বাংলাদেশের পার্বত্য জেলা বান্দরবানের রোয়াংছড়ির ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের মুসলিম মোহাম্মদ ওমর ফারুক হত্যার ঘটনা নিয়ে অনেকে আমার মতামত জানতে চেয়েছেন। ইনবক্সে অনেকে আবার অনুরোধও জানিয়েছেন। যদিও আমরা এ বিষয়টি নিয়ে কিছুটা খোঁজ-খবর রাখার চেষ্টা করে চলেছি। আর এর মাঝেই আপনাদের অনুরোধ এসেছে।
ইতিমধ্যেই আমরা যতটুকু জেনেছি কিংবা আমাদের প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্তের সাথে ফেসবুকের অনেকের মতামতের কোনো মিল খুঁজে পেলাম না। একশ্রেণির মানুষ আবার এখানেও ধর্মকে টেনে লম্বার করার ব্যর্থ চেষ্টা-আমাদের কাছে প্রতীয়মান হয়েছে। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার-বিশ্লেষণ করার কারণেই হয়তো এমনটা হয়ছে। আবার এমন কিছু ব্যক্তি বিশেষের আন্দোলনের ডাক-ঢোলের অবস্থান তাদের অতি ধর্মপ্রীতি যা ইতোমধ্যেই তারা ধর্ম ব্যবসায়ি হিসেবে সমাজ ও রাষ্ট্রের কাছে চিহ্নিত হয়ে আছে।
আমাদের তথ্য মতে, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের বেরণ চন্দ্র ত্রিপুরা ২০১৪ সালে থানচি থানার আলীকদমে গিয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন এবং তখন তার নিজের নাম মোহাম্মদ ওমর ফারুক রাখেন। পরে তার পরিবারের অন্যান্য সদস্যরাও ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে সেখানেই বসবাস শুরু করেন।
তিন-চার বছর আগে ওমর ফারুক আবার রোয়াংছড়িতে ফিরে আসেন। তার শ্বশুরের কাছ থেকে পাওয়া জায়গায় তিনি একটি মসজিদ তৈরি করেন।
অন্যদিকে, রোয়াংছড়ি বাজারে রোয়াংছড়ি জামে মসজিদেও নামাজ পড়তেন ওমর ফারুক। তাছাড়া তুলাছড়ি ত্রিপুরা পাড়ায় তিনি যে মসজিদ নির্মাণ করছিলেন, সেখানেও ইমামতি করতেন ওমর ফারুক। ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের মুসলিমদের জন্য স্থানীয় যাদুমনি পাড়াতেও আরেকটি মসজিদ রয়েছে।
আমাদের তথ্য সুত্র বলছে, এসব মসজিদ নিয়ে বা ওমর ফারুক সহ অন্যান্য মুসলিম সম্প্রদায়ের ধর্মকর্ম পালন করা নিয়েও ওমর ফারুক কোন দ্বন্দ্বে জড়াতে শোনা যায়নি কিংবা অন্য কোনো মুসলমানকে ধর্মীয় রীতিনীতি পালনে কেউ কখনো বাধা প্রদান করেছে-এমন অভিযোগও স্থানীয়রা পায়নি। এমনকি, ধর্ম পরিবর্তন বা মসর্জিদ নির্মাণ নিয়ে কখনো কোন সমস্যায় পড়েছেন এমনটি কখনো তিনি স্থানীয় জনপ্রতিনিধি বা পুলিশ প্রশাসনকে জানায়নি।
আর ত্রিপুরা সম্প্রদায়ে ওমর ফারুকই একমাত্র মুসলিম নন এবং তিনি নতুন করেও মুসলিম হননি। যতটুকু জেনেছি, ওই সম্প্রদায়ে মোট ৩৩টি পরিবারের মধ্যে ৫টি পরিবারই মুসলিম।
আবার গত দশ বছরের হিসেব অনুযায়ী, ওই এগারোটি পরিবার মুসলিম হয়েছিলো কিন্তু তারমধ্যে ৫/৬টি পরিবার আবার খ্রিস্টান ধর্মে ধর্মান্তরিত হয়ে গেছে। অর্থাৎ, একবার খ্রিস্টান থেকে মুসলিম হয়, আবার মুসলিম থেকে খ্রিস্টান ধর্মে চলে যায়।
আমরা আরও জেনেছি, আলীকদম এলাকাটি খুবই দরিদ্র মানুষের বসবাস। সেখানে নানা কারণে ধর্মান্তরিত হওয়ার প্রবণতা দেখা যায়। কিন্তু এই ধর্ম পরিবর্তন নিয়ে কেউ আক্রোশের শিকার হয়েছে-এমন তথ্য প্রমাণও কেউ দিতে পারেনি বা শোনাও যায়নি।
আবার জনপ্রতিনিধি বা পুলিশ প্রশাসনের মাধ্যমে জেনেছি, মসজিদ নির্মাণ বা ধর্মকর্ম পালন নিয়েও ওমর ফারুক কোন দ্বন্দ্বে জড়িয়েছেন বা কোন সমস্যায় পড়েছেন এমনটি কখনো তিনি স্থানীয় জনপ্রতিনিধি বা পুলিশ প্রশাসনকেও জানাননি। আর তিনি যেখানে থাকতেন, তার থেকে সেনা ক্যাম্পও খুব বেশি দূরে নয়।
যা হোক, মোহাম্মদ ওমর ফারুককে ১৮ জুন শুক্রবার রাত আটটার দিকে তার বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে বাইরে মসজিদের সামনে গুলি করে হত্যা করে একদল লোক-এটাই বাস্তব সত্য।
আর এই বাস্তবতাকে নিয়ে পাহাড়ে-পাহাড়ে চলছে ষড়যন্ত্র। একে অপরের প্রতি মিথ্যাচার আর দোষারোপ করছে। মুসলিম হওয়ার পরেও বাঙালি কিছু সংগঠন ঘটনার জন্য মোহাম্মদ ওমর ফারুককে ‘নওমুসলিম’ আখ্যা দিয়ে তাকে হত্যার জন্য জনসংহতি সমিতিকে দায়ী করে নানা কর্মসূচি পালন করেছে এবং নানা রকম প্রচার-প্রকাশ করে চলেছে।
এখানে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে একটি কথা বলবো, আমরা দেখেছি-একটি সত্য ঘটনা অনেক সময় মিথ্যা আর বানোয়াট দাবী-প্রতিবাদের কারণে প্রকৃত অপরাধী কিংবা প্রকৃত ঘটনা আড়ালে চলে যায়। যেমন, সর্বশেষে আবু ত্ব-হা মুহাম্মদ আদনান!
আবু ত্ব-হা মুহাম্মদ আদনানের ঘটনা নিয়ে আমাদের অনলাইন অ্যাক্টিভিস্টদের শিক্ষা নেওয়া উচিত। যারা ষড়যন্ত্রকারী, তারা তো ষড়যন্ত্র করবেই। তবে তাদের ষড়যন্ত্র আপনাদের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করে থাকে। ষড়যন্ত্রকারীদের সংখ্যা একেবারেই কম। তাই প্রতিটা বিষয় নিয়ে একটু স্টাডি করার চেষ্টা করুন। প্রথমসারির গণমাধ্যমকে ফলো করুন। কিছু একটা ভাইরাল হলেই কিংবা কিছু একটা শুনেই দৌঁড় দেওয়ার আগে আপনি/আপনারা বিস্তারিত জানার চেষ্টা করুন।
মনে রাখা উচিত, আমাদের (আমি ছাড়া) অনেকের ধারণা ছিল আবু ত্ব-হা মুহাম্মদ আদনান গুম হয়েছে আর তাকে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য ভৌ-দৌঁড় শুরু করেছিলাম। কিন্তু পরবর্তীতে প্রকৃত সত্যটা বের হয়ে এসেছে এবং ত্ব-হা তার বন্ধুর বাড়িতে আত্মগোপন করে অবশেষে বন্ধুর রুটি-রোজগারের চাকুরিচ্যুত করেছে।
প্রতিটি অন্যায়, অপরাধ, অপসংস্কৃতি, দুর্নীতি, হত্যা সহ সকল অনিয়মের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলুন। প্রতিবাদ করুন। প্রয়োজনে প্রতিরোধ গড়ে তুলোন। তবে, আগে নিজে বিস্তারিত জানুন এবং মাঠে নামুন। তাহলে সফলতা আসবে।
আমরা মোহাম্মদ ওমর ফারুক হত্যাকান্ডের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছি। সেসাথে ওই জঘন্য অপরাধের সাথে যারা জড়িত, তাদের দৃষ্টান্ত শাস্তির দাবি জানাচ্ছি।
আমরা আশাকরছি, খুব শীঘ্রই প্রশাসন ওই অপরাধীদের শনাক্তকরণ ও গ্রেফতার করে প্রকৃত সত্য দেশ ও জাতির সামনে উপস্থাপন করবে।
লেখক:
কবীর চৌধুরী তন্ময়
সভাপতি
অনলাইন অ্যাক্টিভিটিস ফোরাম