এক বছরের বেশি সময় ধরে করোনায় বিপর্যস্ত জনজীবন। নানা বিধিনিষেধে বন্দি মানুষ। মহাসংকটে অনেকের জীবিকা। এক বছরের মাথায় পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলেও ফের দ্বিতীয় ঢেউয়ে এলোমেলো সবকিছু। সংক্রমণ ও মৃত্যু বাড়ায় কঠোর লকডাউনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। প্রথম দফায় ৯ দিনের ‘লকডাউনের’ পর এখন আরো দুই সপ্তাহের কঠোর বিধিনিষেধ চলছে।
এই লকডাউন চলাকালে সংক্রমণ পরিস্থিতি কিছুটা কমে এসেছে বলে মনে করা হচ্ছে। এখন দৈনিক কিছুটা কম রোগী শনাক্ত হচ্ছে। তবে প্রাণহানি এখনো শতকের কাছাকাছি। সংক্রমণ পরিস্থিতিতে কিছুটা লাগাম টানা গেলেও মানুষের জীবিকার প্রশ্নটি এখন সামনে।
লকডাউনের কারণে অনেকে কাজ হারিয়ে বসে আছেন ঘরে। কাজ না থাকায় খাদ্য সংকটে পড়েছেন অনেকে। সরকারিভাবে বড় কোনো সহায়তা কার্যক্রম না থাকায় খেটে খাওয়া মানুষ বেশি বিপাকে পড়েছেন এই লকডাউনে। এ অবস্থায় সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে দেশব্যাপী লকডাউন কতদিন চালু রাখা যাবে বা এর বিকল্পই বা কী হবে এ নিয়ে নানা আলোচনা রয়েছে। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও অর্থনীতিবিদরা বলছেন, লকডাউন দিতে হবে এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার কোনো বিকল্প নেই। স্বাস্থ্যবিধি কঠোরভাবে মেনেই জীবন-জীবিকা স্বাভাবিক রাখতে হবে।
এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোকে কার্যকর ভূমিকা রাখতে হবে। জনগণকে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। একইসঙ্গে দেশের উৎপাদন ও অর্থনীতি সচল রাখতে হলে ব্যবসা-বাণিজ্যও চালু রাখতে হবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই মুহূর্তে করোনার টিকা একটি বড় অস্ত্র। দেশে টিকাদান কর্মসূচি সফলভাবে চলছে। সামনে এটি আরো জোরদার করতে হবে।অধিকাংশ মানুষ টিকা গ্রহণ করলে করোনার প্রকোপ এমনিতে কমে আসবে। এজন্য টিকা প্রয়োগে সব ধরনের অনিশ্চয়তা দূর করতে হবে।
প্রয়োজনে টিকা কূটনীতি জোরদার করতে হবে। রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা এবং সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, লকডাউন নয়। করোনার সংক্রমণ রোধে সরকার কিছু বিধিনিষেধ জারি করেছে। এর আগে সভা সমাবেশ ও বিয়ের অনুষ্ঠানসহ বিভিন্ন স্থানে জনসমাগম বন্ধ করতে বলেছে। আমাদেরকে এসব দীর্ঘ সময় মেনে চলতে হবে। তবে করোনার ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলোকে শনাক্ত করতে হবে। কম ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় এসব বিধিনিষেধ কিছুটা শিথিল করা যেতে পারে। তবে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় কঠোর হতে হবে। সেখানে চলমান বিধিনিষেধ দীর্ঘ সময় চলতে পারে। সেটা এলাকাভেদে হতে পারে। সেক্ষেত্রে ওইসব এলাকায় বিধিনিষেধ বাস্তবায়নে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। তা না হলে করোনার সংক্রমণ আরো বাড়তে পারে।
দীর্ঘ সময় এসব বিধিনিষেধ চললে মানুষকে সাহায্য-সহযোগিতা দিতে হবে। মানুষ যাতে সহযোগিতা পেয়ে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলাচল করতে পারে। কম ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় মানুষজন সামাজিক দূরত্ব মেনে, স্বাস্থ্যবিধি বজায় রেখে কাজকর্ম করলে করোনা ছাড়ানোর সম্ভাবনা কমবে। তবে করোনার সংক্রমণ রোধে সরকারের বিধিনিষেধ কার্যকর করতে হলে সম্মুখসারির যোদ্ধা ও যারা কর্মহীন হয়ে পড়েছেন তাদেরকে সরকারি সহায়তা দিতে হবে। কর্মহীনদের সহায়তা দিতে না পারলে তারা স্বাস্থ্যবিধি না মেনেই চলাচল করবে এতে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বাড়াবে। তিনি বলেন, যারা এখনো আক্রান্ত হয়নি তাদের মধ্যে করোনা নিয়ে অনীহা দেখা দিয়েছে। তারা স্বাস্থ্যবিধি মানতে চাইছেন না। ফলে চলতি সময়ে তরুণদের মধ্যে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়তে দেখেছি।এমনভাবে চলতে থাকলে দেশে আবার করোনার তৃতীয় ঢেউ আসবে। কাজেই আমাদের সবাইকে আরো বেশি সচেতন হতে হবে।
বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ আবাসিক মিশনের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, দেশে চলমান লকডাউন বেশি দিন চললে নিম্নআয়ের মানুষের ভোগান্তি বাড়বে। তারা তো কাজকর্ম না করলে খেতে পারবে না। তাদের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে হবে। করোনাভাইরাসের চলমান পরিস্থিতিতে লকডাউনের বিকল্প হচ্ছে দ্রুত সময়ের মধ্যে মানুষকে টিকা দেয়া নিশ্চিত করা। ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ মানুষের মধ্যে টিকা দেয়া সম্ভব হলে ঝুঁকি অনেকটা কমে যাবে। এছাড়া যেসব এলাকায় সংক্রমণ বেশি সেক্ষেত্রে লোকাল এরিয়া ভিত্তিক লকডাউন দেয়া যেতে পারে। যেমনটা ২০২০ সালে শুরু করেছিল। যদিও বাস্তবায়ন অনেকটা কঠিন।
লকডাউনের বিকল্প হচ্ছে সংক্রমণের গতি কমানো, আর এই গতি কমাতে হলে সরকারি বেসরকারি সকল পর্যায়ে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে, মাস্ক পরা ও হাত ধোয়া নিশ্চিত করতে হবে। জনসমাগম থেকে বিরত থাকতে হবে। সবাই স্বাস্থ্যবিধি মানলে লকডাউনের প্রয়োজন হয় না। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ও অর্থনীতিবিদ ড. নাজনীন আহমেদ লকডাউন পরিস্থিতি নিয়ে তার মতামতে বলেন, করোনার প্রাদুর্ভাবে মৃত্যুর হার ১০ থেকে ১৫। বাকি ৮৫ ভাগ সুস্থ হয়ে যাবে। কিন্তু দারিদ্র্যের কশাঘাতে অপুষ্টির শিকার হলে ধুঁকে ধুঁকে মরতে হবে অনেককে। লকডাউনে সচ্ছল ধনি মানুষ তার বড় বাসায় সোশ্যাল ডিসট্যান্স মানতে পারে, কিন্তু ঝুপড়ি ঘরে থাকা মানুষগুলো লকডাউনে একে অন্যের সঙ্গে গাদাগাদি করে থাকতে বাধ্য হয় দিনের বেশিরভাগ সময়।
লকডাউন দিলে মৃত্যুঝুঁকি কমানোর দরুন শান্ত্তিতে থাকে সচ্ছল মানুষ। কিন্তু ক্ষুধার যন্ত্রণায় ভোগা মানুষদের জন্য লকডাউন কোনো শান্তির বার্তা আনে না। বরং তারা করোনার ঝুঁকি নিতে রাজি, কিন্তু আশু ক্ষুধার যন্ত্রণায় ভুগতে রাজি নয়। লকডাউনে কল কারখানা খোলা রাখার অনুমতি যারা নিতে পেরেছে তারাই আবার প্রণোদনার অর্থ বেশি আদায় করতে পেরেছে। আর লকডাউনে যাদের কলকারখানা বন্ধ রাখতে হয়েছে এদের বেশিরভাগই বঞ্চিত হয়েছে কোনোরকম প্রণোদনা পেতে। ধনি দেশগুলোর পক্ষে লকডাউন কার্যকর করা সম্ভব, কিন্তু স্বল্পআয়ের দেশে লকডাউন কার্যকর করা কঠিন।
তাই স্বল্পোন্নত দেশে লকডাউন দিয়ে দীর্ঘমেয়াদে স্বাস্থ্য ঝুঁকি কমানো যাবে না। করোনার কারণে শিক্ষায় যে ধনি-দরিদ্র বৈষম্য তৈরি হয়েছে তাতে ভবিষ্যৎ আয় বৈষম্য আরো বাড়তে পারে।? লকডাউন ধনি-বান্ধব, দরিদ্রবান্ধব নয়। সরাসরি খাদ্য সহায়তা দিয়ে অতি দরিদ্রদের হয়তো বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব কিন্তু ছোট ছোট শিল্প উদ্যোগগুলো ধ্বংস হলে সেগুলো আবার গড়ে তোলা মুশকিল। জীবন-জীবিকার সমন্বয়ে বাঁচতে হলে ভাবতে হবে, এখনই নিতে হবে অন্তত এক বছরের সার্বিক পরিকল্পনা। নয়তো বারবার লকডাউনের অপচয়ে পড়ে অর্থনৈতিক ক্ষতির বোঝা বাড়বে।স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও অর্থনীতিবিদদের পর্যালোচনা ও পরামর্শ ছাড়াও করোনা সংক্রান্ত জাতীয় পরামর্শক কমিটির তরফেও এর আগে লকডাউন নিয়ে নানা পরামর্শ দেয়া হয়েছে।
শুরুতে সংক্রমণ কমাতে জোনভিত্তিক লকডাউন দেয়ার পরামর্শ ছিল। করোনার প্রথম ঢেউয়ের সময় এ ধরনের লকডাউন দেয়ার পরিকল্পনা নেয়া হলেও তা আর বাস্তবায়ন হয়নি। ওয়ারি বা পূর্ব রাজাবাজারের অভিজ্ঞতা থেকে বিশেষজ্ঞরা সফলতার কথা জানিয়ে ছিলেন। অবশ্য তখন সংক্রমণ পরিস্থিতি অনেকটা নিয়ন্ত্রণে ছিল।
কমিটির একজন সিনিয়র সদস্য এ বিষয়ে বলেন, এলাকাভিত্তিক লকডাউন এখনো হতে পারে। যেখানে সংক্রমণ অতি উচ্চমাত্রায় সেখানে লকডাউন করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে জেলা, উপজেলা, থানা, ওয়ার্ড বা পাড়াভিত্তিক লকডাউন হতে পারে। তিনি বলেন, এখন যে পরিকল্পনা নেয়া হচ্ছে তাতে সব পক্ষের মতামত নেয়া হচ্ছে কিনা জানি না। সবার মতামত নেয়া হলে জীবন ও জীবিকা রক্ষা করার কৌশল নির্ধারণ সহজ হবে বলেও তিনি মনে করেন।