মাদকে বিভ্রম ঘটেছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হাফিজুর রহমানের। তারপর মানসিক ভারসাম্যহীনের মতোই হলের মাঠ থেকে দৌড়ে বেরিয়ে যান। একাধিক রিকশাচালকের পা চেপে ধরে ক্ষমা চান। একপর্যায়ে ফুটপাথে থাকা ডাবওয়ালার কাছ থেকে দা নিয়ে নিজের গলায় আঘাত করেন হাফিজুর। পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ওইদিন রাতেই তার মৃত্যু হয়। এই ঘটনার তদন্ত করতে গিয়ে প্রকাশ পেয়েছে চাঞ্চল্যকর তথ্য। ভয়ঙ্কর এক মাদকে আসক্ত ছিলেন হাফিজ। এলএসডি (লাইসার্জিক অ্যাসিড ডাইইথ্যালামাইড)।
সারা বিশ্বে এটি অত্যন্ত ভয়ঙ্কর মরণনেশা হিসেবে পরিচিত। এই মাদক সেবনে বুঁদ হয়ে ভিন্ন এক দুনিয়ায় বিচরণ করেছিলেন হাফিজ। তারপর নিজেই নিজের গলায় দা দিয়ে আঘাত করেন। রক্ত ঝরতে থাকে। তবুও নিজের জন্য একটুও মায়া জন্মেনি তার। শেষ পর্যন্ত মৃত্যু ঘটে ঢাবি’র এই ছাত্রের। এমনটিই ধারণা করছেন তদন্ত সংশ্লিষ্টরা। গত বুধবার রাতে ধানমণ্ডি ও লালমাটিয়া এলাকায় পৃথক অভিযান চালিয়ে ভয়ঙ্কর মাদক এলএসডি উদ্ধারের মধ্যে দিয়ে এমন ধারণা জন্ম নিয়েছে। তবে তা নিশ্চিত হতে প্রয়োজন আরো তদন্ত। এ বিষয়ে গতকাল সংবাদ সম্মেলন করেছে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)।
সূত্র জানায়, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে হাফিজুরের দুই বন্ধু এলএসডি মাদক সেবনের কথা জানালে এর উৎস খুঁজতে গিয়ে এই চাঞ্চল্যকর মাদকের তথ্য উঠে আসে। সেই সূত্র ধরে বুধবার রাতে ধানমণ্ডি ও লালমাটিয়া এলাকায় পৃথক অভিযান চালিয়ে এলএসডিসহ সাদমান সাকিব ওরফে রূপল, আসহাব ওয়াদুদ ওরফে তূর্য এবং আদিব আশরাফ নামে তিন শিক্ষার্থীকে আটক করে ডিবি পুলিশের রমনা বিভাগের সদস্যরা। এ সময় তাদের কাছ থেকে ২০০ ব্লট এলএসডি উদ্ধার করা হয়। যার মূল্য আনুমানিক ছয় লাখ টাকা। ভয়ঙ্কর এই মাদক সম্পর্কে গোয়েন্দা সূত্র জানায়, এলএসডি ব্লট আকারে পাওয়া যায়। যা খুব ছোট কাগজের টুকরো সদৃশ মাদক মিশ্রিত বস্তু।
আটককৃতদের একজন সাদমান জিজ্ঞাসাবাদে জানান, তিনি নেদারল্যান্ডস থেকে মেইল ও চিঠির মাধ্যমে ডাক টিকিটের মতো দেখতে এই মাদক ৮০০-১০০০ টাকায় একটি ব্লট কেনেন।
নেদারল্যান্ডসের এক নাগরিকের সঙ্গে টেলিগ্রাম অ্যাপসে যোগাযোগ করে অনলাইনভিত্তিক অর্থ লেনদেন ব্যবস্থা পেপালের মাধ্যমে টাকার লেনদেন হয়। ভয়ঙ্কর এই মাদকদ্রব্য ‘আপনার আব্বা’ নামে সাদমানের একটি ফেসবুক পেজের মাধ্যমে বিক্রি করা হতো। এ ছাড়া সাদমান, ‘বেটার ব্রাওয়ারি অ্যান্ড বিওয়ন্ড’ নামে একটি ফেসবুক গ্রুপ পরিচালনা করেন বলে জানা গেছে। যার সদস্য সংখ্যা প্রায় এক হাজার। সাদমান, আসহাব ও আদিব এই তিনজন মিলে ফেসবুক গ্রুপের মাধ্যমে এলএসডি বিক্রি করতো। তারা গাঁজা পাতার নির্যাস দিয়ে ‘গাঁজা কেক’ তৈরি করে অনলাইনে বিক্রি করতো।
সাদমানের দেয়া তথ্যমতে, আসহাব ও আদিবকে আটক করা হয়। আটককৃতরা জিজ্ঞাসাবাদে এলএসডির প্রভাব সম্পর্কে জানায়, এলএসডি সেবন করলে যে কারো মাথা ভার হয়ে যাবে। হ্যালুসিনেশন দেখা দেবে। সেবনকারী অত্যন্ত হিংসাত্মক ও আক্রমণাত্মক আচরণ করে। একটি এলএসডি ব্লট সেবন করলে আট থেকে ১২ ঘণ্টা পর্যন্ত এর প্রতিক্রিয়া থাকে। অতিরিক্ত সেবনে ২০ ঘণ্টা পর্যন্তও প্রতিক্রিয়া হয়।
ওই ব্লটগুলো এক ধরনের এসিড থেকে তৈরি। এটা জিহ্বার নিচে বা উপরে দিয়ে সেবন করার পরে সেটা তরল হয়ে শরীরে প্রবেশ করে। একপর্যায়ে তার ক্ষতিকর প্রভাব শুরু হয়। ডিবি পুলিশ জানিয়েছে, এলএসডি দামি একটি মাদক। এলএসডি মেশানো এক-একটি ছোট ছোট টুকরো ব্লটিং পেপারের দাম কয়েক হাজার টাকা। ভারতের এক অভিনেতা মৃত্যুর পর এই মাদকটি আলোচনায় আসে। কিন্তু এটি আমাদের দেশে নতুন। দামের বিবেচনায় এটি সাধারণত উচ্চবিত্তের মাদক। প্রতি ব্লট বিক্রি করা হতো তিন থেকে পাঁচ হাজার টাকায়। বিশেষ করে কলেজ ওবিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী পর্যায়ে ক্রেতাদের তথ্য পাওয়া গেছে।
ঢাবি শিক্ষার্থী হাফিজুর রহমানের বন্ধুদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে ঢাবির আইবিএ বিভাগ থেকে বহিষ্কৃত ছাত্র সাদমানকে ধানমণ্ডির একটি বাসা থেকে আটক করা হয়। তিনি বর্তমানে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে বিবিএ’র শিক্ষার্থী। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তদন্ত সংশ্লিষ্টদের কাছে শিক্ষার্থী হাফিজুরের বন্ধুরা জানিয়েছে, এর আগেও হাফিজুর তার বন্ধুদের সঙ্গে এই মাদক গ্রহণ করেছেন।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা উপজেলার খাড়েরা গ্রামের ইমাম মুজিবুর রহমানের ছেলে হাফিজুর। ঈদের একদিন পরে গ্রামের বাড়ি থেকে জরুরি কাজের কথা বলে ঢাকায় চলে আসেন। এরআগে সন্ধ্যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় এক প্রতিবন্ধী রিকশাচালকের সঙ্গে সামান্য কারণে বাজে আচরণ করেছিলেন হাফিজুর। সূত্র জানায়, গত ১৫ই মে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যবিজ্ঞান ও গ্রন্থাগার ব্যবস্থাপনা বিভাগের ছাত্র হাফিজুর ও তার বন্ধুরা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হল এলাকায় এলএসডি সেবন করছিলো। এর প্রতিক্রিয়া শুরু হলে তিনি শুধু একটি শর্টপ্যান্ট পরে সেখান থেকে বেরিয়ে যান।
ভয়ঙ্কর মাদক এলএসডি গ্রহণের পর তার সঙ্গে থাকা বন্ধুদের একজন হাফিজুরকে নেশার ঘোরে হঠাৎ বলেন, ‘তুমি কাজটা ভালো করোনি মামা’। এর কিছুক্ষণ পর হাফিজুর কার্জন হলের মাঠ থেকে দৌড়ে বেরিয়ে যান। এ সময় বন্ধুরা প্রথমবার তাকে ধরে এনে বসায়। এরপর আবার দৌড়ে বেরিয়ে যান।
দৌড়ানোর একপর্যায়ে সামনে থাকা একাধিক রিকশাচালকের পা চেপে ধরে বলেন, আমার ভুল হয়েছে, মাফ করে দাও। এভাবে কিছুক্ষণ চলতে থাকার পর ফুটপাথে থাকা ডাবওয়ালার কাছ থেকে দা নিয়ে নিজের গলা কেটে ফেলেন হাফিজুর। এ সময় বন্ধুরা রক্ত দেখে ভয় পেয়ে ঘটনাস্থল থেকে চলে যায়। এদিকে ঢামেকে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ওইদিন রাত ৯টা ৪০ মিনিটে তার মৃত্যু হয়। এর আট দিন পর ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গে হাফিজুরের ভাই তার লাশ শনাক্ত করেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ভয়ঙ্কর মাদক এলএসডি সেবনে এক ধরনের হ্যালুসিনেশন তৈরি হয়। চোখের সামনে দেখা বিষয়গুলোর অনবরত রঙ পরিবর্তন হতে থাকে। কখনো কখনো জীবনে ঘটে যাওয়া অনেক ঘটনা অনেকটা টেলিভিশনের মতো স্লোমোসনে চোখের সামনে দেখতে পায়। হতে পারে সেটা গভীর কোনো দুঃখের ঘটনা। এলএসডি ড্রাগ মস্তিষ্কে এমন এক প্রভাব সৃষ্টি করে যা হ্যালুসিনেশনে (সম্মোহন) সাহায্য করে। ফলে যারা এই ড্রাগ ব্যবহার করে তারা বিভিন্ন রকম রঙ এবং আকৃতির জিনিস দেখে, যার অস্তিত্ব পৃথিবীতে নেই।এ ছাড়া এই ড্রাগ মানব মস্তিষ্কের এমন সব স্নায়ুর কার্যক্ষমতা বাড়িয়ে দেয় যা অনেক সময় অতীত স্মৃতি মনে করিয়ে দেয়। এমনকি এই ড্রাগ মানুষকে তার জন্মকালীন স্মৃতিও মনে করাতে সক্ষম.
এ ছাড়াও এলএসডি ড্রাগ প্রচণ্ড উত্তেজনার সঙ্গে এই মাদক চিন্তা, অনুভূতি ও পারিপার্শ্বিক চেতনাকে পরিবর্তন করে দেয়। ১৯৩৮ সালে সুইস রসায়নবিদ আলবার্ট হফম্যান প্যারাসাইটিক ফাঙ্গাস নিয়ে কাজ করতে গিয়ে এলএসডি আবিষ্কার করেন। আবিষ্কারের প্রথমদিকে এলএসডি ওষুধ হিসেবে ব্যবহার হতো। তবে ওষুধটি মস্তিষ্কের ক্ষতি করে বলে একে নিষিদ্ধ করা হয়।
এ বিষয়ে ডিবি’র অতিরিক্ত কমিশনার এ কে এম হাফিজ আক্তার বলেন, ভয়ঙ্কর এই মাদকের সঙ্গে জড়িত ক্রেতাদের তদন্ত সাপেক্ষে চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেয়া হবে। এটার সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর মৃত্যুর কোনো যোগসূত্র আছে কি না সে বিষয়ে অধিকতর অনুসন্ধান করে দেখা হচ্ছে। এ ছাড়া দেশে এলএসডির সাপ্লাই বন্ধ করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানান তিনি।