানোর ভান ধরে। ্এ সময় স্থানীয় লোকজন রেজাউলকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করে।
এ দিকে স্ত্রীর জানাজা শেষ হওয়ার খবর শুনে হাসপাতাল থেকে আত্মগোপনে চলে যায় রেজাউল । আত্মগোপনে থাকা অবস্থায় সে দ্রুত দেশ ছাড়ার পরিকল্পনা করেছিলছ।
গ্রেফতারকৃত আসামীর বিরুদ্ধে পরবর্তী আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য কুমিল্লা বরুড়া থানায় হস্তান্তর র্যাব সদস্যরা।