রাত পৌনে এগারোটা। গুলশান থানা। কোথাও কেউ নেই। গাড়ির জানালা খুলতেই দেখলাম পুলিশ ভ্যানে করে একটি লাশ ঢুকছে। সেই লাশের পিছু নিয়ে থানায় ঢুকলাম। এর মধ্যে কানাঘুষা হচ্ছে বসুন্ধরার এমডির গার্লফ্র্রেন্ড আত্মহত্যা করেছে। অবশ্য এমন একটি তথ্য জেনেই ঘটনাস্থলে যাচ্ছিলাম। ভাগ্যক্রমে ঘটনাস্থলে যাওয়ার আগেই ঘটনা আমার কাছে হাজির। থানায় ঢুকেই শুনেছি কয়েকজন কনস্টেবল বিষয়টি নিয়ে নিজেদের মধ্যে কথা বলছেন। তাদের সঙ্গে আমিও গিয়ে যোগ দিলাম। কিন্তু তারা নিশ্চিত কিছু বলতে পারছেন না। শুনা কথার মতো কথা বলছেন।
রাত সাড়ে এগারোটা। রিপোর্টার বলতে সেখানে আমিই উপস্থিত। এর মধ্যে কথা হয় থানার ওসি তদন্তের সঙ্গে। সে দেখি এই বিষয়ে খুব আগ্রহী। নিজেই এসে আমার সঙ্গে কথা বলছেন। আর কোনো টিভি চ্যানেল আসছে কীনা জিঙ্গেস করছেন। তখনো সে বিষয়টি সম্ভবতো অনুধাবন করতে পারেনি বেচারা। ভাবতে পারিনি কি ঘটতে যাচ্ছে।
ঘটনা যত সময় নিচ্ছে, থানার পরিবেশ তত পিনপতন নীরবতা বাড়ছে। এই নীরবতা, কিছু চাপিয়ে যাওয়ার বা গোপন করার নীরবতা। রাত যত বাড়ছে ,একেক করে পুলিশের উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা থানায় ঢুকছে। রিপোর্টাররাও আসা শুরু করেছে। মজার ব্যপার হচ্ছে দুই তিনটি চ্যানেলের অ্যাসাইমেন্ট ছিলো প্রতিষ্ঠানের মালিক পর্যায়ের। তারা তখন নিয়মিত আপডেট দিচ্ছে তাদের বসের বসদের। কিন্তু কিছুই অনএয়ার হচ্ছে না। বলে রাখা ভালো কয়েকজন রিপোর্টার এসে আবার চলেও গেছেন। তাদের ধারণা এটা বিশেষ কিছু বহন করবে না। বরং ঘটনা নিয়ে গেলেও অনএয়ার হবে না। তার চেয়ে বরং চলে যাওয়া ভালো। আমাকেও চলে যেতে বলছিলো তারা। তবে আমি নাছোড়বান্দা। আমি আর ডিবিসির জাহিদ ভাই রয়ে গেলাম। আমার উদ্দেশ্য অনএয়ার হোক বা না হোক আমি ঘটনার শেষটা দেখতে চাই ।
মানবজমিনের সম্পাদক প্রিয় মতি ভাই সবসময় একটা কথা বলতেন, ‘সব রিপোর্ট হয়তো প্রকাশ করা যায় না, কিন্তু রিপোর্টারদের সময় একদিন আসেই। তাই ডকুমেন্টস যতœ করে রেখে দিতে হয়।’ যা হোক, আমি ঘটনার শেষ দেখতে চেয়েছিলাম। তাই ঘন্টার পর ঘন্টা বসে ছিলাম।
এর মধ্যে থানার ভিতর যাচ্ছি, বের হচ্ছি। এভাবে পায়চারি করছি। কিন্তু কেউ কোনো কথা বলছেন না। না ভুক্তভোগী,না পুলিশের কেউ। ওই যে বলছিলাম ,ওসি তদন্ত খুব আগ্রহী ছিলো, সেও দেখি এখন আর তেমন একটা পাত্তা দিচ্ছে না। আমাকে এড়িয়ে চলছে। থানার ভিতর বাহির হওয়ার ধারাবাহিকতায় আরো একবার ভিতরে ঢুকে দেখলাম বসুন্ধরার এমডির সাথে ওই তরুণীর একটি ছবির অ্যালবাম পুলিশের কাছে। বাসায় টানানো দুই জনের একটি বড় ছবি। দু’টি ফোন। বাসা থেকে পুলিশ জব্দ করেছে এগুলো। এই ছবি দেখার পর, এবার আমার পুরোপুরি বিশ^াস হলো,ঘটনা ঠিক। তখনো এই বিষয়ে রিপোর্টার’রা পুরোপুরি কনর্ফাম না। এই ছবি দেখে লোভ সামলাতে পারলাম না। ফোনের ক্যামেরাটা বের করলাম ,ছবি তুলার জন্য। কিন্তু বিষয়টি টের পেয়ে পুলিশ সদস্যরা ছবিগুলো তরিগরি করে ওসি তদন্তের কক্ষে নিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলো। একধরনের সিলগালা। আমি আর ছবি নিতে পারিনি।
এদিকে এই সময়টা ধরে ওই তরুণীর বড়বোনকে দেখছি, এক কক্ষ থেকে আরেক কক্ষে পুলিশের সঙ্গে ছুটাছুটি করছে। সাথে ভুক্তভোগীর বন্ধুবান্ধবরা। কিন্তু কেউ কোনো কথা বলছে না। মিডিয়া দেখলেই দৌড়ে চলে যাচ্ছে, এড়িয়ে যাচ্ছে। কিন্তু অন্যসব এমন ঘটনার উল্টো চিত্র। ভুক্তভোগীর পরিবার গণমাধ্যমের সঙ্গে স্বেচ্ছায় কথা বলতে চায় এটাই স্বাভাবিক। তবে তাদের দেখে কখনোই স্বাভাবিক মনে হয়নি। যতেষ্ট আতঙ্ক ছিলো তাদের মধ্যে।
এদিকে গুলশান জোনের পুলিশ সকল কর্মকর্তারা থানায় হাজির। ঘন্টার পর ঘন্টা মিটিং করছে। কিন্তু কোনো সমাধান হয়তো তারা কেউ পাচ্ছেন না। কোনো কোনো কর্মকর্তা বাইরে বের হয়ে এদিক ওদিক গিয়ে ফোনে কথা বলছিলেন। পরিস্থিতি ঘটনাস্থলে না থাকলে বুঝা যাবে নাহ। তবে একটা বিষয় আমি কনর্ফাম ছিলাম, পরিবার মামলা করতে চাচ্ছে, কিন্তু পুলিশ চিন্তায় আছে। তারওপর আমরা বেশকয়েকজন গণমাধ্যমকর্মী রয়েছি। স্টোরী অনএয়ার হোক বা হোক আমরা উপস্থিত থাকা কিন্তু তাদের জন্য একটু বাড়তি চাপ ছিলো। সেটা বুঝাই যাচ্ছিলো। তার মানে, দেশের এতো বড় একজন ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে মামলা করতে চাচ্ছে পরিবার। কিন্তু পুলিশ স্বিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে? ঠিক ঠাহর করতে পারছিলাম না। তবে এই ঘটনায় কিন্তু স্পষ্ট বার্তা দেয়,দেশে আইন সবার জন্য সমান নয়। অন্য কেউ হলে কিন্তু বড়কর্তারা থানায় এসে মিটিং করতেন না। যা হোক বুদ্ধিজীবি টাইপের কথা বাদ দেই।
এসব ঘটনা দেখে রিপোর্টারদের মধ্যেও কানাঘুষা হচ্ছে। আসলে কি করতে যাচ্ছে পুলিশ? মামলা নিবে নাহ? সমঝোতা হয়ে যাবে? টাকার বিনিময় সমাধান হয়ে যাবে? এসব প্রশ্ন মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিলো। কথার ফাকে এক এসআই রাত দুইটায় এসে বলছেন, মামলা হয়েছে। খবর দিয়ে দেন অফিসে। এই কথা শুনার পর সবাই যেন আকাশ থেকে পড়লো, এমডির বিরুদ্ধে মামলা! ক্ষণিকের মধ্যেই পিনপতন নীরবতা ভেঙ্গে থানায় যেন প্রাণ ফিরে এলো। সকল জল্পনা কল্পনা শেষ হলো। কিন্তু তখনো ভুক্তভোগীর পরিবার কথা বলতে চাইলেন না। বন্ধুবান্ধব ও পরিবারের লোকজন আলাদা আলাদা করে বের হয়ে গেলেন। যেন গণমাধ্যমের কেউ টের না পায়। সবার মধ্যে একধরনের চাপা আতঙ্ক। আমার অপেক্ষা করছি ভুক্তভোগীর বড় বোনের জন্য। যিনি এই মামলায় বাদী। মিনেট পাচেক পরেই বের হলেন তিনি। তিনিও কোনো কথা বলছেন না। তার চোখেমুখে আতঙ্কেও ছাপ! কি এমন আতঙ্ক? তারপরও তাকে আমরা ধরার চেষ্টা করলাম। কেউ কোনো কথা বলছেন না। তাকে বল্লাম, আপনি কি আপনার বোনের হত্যার বিচার চান না? তখন তিনি একটু নরম হয়ে কথা বলতে চাইলো,কিন্তু তার সঙ্গে লোকটি তাকে জোর করে গাড়িতে তুলে ফেলেন। ফলে তার ইচ্ছে থাকা সত্বেও তার বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি।
এতক্ষনে সকল টেলিভিশন চ্যানেল গুলশান থানায় হাজির। কারো কারো চোখে মুখে ঘুম স্পষ্ট ছিলো। সবশেষ,গুলশান জোনের ডিসি বীরের মতো ব্রিফিং করে, জানিয়ে দিলো, বসুন্ধরা গ্রুপের এমডি সায়েম সোবাহান আনভীরের বিরুদ্ধে আত্মহত্যা প্ররোচনা অভিযোগে মামলা দায়ের করেন ভুক্তভোগীর পরিবার। ডিসি বীরের মতো ব্রিফিং করলেও , পিছনের গল্পটা অন্য। হয়তো কোনো গ্রীন সিগনালের জন্য তিনি অপেক্ষা করেছিলেন। এবং সেটা তিনি পেয়েছে। সব শেষ করে রাত তিনটা অফিসে ফিরলাম। স্টোরী রেডি করে সকাল আট’টায় অনএয়ার। আত্মহত্যা প্ররোচনা ঘটনায় বসুন্ধরার এমডির বিরুদ্ধে মামলা। টেলিভিশন হিসেব আমরাই প্রথম বিষয়টি অনএয়ার করেছি।
লেখক: ব্রডকাস্ট জার্নালিস্ট ইনডিপেনডেন্ট টিভি।