ধর্ষণচেষ্টা, হত্যাচেষ্টা ও মারধরের অভিযোগে ঢালিউডের আলোচিত চিত্রনায়িকা পরী মণির করা মামলায় ব্যবসায়ী নাসিরউদ্দিন মাহমুদকে গ্রেপ্তার করেছে গোয়েন্দা পুলিশ। নাসির এই মামলার অন্যতম অভিযুক্ত। এ ঘটনায় সহযোগী হিসেবে অমি (যাকে সঙ্গে নিয়ে পরী মণি বোট ক্লাবে গিয়েছিলেন) ও অপর তিন নারীকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
গ্রেফতার হওয়া তিন নারী নাসিরের রক্ষিতা বলে সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছেন ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার মো. হারুন অর রশীদ পিপিএম
নাসির ইউ মাহমুদ এর পরিচয়:
নাসির ইউ মাহমুদ ওরফে নাসিরউদ্দিন মাহমুদ জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য, কুঞ্জ ডেভেলপার্স লিমিটেডের চেয়ারম্যান, উত্তরা ক্লাব লিমিটেডের সাবেক প্রেসিডেন্ট ও ঢাকা বোট ক্লাবের কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য (বিনোদন ও সংস্কৃতি) বলে জানিয়েছে পুলিশ।
সোমবার দুপুরে উত্তরা থেকে নাসিরউদ্দিন মাহমুদ ও অমিকে গ্রেপ্তার করে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। একই সময়ে সাভার মডেল থানার পুলিশের একটি দল নাসিরের উত্তরার ১ নম্বর সেক্টরের ৮ নম্বর বাসায় তল্লাশি চালিয়ে সেখান থেকে বেশ কিছু বিদেশি মদ ও ইয়াবাসহ তিন নারীকে গ্রেপ্তার করে। পরে তাদের উত্তরা থানা পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হয়।
দিনভর নানা নাটকীয় ঘটনার ধারাবাহিকতায় পরী মণিকে নিয়ে বিনোদন জগৎসহ নেটমাধ্যমে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। এর আগে পরী মণি নিজে বাদী হয়ে নাসিরউদ্দিন মাহমুদকে প্রধান আসামি করে মোট ছয়জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন সাভার মডেল থানায়। আসামিদের মধ্যে চারজন অজ্ঞাত বলে এজাহারে উল্লেখ করা হয়।
সাভার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কাজী মাইনুল ইসলাম জানান, মামলার পর পরই বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে তদন্তে নামে পুলিশ। ঘটনাস্থল সাভারের বিরুলিয়ায় ‘ঢাকা বোট ক্লাব’ পরিদর্শনসহ একাধিক টিমে ভাগ হয়ে তল্লাশি চালায় নাসিরউদ্দিন মাহমুদের বাসায়।
ধর্ষণ ও হত্যাচেষ্টার বিষয়ে রূপনগর থানার পুলিশের কাছে গতকাল রোববার রাতে লিখিত অভিযোগ করেন পরী। রূপনগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আরিফুর রহমান সরদারের বার্তা নিয়ে ওই থানার পুলিশ সেই অভিযোগটি আজ সোমবার দুপুরে সাভার মডেল থানায় পৌঁছে দিলে পুলিশ গোপনে মামলাটি রেকর্ড করে।
এর আগে গতকাল রোববার রাতে নিজের ফেসবুক পোস্টে ধর্ষণ ও হত্যাচেষ্টার অভিযোগ এবং আইনগত সহযোগিতা না পাওয়ার অভিযোগ আনেন এ চিত্রনায়িকা। পরে তিনি সংবাদ সম্মেলনেও একই অভিযোগ করেন।
থানায় দেওয়া লিখিত অভিযোগে পরী জানান:
থানায় দেওয়া লিখিত অভিযোগে পরী জানান, গত বুধবার গভীর রাতে অমি নামের একজন কৌশলে তাঁকে বিরুলিয়ায় ঢাকা বোট ক্লাবে নিয়ে যান। এরপর সেখানে আসামিরা তাঁকে (পরী) শ্লীলতাহানি করেন। এক পর্যায়ে তাঁকে শারীরিক নির্যাতনের অভিযোগ করেন ঢাকাই ছবির আলোচিত এই নায়িকা। পরে বনানী থানায় অভিযোগ নিয়ে গিয়েও কোনো প্রতিকার না পেয়ে নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজ থেকে মারধর ও ধর্ষণচেষ্টার অভিযোগ করলে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। ২০১৫ সালে শামসুন্নাহার স্মৃতি ঢাকাই চলচ্চিত্রে পরী মণি নামে অভিষেকের পরই দ্রুত আলোচনায় আসেন।এই নাসিরের বিরুদ্ধেই জোরপূর্বক মদপান করানো, ভয়ভীতি প্রদর্শন, মারধর ও ধর্ষণচেষ্টার অভিযোগ আনেন চিত্রনায়িকা পরী মণি।
নাছির মাহমুদের অবস্থান:
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্তিকা, পানি ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগ থেকে পড়াশোনা করা নাসির পেশায় একজন উচ্চ পর্যায়ের ঠিকাদার। সরকারের গণপূর্ত অধিদপ্তর, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি), শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর (ইইডি), রাজউক, রেলওয়েসহ সরকারি-বেসরকারি নানা ঠিকাদারি কাজ করেন।
বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব কনস্ট্রাকশন ইন্ডাস্ট্রির (বিএসিআই) সাবেক নির্বাহী পরিষদের সদস্য নাসির ইউ মাহমুদ ২০১৫, ২০১৬ এবং ২০১৭ সালের উত্তরা ক্লাবের নির্বাচিত সভাপতি, লায়ন ক্লাবের ঢাকা জোনের চেয়ারম্যান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এস এম হল ছাত্রসংসদের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন।
এই নাসিরের বিরুদ্ধেই জোরপূর্বক মদপান করানো, ভয়ভীতি প্রদর্শন, মারধর ও ধর্ষণচেষ্টার অভিযোগ আনেন চিত্রনায়িকা পরী মণি।
অভিযোগ অস্বীকার করেন নাসির:
চিত্রনায়িকা পরী মণিকে ধর্ষণ ও হত্যাচেষ্টা মামলায় ব্যবসায়ী নাসিরউদ্দিন মাহমুদকে সোমবার দুপুরে নিজ বাসা থেকে গ্রেপ্তার করে মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ। সেখানে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে নিজের বিরুদ্ধে পরীর আনা সব অভিযোগ অস্বীকার করেন নাসির।
নিজেকে নির্দোষ দাবি করে নাসির বলেন, ‘আমি বুধবার (৯ জুন) রাতে যখন ক্লাব থেকে বের হই, তখন তাঁর পরী মণি ও তাঁর বন্ধু মদ্যপ অবস্থায় ক্লাবে প্রবেশ করেন। তাঁদের মধ্যে একটি ছেলে উশৃঙ্খল আচরণ করছিলেন। ক্লাবে ঢোকার পর আমাদের বারের কাউন্টার থেকে বড় বড় ও দামি ড্রিংকসের বোতল জোর করে নেওয়ার চেষ্টা করলে আমি বাধা দিই। এক পর্যায়ে আমি আমার নিরাপত্তাকর্মীদের ডাক দিলে তাঁরা পরী মণি ও তাঁর সঙ্গীদের নিয়ে যান।’
সবাই গেছেন ক্লাবে
পরী মণির মামলার পর পরই নড়েচড়ে বসে সাভার মডেল থানার পুলিশ। গণমাধ্যমকর্মীরা ভিড় জমান সাভার মডেল থানায়। কিন্তু দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের কেউ থানায় নেই। কোথায় গেছেন, এমন প্রশ্নের উত্তরে থানার সেন্ট্রি থেকে ডিউটি অফিসার সবার একটি বাক্য, স্যারদের সবাই ক্লাবে গেছেন। মানে ঢাকা বোট ক্লাবে গেছেন।
আলোচনায় বোট ক্লাব:
বিরুলিয়ায় তুরাগের তীরে অভিজাত ঢাকা ও উত্তরা ক্লাবের আদলে গড়ে তোলা হয় ঢাকা বোট ক্লাব নামের একটি ভবন। তুরাগ নদ দখলের অভিযোগে বিআইডব্লিউটিএ সেখানে উচ্ছেদ অভিযান চালালে কিছুদিন ক্লাবের কার্যক্রম বন্ধ থাকে। পরে প্রশাসনের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ক্লাবের পরিচালনায় যুক্ত হলে ক্লাবটিকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। আলোচিত ব্যবসায়ী নাসির ছিলেন এই ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতাদের একজন। অভিযান সোসাইটির পরিবার থেকে শুরু করে উঠতি ও নব্য ধনীদের আনাগোনা বাড়তে থাকে এই ক্লাবে। সন্ধ্যা থেকে গভীর রাত পর্যন্ত মদ্যপানে জেগে থাকে এই ক্লাব।
অভিযোগ নিয়ে ধোঁয়াশা: বেসামাল ছিলেন পরী মণি
বনানী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নুরে আজম মিয়া সাংবাদিকদের জানান, ওই রাতে পরী মণি বনানী থানায় এলেও তিনি ছিলেন বেসামাল। তাঁকে মদ্যপ অবস্থায় দেখা গেছে। এভারকেয়ার হাসপাতাল থেকে সুস্থ হয়ে থানায় এসে অভিযোগ করার অনুরোধ করা হলেও তিনি কেন থানায় আসেননি সে প্রশ্নও তোলেন এই কর্মকর্তা। তা ছাড়া ঘটনাস্থল তো বনানী থানাও নয়। সেটাও স্মরণ করিয়ে দেন ওসি।
আটককৃতদের রিমান্ড চাইবে পুলিশ:
পরী মণিকাণ্ডে আটককৃতদের পুলিশ হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি চাওয়ার কথা জানিয়ে ঢাকা জেলার পুলিশ। অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আবদুল্লাহ হিল কাফি জানান, আটককৃতদের সাভার মডেল থানায় করা মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে প্রধান দুই আসামি নাসির ও অমিকে রিমান্ড নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করবে পুলিশ।
ঢাকা বোট ক্লাবে ধর্ষণ ও হত্যা চেষ্টার অভিযোগে নাসির উদ্দিন মাহমুদের বিরুদ্ধে মামলা করেন চিত্রনায়িকা পরীমনি। সেই রাতে ঘটনার সময় পরীমনির সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন তার কস্টিউম ডিজাইনার জিমি।
সেই রাতে কি হয়েছিল তা গণমাধ্যমে তুলে ধরেছেন নায়িকার সঙ্গে থাকা কস্টিউম ডিজাইনার জিমি
পরীমনির দায়ের করা মামলায় সোমবার গ্রেফতার করা হয় মামলার প্রধান আসামি নাসির ইউ মাহমুদ ও অমিসহ ৫ জন। তাদের গ্রেফতারের পরেই রাতে বনানীর বাসায় সংবাদ সম্মেলন করেন ঢাকাই ছবির নায়িকা পরীমনি। সে সময় পরীমনির সঙ্গে থাকা কস্টিউম ডিজাইনার জিমির কাছে ঘটনা জানতে চাওয়া হয়।
গণমাধ্যমকর্মীদের প্রশ্নের উত্তরে কস্টিউম ডিজাইনার বলেন, আমার নাম জিমি। আমি ফ্যাশন ডিজাইনার। সব কথা বলার মতো সাহস সবসময় থাকে না। কথাগুলো বলার সময় হইছে। আমি সবার প্রতি কৃতজ্ঞ। সব কিছু বের হবে, সবার সামনে আসবে, আমি এটা বিলিভ করি।
তিনি বলেন, তারা আপিকে বাজেভাবে গালাগাল করল। আপি আমাকে আগেই বলেছিল যদি কখনো এমন পরিস্থিতি তৈরি হয় তাহলে ৯৯৯ নম্বরে ফোন করতে। ওরা যখন আপিকে গালাগাল করছিল তখন আমার হাত কাঁপছিল। আমি আপির মোবাইল ফোন বের করেছি, তার মোবাইলের ভেতরে ঢুকতে পারিনি। আমি আমার মোবাইল বের করে ফেলছি। বের করে ১৫ সেন্ডের একটি ভিডিও করেছি।
‘ওটা হাতে নিয়ে দেখার পরে আমাকে এসে ওনারা দুইজন অ্যাটাক করেছে। আমি আপির ফোনটা ওখানেই রেখে এসেছি। ওরা ভাবছে আপির ফোনেই ভিডিওটা করেছি। আপির ফোন উড়ায় ফেলে দিছে’।
জিমি বলেন, ওরা লাইট বন্ধ করে দিছে। এসি বন্ধ। আপির অক্সিজেন কমে আসছে। আমি ওয়েটার কে বলেছি ভাইয়া এসিটা ছাড়েন আপি শ্বাস নিতে পারছে না। ওরা আমাকে সাপোর্ট দিয়েছে। ওরা এসি ছেড়েছে। ওয়েটাররা সব পাশেই ছিল। আর এর মধ্যে ওরা চলে গেছে। ওয়েটারদের বলেছি ভাইয়া লাইটা জ্বালিয়ে দেন। তখন তো আপি নিশ্বাস নিতেই পারছিল না। হাসপাতালে নিতে হবে, অক্সিজেন দিতে হবে। ‘তখন আমি তাদের বলছি প্লিজ আপিকে ধরেন, তো আমি ধরছি আমার সঙ্গে তারাও ধরছে গাড়িতে তুলে দিছে’।
নাসিরকে মারধরের বিষয়টি জানতে চাইলে জিমি বলেন, আসলে আমি একটা গেঞ্জি আর শটর্স পরা ছিলাম। এ অবস্থায় আমাদের ঢুকতেও দিচ্ছিল না। ফোন করার পরে আমাদের ঢুকতে দেয়। আপি সেখানে উঠে বাথরুমে যায়। আমি মদপানের বিষয় বলতে, আমি তো ওনাকে চিনিও না। মারধরের বিষয়টি নিয়ে পরীমনি বলেন, ও আসলে একটা অ্যাকসিডেন্ট করেছিল। এমন একটা কাঁচা ঘাঁ নিয়ে কিভাবে মারধর করবে।