আবেদন করে পরীক্ষায় পাস করেও ড্রাইভিং লাইসেন্স পাচ্ছে না ১৫ লাখ মানুষ। ফলে চরম ভোগান্তিতে পড়েছে দেশে ও বিদেশে ড্রাইভিং চাকুরি প্রত্যাশীরা। মধ্যপ্রাচ্যে নিশ্চিত হওয়া চাকরি হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে লাইন্সেন্সের স্মার্ট কার্ড না পাওয়ায়। মাদ্রাজ সিকিউরিটি প্রিন্টার্সের কারণেই এই ভয়াবহ ভোগান্তি। চুক্তি হলেও এক বছরেও বিআরটিএকে স্মার্ট কার্ড লাইসেন্স সরবরাহ করতে পারছে না তারা। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নিষেধাজ্ঞার কবলে থাকা মাদ্রাজ সিকিউরিটি প্রিন্টার্সের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে বিআরটিএ ও ১৫ লাখ ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রত্যাশী।
বিআরটি এক কর্মকর্তা নাগরিকখবর কে বলছেন, মাদ্রাজ সিকিউরিটি প্রিন্টার্সের ব্যর্থতার কারণে ড্রাইভিং লাইসেন্স দিতে না পারায় বিআরটিএর সব অর্জন ম্লান হয়ে গেছে। বছরখানেক আগে আবেদন ও পরীক্ষায় পাস করেও পর্যন্ত ড্রাইভিং লাইসেন্স না পাওয়া ব্যক্তিদের ভোগান্তি চরমে উঠেছে। এখন পর্যন্ত প্রায় ১৫ লাখ মানুষ ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য মাসের পর মাস অপেক্ষা করছে।
এরমধ্যে প্রায় ১০ লাখ চালক গাড়ি চালাচ্ছেন বিআরটিএর ‘একনলেজমেন্ট স্লিপ’ দিয়ে। কিন্তু স্মার্ট ড্রাইভিং লাইসেন্স কার্ড না পাওয়ায় সরকারি-বেসরকারি চাকরিতে আবেদন করতে পারছেন না তারা। শুধু তাই নয় এর কারণে দুই বছর ধরে বাংলাদেশ দক্ষ চালক রপ্তানিতে ব্যর্থ হচ্ছে। ফলে অন্যান্য দেশ সে স্থান দখল করে নিচ্ছে।
জানা যায়, ২০২০ সালের ২৯ জুলাই ভারতীয় কোম্পানি মাদ্রাজ সিকিউরিটি প্রিন্টার্স প্রাইভেট লিমিটেডের সঙ্গে পাঁচ বছরে ৪০ লাখ স্মার্ট কার্ড ড্রাইভিং লাইসেন্স সরবরাহের শত কোটি টাকার চুক্তি সই করে বিআরটিএ। এ চুক্তিতে মাদ্রাজ সিকিউরিটি প্রিন্টার্স প্রাইভেট লিমিটেডের বাংলাদেশি এজেন্ট লজিক ফোরাম। চুক্তি অনুসারে ২০২০ সালের ২৯ জুলাই থেকে দুই মাসের মধ্যে প্রিন্ট করা স্মার্ট লাইসেন্স কার্ড সরবরাহ করার কথা। করোনা পরিস্থিতির কারণে সেই সময় বৃদ্ধি করে সাড়ে চার মাস করা হয়। সে হিসেবে গত ডিসেম্বর থেকে প্রিন্ট করা স্মার্ট লাইসেন্স কার্ড সরবরাহ করার কথা মাদ্রাজ সিকিউরিটি প্রিন্টার্সের। কিন্তু জুলাই থেকে এক বছরেও বিআরটিএকে সময়মতো স্মার্ট কার্ড লাইসেন্স সরবরাহে ব্যর্থ হয়েছে। এমনকি ড্রাইভিং লাইসেন্সের নমুনাও দেখাতে পারেনি সংস্থাটি।
বিআরটিএ সূত্র জানায়, সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের গত ডিসেম্বরে মাদ্রাজ সিকিউরিটি প্রিন্টার্স প্রাইভেট লিমিটেডের কাছে ড্রাইভিং লাইসেন্সের নমুনা দেখতে চান। কিন্তু সেই নমুনা তারা এখনো দেখাতে পারেনি। পরে সড়ক পরিবহন মন্ত্রনালয় থেকে খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, মাদ্রাজ সিকিউরিটি প্রিন্টার্স এখন পর্যন্ত সেন্ট্রাল এনরোলমেন্ট স্টেশন স্থাপনের কাজই শেষ করতে পারেনি। এখনো জনবল নিয়োগ দেওয়া হয়নি বিভিন্ন জেলায়। স্টেশন স্থাপনের কাজেও শর্ত না মানার অভিযোগও আছে।
সূত্র জানায়, আগ্রহী বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানকে উপেক্ষা করে কাজ দেওয়া হয় মাদ্রাজ সিকিউরিটি প্রিন্টার্সকে। অথচ সমস্ত শর্ত পূরণ করে ৪৫ (পঁয়তাল্লিশ) দিনের মধ্যে প্রাথমিক প্রস্তুতি সম্পন্ন করতে পারা এবং মাসে দুই লাখ ড্রাইভিং লাইসেন্স কার্ড জনগণের হাতে পৌঁছে দিতে সক্ষম কোম্পানিও এক্ষেত্রে আবেদন করেছিল। কিন্তু বহু অভিযোগে অভিযুক্ত এই কোম্পানিকেই শত কোটি টাকার ড্রাইভিং লাইসেন্সের স্মার্ট কার্ড প্রকল্পের কাজ দিয়েছে বিআরটিএ। এজন্য চারবার সংশোধন করা হয়েছে দরপত্রের শর্ত এবং দরপত্র বাতিল করে বাদ দেওয়া হয় যোগ্য কোম্পানিকে। প্রথম দরপত্রে ফ্রান্সের প্রতিষ্ঠান সেল্্প সর্বনিম্ন দরদাতা হয়ে দরপত্রের সকল শর্ত পূরণ করলেও তাদের কাজ না দিয়ে দ্বিতীয়বার দরপত্র আহ্বান করে কাজ দেওয়া হয় এই মাদ্রাজ সিকিউরিটি প্রিন্টার্সকেই।
বিভিন্ন দেশে নিষেধাজ্ঞায় মাদ্রাজ সিকিউরিটি প্রিন্টার্স : মাদ্রাজ সিকিউরিটি প্রিন্টার্স নিজ দেশ ভারতেই আধার কার্ড প্রকল্পে আজীবন নিষিদ্ধ। ভারতের আধার কার্ড প্রকল্পে কাজ পেয়েছিল মাদ্রাজ সিকিউরিটি প্রিন্টার্স। কিন্তু নাগরিকদের তথ্য বিক্রি করে দেয়। ফলে জোটে আজীবন নিষেধাজ্ঞা। বের করে দেওয়া হয় তেলেঙ্গানার সামাজিক সুরক্ষা সেবা ‘মিসেভা’ প্রকল্প থেকেও। ভবিষ্যতেও ভারতের কোনো টেন্ডারে অংশ নিতে পারবে না কোম্পানিটি। দুর্নাম কুড়িয়েছে ভারতের বাইরেও। আফ্রিকার দেশ কেনিয়াতে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ঝুলছে মাদ্রাজ সিকিউরিটি প্রিন্টার্সের নয় পরিচালকের বিরুদ্ধে। শ্রীলঙ্কাতেও ঘুষ-অনিয়মের মাধ্যমে কাজ বাগিয়ে নেওয়ার অভিযোগ আছে। মাদ্রাজ সিকিউরিটি প্রিন্টার্সের ব্যর্থতা বাংলাদেশেও নতুন কোনো ঘটনা নয়। বাংলাদেশে ২০১৫ সালে বিএমইটির ইমিগ্রেশন কার্ড সরবরাহের দায়িত্ব পেয়েও ব্যর্থ হয়েছিল মাদ্রাজ সিকিউরিটি প্রিন্টার্স।