ভোলার লালমোহনে নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের সঙ্গে থাকত জোবায়দা সিদ্দিকা নাবিলা। সদ্য এসএসসি পাশ করেছে। উচ্চমাধ্যমিকে ভর্তি হলেও পরীক্ষা দেওয়া হয়নি তার । এই বয়সেই জঙ্গিবাদে হাতেখড়ি হয়েছে তার। শুধু হাতেখড়িই নয়, রীতিমতো আন্তর্জাতিক জঙ্গি গোষ্ঠী আল-কায়েদা’র মতবাদ প্রচার করতেন তিনি। তথ্য-প্রযুক্তিতে দক্ষ হয়েছেন নিজে-নিজেই। জঙ্গি মতবাদ প্রচার করতে তার অন্তত পনেরটি অনলাইন চ্যানেল রয়েছে। যেগুলোতে নিয়মিত ‘জিহাদী কন্টেন্ট’ আপলোড করত নাবিলা।
গত বৃহস্পতিবার (২৬ আগস্ট) ঢাকার বাড্ডা এলাকা থেকে জঙ্গি নাবিলাকে গ্রেফতার করেছে কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট- সিটিটিসি। পাঁচ দিনের রিমান্ডে নিয়ে ১৯ বছরের এই তরুণীকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।জঙ্গিবাদ প্রতিরোধে কাজ করা বিশেষায়িত ইউনিট সিটিটিসির প্রধান মো. আসাদুজ্জামান বলেন, ‘‘নাবিলা ২০২০ সালের প্রথম দিকে ছদ্মনামে একটি ফেসবুক অ্যাকাউন্ট খুলেছিল। এসময় Pসে আনসার আল ইসলামের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ ‘তিতুমীর মিডিয়া’র খোঁজ পায়। এরপর ধীরে ধীরে জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়ে সে। একপর্যায়ে নিজেই আনসার আল-ইসলামের মতবাদ প্রচার করতে শুরু করে।
বাংলাদেশের নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলাম মূলত আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন আল-কায়েদার মতাদর্শী। আনসার আল ইসলামের সদস্যরা নিজেদের আল-কায়েদা ইন ইন্ডিয়ান সাবকন্টিনেন্ট বা একিউআইএস’র সদস্য বলে পরিচয় দিয়ে থাকে।
সিটিটিসির কর্মকর্তারা জানান, নাবিলার আয়ত্বে দুটি ফেক ফেসবুক অ্যাকাউন্ট ছিল। এছাড়া টেলিগ্রাম চ্যানেলে চারটি অ্যাকাউন্ট ছিল তার। ভিন্ন ভিন্ন ছদ্মনামে তিনি এসব অ্যাকাউন্ট চালাতেন। টেলিগ্রামে তার ১৫টি চ্যানেল ছিল। এসব চ্যানেলে আল-কায়েদার মতাদর্শী বিভিন্ন জিহাদী কন্টেন্ট ও প্রোপাগান্ডার প্রচার-প্রচারণা করতেন তিনি।
সিটিটিসির একজন কর্মকর্তা জানান, তারা নাবিলার পরিচালিত টেলিগ্রাম চ্যানেলে ঢুকে রীতিমতো বিস্মিত হয়েছেন। এসব চ্যানেলে ‘জিহাদ কেন প্রয়োজন’, ‘কিতাবুল জিহাদ’, ‘একাকি শিকারি লোন উলফ’, ‘স্নিপার সেলগুলোতে গোয়েন্দাদের অনুপ্রবেশ ও প্রতিরোধের উপায়’, ‘নীরবে হত্যার কৌশল’, ‘পুলিশ শরীয়তের শত্রু’, লোন উলফ বালাকোট মিডিয়া, আল আনসার ম্যাগাজিন ইস্যু, জিহাদের সাধারণ দিক নির্দেশনা, ‘তাগুতের শাসন থেকে মুক্তির ঘোষণা’ ইত্যাদি ছাড়াও ইম্প্রোভাইজড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস বা আইইডি, স্মোক বোম্ব ও আগ্নেয়াস্ত্র তৈরির কলা-কৌশল সম্বলিত অনেক ম্যানুয়াল, ভিডিও ফাইল আপলোড করেছে।
সিটিটিসির উপ-কমিশনার (ইন্টেল) মিশুক চাকমা বলেন, আমরা নাবিলাকে পাঁচ দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছি। তার সঙ্গে সাংগঠনিক পর্যায়ে কার কার সঙ্গে যোগাযোগ ছিল তা জানার চেষ্টা চলছে।
শহীদ হতে প্রস্তুত ছিল নাবিলা :
গ্রেফতারের পর জিজ্ঞাসাবাদে নাবিলা জানিয়েছেন, তিনি জিহাদের জন্য প্রস্তুতি নিয়েছেন। সাংগঠনিক নির্দেশনার জন্য অপেক্ষায় ছিলেন। এমনকি কথিত জিহাদের ময়দানের শহীদ হওয়ার জন্যও প্রস্তুতি নিয়েছেন।
সিটিটিসির কর্মকর্তারা বলছেন, ‘‘নাবিলার ব্রেইন এমনভাবে ওয়াশ করা হয়েছে যে সে ‘জিহাদে গিয়ে শহীদ হওয়ার জন্য’ মরিয়া হয়ে উঠেছিল। হয়তো আর কিছুদিনের মধ্যে সাংগঠনিক নির্দেশে কথিত হিজরতের নামে ঘর ছেড়েও যেত। কিন্তু তার আগেই গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
নাবিলা কারো না কারো দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে। আমরা তার সেই গুরুকে শনাক্তের চেষ্টা করেছি’- বলছিলেন কাউন্টার টেরোরিজমের ওই কর্মকর্তা।২৫ হাজার ফলোয়ার নাবিলার জঙ্গিবাদে উদ্ভূদ্ধ করতে বা দাওয়াতি কাজের জন্য নাবিলা টেলিগ্রামে যেসব চ্যানেল পরিচালনা করতেন, সেসব চ্যানেলে প্রায় ২৫ হাজার ফলোয়ার ছিল বলে জানিয়েছেন কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের একজন কর্মকর্তা। ওই কর্মকর্তারা জানান, দেশ-বিদেশে থাকা অবস্থানকারীদের কাছে নিয়মিত জঙ্গিবাদী প্রোপাগান্ডা আল-কায়েদা তথা আনসার আল ইসলামের মতবাদ তুলে ধরাই ছিল তার কাজ। তার চ্যানেলে প্রায় সাড়ে ছয় শ’ জঙ্গিবাদী মতাদর্শের কন্টেন্ট রয়েছে। মামলার আলামত হিসেবে ব্যবহারের বাইরে অন্যসব কন্টেন্ট মুছে ফেলার প্রক্রিয়া চলছে।
সিটিটিসি সূত্র জানায়, টেলিগ্রামের মাধ্যমে নাবিলা অনেকের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগও করেছেন। যেসব আইডির সঙ্গে নাবিলার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রয়েছে তাদের বিষয়েও খোঁজ-খবর করা হচ্ছে। তাদের শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনা হবে।
পুরুষ জঙ্গি খুঁজতে গিয়ে সন্ধান মিলে এই তরুণীর:
নাবিলাকে গ্রেফতারে অভিযানে থাকা একজন কর্মকর্তা জানান, তারা গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে অনুসন্ধান করার সময় ভেবেছিলেন ছদ্মনামে থাকা এই জঙ্গি আনসার আল ইসলামের পুরুষ সদস্য হতে পারেন। কারণ এর আগে আনসার আল ইসলামের সঙ্গে জড়িত কোনও নারী বা তরুণী গ্রেফতার হয়নি। কিন্তু অভিযানে গিয়ে তারা জানতে পারেন এই জঙ্গি অল্প বয়সী এক তরুণী।
আটকের পর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে অকপটে নিজের জঙ্গিবাদে জড়িয়ে থাকার স্বীকার করেন নাবিলা। এমনকি জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়ার সপক্ষে নানা বক্তব্যও তুলে ধরার চেষ্টা করেন তিনি’- বলছিলেন পুলিশের ওই কর্মকর্তা।
সিটিটিসির কর্মকর্তারা জানান, বাংলাদেশে এর আগে ইসলামিক স্টেট বা আইএসের অনুসারী নব্য জেএমবির নারী শাখা, পুরানো জেএমবির নারী শাখার সন্ধান পেলেও আনসার আল ইসলাম বা আল-কায়েদার অনুসারীদের নারী শাখার খোঁজ পাননি। নাবিলাকে গ্রেফতারের পর মনে হচ্ছে আল-কায়েদার অনুসারী আনসার আল ইসলাম নারীদেরও তাদের দলে নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেছে।