হঠ্যাৎ মনে হল কেউ যেন আমাকে ডাকছেন, পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখি পাঞ্জাবি-পায়জামা পরা ১২-১৩ বছরের একটা ছেলে। ছেলেটা আমায় সালাম দিয়ে বললো,
ভাই, আমায় লজিং রাখবেন ? আমায় দুইবেলা অল্প করে খেতে দিলেই হবে। বিনিময়ে আমি আপনাদের বাসার ছোট কিছু কাজ করে দিব পাশাপাশি আপনার সন্তানদের কুরআন শিক্ষা দিবো রাতে আমি মাদ্রাসাতেই থাকবো।
আমি মুচকি হেসে
মাওলানাকে বললাম যাদের আমরা হুজুর বলে ডাকি, আমি তো বিয়েই করিনি। ছেলে-মেয়ে কোথায় থেকে হবে? আমার উত্তর শুনে হুজুর মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো।
তারপর মনে মনে চিন্তা করে বললাম চলেন হুজুর, আপনার লজিং থাকার ব্যবস্থা করছি
কলিংবেল বাজাতেই আমার ছাত্রের বড় বোন দরজা খুললো। আমার দিকে বিরক্তি কর চোখে তাকিয়ে বললো এই টাইমে তো রাফি স্কুলে থাকে। আপনি এখন কেন পড়াতে আসলেন?
আমি তখন বললাম আমি রাফিকে পড়াতে আসিনি। আন্টির কাছে একটা কাজের বিষয়ে কথা বলতে আসছি।
ছাত্রের বোন আর কিছু না বলে চলে গেলো। আমি হুজুর ছেলেটাকে সাথে নিয়ে বাসার ভিতর বসলাম। কিছুক্ষণ পর আন্টি আসলে আমি আন্টিকে বললাম,
— আন্টি, রাফি তো আরবি পরতে পারে না এই ছেলেটা রাফিকে আরবি শিখাবে আর তার বিনিময়ে ছেলেটাকে প্রতিদিন দুইবেলা খেতে দিয়েন। ছেলেটা এতিম বাবা মা কেউ নেই। কয়েকমাস পর ছেলেটা কোরআনে হাফেজ হয়ে যাবে। আপনি না হয় ছেলেটাকে একটু সাহায্য সহযোগিতা করলেন।
আন্টি আমার দিকে ভ্রু কুচকে তাকিয়ে বললো,
-“পিয়াস, আমাদের অবস্থা খুব একটা ভালো না যে বাড়তি একটা লোকের খাওয়ার দায়িত্ব নিতে পারবো। তুমি বরং অন্য কোথাও চেষ্টা করে দেখো”
এমন সময় কাজের মেয়েটা বাহির থেকে বাসার ভিতর ঢুকলে আন্টি কাজের মেয়েটাকে রেগে গিয়ে বলতে লাগলো,
-“তোকে না বলেছিলাম লিও আর টুকির মাংসের তরকারিটা রান্না করে বাহিরে যেতে। কখন থেকে ওরা না খেয়ে আছে ”
আমি আর কিছু না বলে বাসা থেকে বের হয়ে আসলাম। রাস্তায় যখন হুজুর ছেলেটাকে নিয়ে হাটছিলাম তখন হুজুর ছেলেটাকে বললাম,
–আচ্ছা হুজুর বলেন তো, লিও আর টুকি আন্টির কে হয়?
হুজুর ছেলেটা কতক্ষণ চিন্তা করে বললো,
-” এমন নাম তো আগে কখনো শুনিনি। উনার ছেলে মেয়েই হবে হয়তো!
আমি হাসতে হাসতে হুজুর ছেলেটাকে বললাম,
– লিও আর টুকি হলো দুইটা উন্নত বিদেশি জাতের কুকুর। এই শহরের বড়লোক মানুষ গুলো প্রতিদিন বিদেশি জাতের কুকুরকে মাংস দিয়ে ভাত খাওয়াতে পারবে কিন্তু কোন এতিম বাচ্চাকে দুইবেলা ডাল ভাত খাওয়াতে পারবে না।
দুপুর থেকে বিকাল পর্যন্ত হুজুর ছেলেটাকে সাথে নিয়ে মানুষের দুয়ারে দুয়ারে ঘুরলাম অথচ কেউ ছেলেটার দুইবেলার খাওয়ার দায়িত্ব নিলো না। কেউ কেউ বললো, “যদি বাংলা পড়াতে পারতো তাহলে ভেবে দেখতাম”
সন্ধ্যার আগে আগে ছেলেটাকে সাথে নিয়ে ওর মাদ্রাসার সামনে গেলাম। মানিব্যাগ খুলে দেখি মানিব্যাগে দুইটা ১হাজার টাকার নোট আছে আর কিছু খুচরো টাকা। আমি ছেলেটার হাতে দুই হাজার টাকা দিয়ে বললাম,
— বুঝলেন হুজুর এই শহরের মানুষদের কুরআন শিক্ষার কোন দরকার নেই ওরা মনে করে ওরা মৃত্যুর পর এমনিতেই চেলচেলাইয়া বেহেশতে চলে যাবে। আমি নিজে থাকি মেসে টিউশানি করে নিজের পড়াশোনার খরচ চালায় তবুও চেষ্টা করবো প্রতিমাসে আপনায় সাহায্য সহযোগিতা করতে..
তারপর থেকে প্রতিমাসে ছেলেটাকে আমি কিছু টাকা পয়সা দিতাম। পরিচিত কয়েকজন বন্ধু বান্ধবের সহযোগিতাই ছেলেটাকে একটা হোটেলে প্রতিবেলা খাবারের ব্যবস্থা করে দিলাম।
ছেলেটা যেদিন কুরআনে হাফেজ হয়েছিলো সেদিন সর্বপ্রথম আমার সাথে দেখা করেআমায় বুকে জড়িয়ে ধরে বলেছিল “ভাই আপনি আমার জন্য অনেক করেছেন। আমি যতদিন বেঁচে থাবে ততদিন প্রতি ওয়াক্ত নামাজ শেষে আপনার জন্য দোয়া করব। কথাটা শুনে আমার চোখ দিয়ে পানি বের হয়ে গিয়েছিলো। একজন মুসলিমের এর চেয়ে বড় প্রাপ্তি আর কিছু হতে পারে না…
একটি ছোট অভিজ্ঞতা:
আমার ৪বছরের বাচ্চা ছেলেটা যখন আমার দিকে করুণ চোখে তাকিয়ে বললো,
-“বাবা, আমি আরবি শিখবো না। আমিও তন্ময় ভাইয়ার মত গান শিখবো আর জেনি আপুর মত নাচ শিখবো ”
কথাটা শুনে আমি মোটেও অবাক হয় নি বরং কিছুক্ষণ আগে যা ঘটলো তা শুধু আমার বাচ্চা ছেলের মনে প্রভাব ফেলে নি। আমার মনেও প্রভাব ফেলেছে…
আমার শ্বশুর চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পর পারিবারিক একটা অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। সেই অনুষ্ঠানে উনার সকল ছেলেমেয়েরা আসে।
সন্ধ্যার পর আমরা সবাই মিলে যখন কথাবার্তা বলছি তখন আমার ছোট সালা বাচ্চাদের জন্য একটা প্রতিযোগিতার আয়োজন করে। সেই প্রতিযোগিতায় বাচ্চারা যে যা পারে সেটা তারা করে দেখাবে। আমার ছেলেকে প্রথম ডাকলে আমি আমার ছেলের কানে কানে বলি,
–বাবা, তুমি সূরা ফাতিয়া খুব সুন্দর করে পাঠ করবে কেমন?
আমার ছেলে যখন সূরা পাঠ করছিলো তখন কেউ সেটা মনোযোগ দিয়ে শুনছিলো না। সবাই যার যার মত ফোন টিপছিলো, কথাবার্তা বলছিলো। কিন্তু আমার স্ত্রী শ্রাবণীর বড় বোনের ৬ বছরের ছেলেটা যখন মাইয়া ও মাইয়ারে তুই অপরাধীরে এই গানটা গাইছিলো তখন সবাই অনেক মনোযোগ দিয়ে শুনছিলো। কেউ কেউ গানের সাথে সুর মেলাচ্ছিল। গান শেষে সবাই করজোড়ে হাততালি দিলো। কেউ কেউ জড়িয়ে ধরে চুমু খেলো। শ্রাবণীর বড় ভাইয়ের ৮ বছরের মেয়েটা যখন ও সাকি গানের সাথে নাচ করছিলো তখন ওর সাথে উপস্থিত অনেকেই নাচছিলো। হেসে খেলে খুব মজা করছিলো।
এটা দেখেই আমার বাচ্চা ছেলেটার মন খারাপ হয়ে গেলো। সে মনে মনে হয়তো ভাবছে, সে গান নাচ পারে না দেখে তাকে কেউ আদর করে নি…
রাতে খাবার টেবিলে বসে যখন সবাই খাচ্ছিলাম তখন শ্রাবণীর বড় ভাই আমার দিকে তাকিয়ে বললো,
-“তুমি নিজে হলে কাঠমোল্লা আর আমার ছোট বোনটাকেও বানালে তোমার মতো। এই গরমের ভিতর দেখি তুমি আমার বোনটাকে আলখাল্লা পরিয়ে নিয়ে এসেছো। এইভাবে নাকমুখ ঢেকে চলাচল করলে দম আটকে তো মরে যাবে। ছেলেটাকে তোমাদের মত না বানিয়ে ক্রিয়েটিভ কিছু শিখাও”
আমি ঘাড় নেড়ে শুধু বললাম,
–জ্বি আচ্ছা
শ্রাবণীর বড় বোন তখন বললো,
-” আমার ছেলের গানের মাস্টারকে প্রতি মাসে ৫ হাজার টাকা করে দিতে হয়। আমি তো শ্রাবনীকে সব সময় বলি তোর ছেলেকেও একটা গানের টিচার রেখে দে। কিন্তু শ্রাবণী তো আমার কোন কথায় শুনে না।”
কথাটা শুনে শ্রাবণীর বড় ভাই আমায় খোঁচা দিয়ে বললো,
-” গানের টিচার রাখলে তো পিয়াসের টাকা নষ্ট হবে। তাই সে ও ওর ছেলেকে ওর মত কাঠমোল্লা বানাবে। বিয়ের পর দেখলাম না কখনো আমার বোনকে দামি কিছু কিনে দিতে ”
কথাগুলো কেন জানি সহ্য করতে পারছিলাম না তাই মৃদু হেসে শ্রাবনীর বড় ভাইকে বললাম,
— ভাই, আপনি মারা গেলে আপনার মেয়ে প্রতিদিন আপনায় স্মরণ করে সাকি সাকি গানের তালে তালে নাচবে। এতে কি আপনার কবরের আজাব কমবে না বাড়বে সেটা আমি ঠিক জানি না
আর তারপর শ্রাবণীর বড় বোনের দিকে তাকিয়ে বললাম,
— আপা, আপনি মারা গেলে আপনার ছেলে প্রতিদিন আপনার কবরের সামনে গিয়ে অপরাধী গান শুনিয়ে আসবে। এতে মনে হয় কবরের আজাবটা দ্বিগুন বৃদ্ধি পাবে। তখন শুধু এটাই বলবেন, যদি ছেলেকে ৫ হাজার টাকা খরচ করে গান না শিখিয়ে ৫০০টাকা খরচ করে একটু কুরআন শিক্ষা দিতাম তাহলে কবরে আমার এতটা আজাব হতো না..
আমি মারা গেলে না হয় আমার কাঠমোল্লা ছেলে কবরে পাশে দাড়িয়ে একটু দোয়া করে আসবে। এতে নিশ্চয়ই আমার কবরের আজাব পুরোটা না কমলেও কিছুটা হলেও কমনে
আমার কথাগুলো শুনে সবাই মাথা নিচু করে চুপ করে রইলো আর কিছু না বলে নিজের প্লেটে থাকা খাবারটা শেষ করলাম…
—
—–
রাতে ঘুম আসছিলো না তাই বেলকনিতে দাঁড়িয়ে ছিলাম। হঠাৎ শ্রাবণী পিছন থেকে আমার কাঁধে হাত রেখে বললো,
-” ভাইয়া আপুর কথায় কিছু মনে করেছো কি?”
আমি হেসে বললাম,
–আরে না, আচ্ছা আমি যে তোমায় দামী কিছু কিনে দিতে পারি না এজন্য কি আমার প্রতি তোমার কোন অভিযোগ আছে?
শ্রাবণী আমায় শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললো,
-” তোমার মত একজনকে আমি পেয়েছি এটাই আমার জীবনের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি। আমার আর কিছু চাই না”
সংগৃহিত:
মোশারফ হোসেন সুজন ফেসবুক টামটাইন থেকে