পোশাক খাতের ভ্যালু চেইনের ক্ষেত্রে বৈশ্বিক পর্যায়ে যে মধ্যমেয়াদী পুনরুদ্ধারের চেষ্টা চলছিল তা দীর্ঘমেয়াদে চলা কোভিড-১৯ মহামারির কারণে সৃষ্ট চাহিদা মন্দার কারণে ব্যাহত হচ্ছে। ২০২০ সালের জানুয়ারি-আগস্ট সময়কালে বিশ্বব্যাপী পোশাকের আমদানি একই সময়ের তুলনায় ২৩ শতাংশ কমেছে। শুধুমাত্র জাতীয় স্তরের হস্তক্ষেপের মাধ্যমে এই মধ্যমেয়াদী চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা ক্রমাগত কঠিন হয়ে পড়েছে।
বাংলাদেশ এবং শ্রীলঙ্কাসহ অনেক সরবরাহকারী দেশের পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া অত্যন্ত ধীর গতিতে চলেছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে ‘ভ্যালু-চেইন-ভিত্তিক সমাধান’ এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। এই পর্যবেক্ষণগুলো ‘বাংলাদেশ এবং শ্রীলঙ্কার পোশাক খাতের পুনরুদ্ধার: ভ্যালু-চেইন-ভিত্তিক সমাধান কি সম্ভব?’ শিরোনামে একটি আন্তর্জাতিক সংলাপে উঠে আসে। গতকাল মঙ্গলবার ভার্চুয়ালি এই সংলাপটি অনুষ্ঠিত হয়।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি), ইনস্টিটিউট ফর পলিসি স্টাডিজ অব শ্রীলঙ্কা (আইপিএস), কলম্বো এবং ৫২টি চিন্তক প্রতিষ্ঠানের আন্তির্জাতিক পর্যায়ের নেটওয়ার্ক সাউদার্ন ভয়েজ-এর সহযোগিতায় এই সংলাপটি আয়োজিত হয়। সিপিডির ফেলো প্রফেসর মোস্তাফিজুর রহমান সংলাপে সভাপতিত্ব করেন। এছাড়াও সিপিডির চেয়ারম্যান প্রফেসর রেহমান সোবহান বক্তব্য দেন। সভায় স্বাগত বক্তব্য দেন সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন। এছাড়া সভায় অংশ নেন সাবেক অর্থমন্ত্রী সাইদুজ্জামান।
ড, ফাহমিদা খাতুন বলেন, সিপিডি এবং আইপিএস স¤প্রতি স্থানীয় পোশাকের পুনরুদ্ধার বিষয়ে একটি ভ্যালু-চেইন ভিত্তিক সমাধানের সম্ভাবনা বিশ্লেষণ করার জন্য যৌথভাবে সাউদার্ন ভয়েজ-এর সহযোগিতায় একটি গবেষণা পরিচালনা করেছে। তিনি মহামারির কারণে বিশ্বব্যাপী পোশাক খাতে ভ্যালু-চেইনের যে ক্ষতি হয়েছে তার উল্লেখ করে বলেন, এই গবেষণাটি সরবরাহকারী দেশসমূহ বিশেষত বাংলাদেশ এবং শ্রীলঙ্কায় যে চ্যালেঞ্জগুলি তৈরি হয়েছে তা মোকাবেলায় সহায়তা করবে।
মূল বক্তব্যে সিপিডির গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম এবং আইপিএসের অর্থনীতিবিদ কিথমিনা হিউজ জানিয়েছেন, গবেষণায় দেখা গেছে- বড় দেশগুলি এই মহামারির সময়ে সীমাবদ্ধ সংখ্যক সোর্সিং দেশগুলিতে বেশি গিয়েছে। চ্যালেঞ্জগুলি মোকাবেলায় ক্রেতাদের কাছে ঠেকে তেমন কোনো উদ্যোগ চোখে পরেনি। মাহামারির সময়কালে (জানুয়ারি থেকে জুন ২০২০) ক্রেতারা রফতানি আদেশ দেয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কা সহ বেশ কয়েকটি বড় সরবরাহকারী দেশকে বঞ্চিত করেছে। বিশ্লেষণে দেখা যায় যে, সরবরাহকারী দেশগুলিতে অতিরিক্ত দুই বিলিয়ন ডলার মূল্যের অর্ডার পুনরায় বিতরণ করা যেতে পারে যদি কোভিড পূর্ব সময়ের রফতানির আদেশের অংশ বজায় রাখা সম্ভব হয়। সমীক্ষায় প্রস্তাব করা হয়েছে যে, যেকোনো বড় বৈশ্বিক সঙ্কটের ক্ষেত্রে, কমপক্ষে সংকট পূর্ব পর্যায়ের রফতানি আদেশ নিশ্চিত করার জন্য একটি পুনঃবিতরণ পদ্ধতি অব্যাহত রাখতে হবে, বিশেষত যেসব দেশগুলি আর্থিকভাবে চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছে।
শ্রীলঙ্কার এমএএস হোল্ডিংস স্ট্রেটেজিক ট্রান্সফরমেশনের পরিচালক হুসনি সালিহ বলেন, ভ্যালু-চেইনের মান বেড়ে যায় যদি সকল অংশিজন একসাথে কাজ করে, বিশেষ করে এরকম সংকট পরিস্থিতিতে। তুলনামূলকভাবে বৈচিত্র্যময় তবে বিদ্যমান ভ্যালু-চেইনের মধ্যে সহনশীলতা তৈরির মাধ্যমে বর্তমান এবং ভবিষ্যতের সংকট সফলভাবে মোকাবেলা করা সম্ভব বলে তিনি মনে করেন। বাংলাদেশ এ্যাপারেল এক্সজেঞ্জের প্রতিষ্ঠাতা ও সিইও মোস্তাফিজ উদ্দিন বলেন, চলমান সংকটে ব্র্যান্ডগুলোর মধ্যে দায়বদ্ধ ব্যবসায়িক আচরণের অভাব রয়েছে। তিনি বলেন, ব্র্যান্ডগুলোর তাদের সরবরাহকারীদের ব্যবসায়িক অংশীদার হিসাবে বিবেচনা করা উচিত এবং দায়িত্বপূর্ণভাবে কাজ করা উচিত।
শ্রীলঙ্কার ডিজাইন কালেক্টিভ স্টোরের সহ-প্রতিষ্ঠাতা ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক বিনু বিক্রমাসিংহে বলেন, তার মত ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা এই অতিমারির জন্য চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন, বিশেষ করে ঋণ পাওয়া ও নতুন পরিস্থিতির সাথে মানিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে। অনলাইন বাণিজ্য এই অতিমারিতে একটা বড় ভূমিকা রেখেছে বলে তিনি মনে করেন।
এইচএনেম গ্রুপের হেড অব সাসটেইনেবিলিটি, গ্লোবাল প্রডাকশন পিয়েরের মতে, এই অতিমারিরি কারণে ব্যাবসা সহজতর করায় আধুনিকায়নের তাৎপর্য উঠে এসেছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কার বিবেচনা করা উচিত যে কীভাবে বাজারকে পণ্য বৈচিত্র্য, পণ্যগুলির সাথে সংযুক্ত পরিবেশবাদি এবং অতিতের তুলনায় উচ্চতর ব্যবসায়ের সম্ভাবনা অর্জনের টেকসইতা মোকাবেলা করার ক্ষেত্রে বাজারকে আরও প্রস্তুত করা যায়। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) বেটার ওয়ার্ক ড্যান রিস বলেন, শুধু খাত-ভিত্তিক পরিমাপ বিদ্যমান চ্যালেঞ্জগুলোর সমাধান করতে পারবেনা। সহনশীলতা তৈরি করতে এবং শ্রমিকদের রক্ষা করতে, অংশিজনদের মধ্যে আস্থা ও সহযোগিতা এবং একটি দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা প্রয়োজন।
সিপিডি’র ফেলো প্রফেসর মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, পোশাক খাতেরভ্যালু-চেইনের সকল অংশিজনরা অতিমারিতে প্রভাবিত হয়েছিল তাই এই গবেষণার ফলাফলগুলো গুরুত্বপূর্ণ। এই খাতকে টেকসই করে সমধানের দিকে এগিয়ে যেতে সকল অংশিজনদের কিছু নির্দিষ্ট ভূমিকা পালন করতে হবে বলে তিনি মনে করেন। সিপিডি’র চেয়ারম্যান প্রফেসর রেহমান সোবহান বলেন, আইএলও সরবরাহকারী দেশগুলোকে আন্তর্জাতিক চাহিদা ব্যবস্থাপনার পুনর্গঠনের জন্য আন্তর্জাতিক ক্রয়কারী দেশগুলোকে একত্রিত করার ক্ষেত্রে একটি উদ্যোক্তা ভূমিকা গ্রহণের বিষয়টি বিবেচনা করতে পারে। সরকার, নিয়োগকারী এবং শ্রমিকদের সহ ত্রিপক্ষীয় সংলাপ করা উচিৎ, যাতে কেবল কভিড সঙ্কটের তাৎক্ষণিক প্রভাব নয়, দীর্ঘমেয়াদী সংকট সমাধানের জন্য বেকার বীমা ব্যবস্থার পারস্পরিক সমন্বিত ব্যবস্থা তৈরি করতে হবে।