যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে টানটান উত্তেজনা আর বিশ্বব্যাপী শ্বাসরুদ্ধকর প্রতীক্ষার মধ্যে আজ মঙ্গলবার অনুষ্ঠিত হতে হচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে পরাক্রমশালী দেশটির প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে প্রতিবারই হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হয়ে থাকে, এবারও এর ব্যতিক্রম নয়। তবে এ নির্বাচন বিভিন্ন কারণে শঙ্কারও জন্ম দিয়েছে।
জনমত জরিপে ডেমোক্র্যাট প্রার্থী জো বাইডেন প্রায় ১০ পয়েন্টে এগিয়ে থাকলেও তার জয়ের গ্যারান্টি মিলছে না। এমনকি ৭৭ বছর বয়সী এই নেতা জয়ী হলেও ক্ষমতায় যেতে পারবেন কিনা, তা নিয়েও অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। স্মরণকালের মধ্যে এই প্রথম প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে যে, প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প পরাজিত হলেও শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরে রাজি হবেন কিনা। এমনকি নির্বাচনোত্তর সহিংসতা ও নজিরবিহীন বিক্ষোভের আশঙ্কাও করা হচ্ছে। উত্তেজনার আগুনে বাতাস দিয়ে গতকাল সোমবার পেনসিলভানিয়ায় শেষ দিনের জনসভায় ট্রাম্প বলেছেন, তিনি ভোটের ফল চ্যালেঞ্জ করবেন। তবে বাইডেন বলেছেন, ‘প্রেসিডেন্টকে নির্বাচনকে চুরি করার সুযোগ দেওয়া হবে না।
৭৪ বছর বয়সী ট্রাম্প অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে দক্ষতা দেখালেও বিপাকে পড়েছেন করোনার ভয়াবহ সংক্রমণ নিয়ে। শুরুতে তিনি এ মহামারিকে পাত্তাই দেননি। এ নিয়ে বিজ্ঞানী ও স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের পরামর্শকেও গুরুত্ব দেননি তিনি। ফলে দেশটিতে করোনার নজিরবিহীন সংক্রমণ ঘটেছে। বিশ্বে সংক্রমণ ও মৃত্যুতে যুক্তরাষ্ট্রে শীর্ষ রয়েছে। দেশটিতে করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা ৯৪ লাখ ছাড়িয়ে গেছে। মৃত্যু হয়েছে দুই লাখ ৩৪ হাজারের বেশি মানুষের। বর্তমানে করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে দেশটিতে দৈনিক ৮০ হাজারের বেশি লোক আক্রান্ত হচ্ছেন। অনেকে মনে করেন, ট্রাম্প পরাজিত হলে তার সবচেয়ে বড় কারণ হবে এই করোনা বিপর্যয়।
এমন সময় দেশটিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে যখন সারাবিশ্বে তার নেতৃত্ব প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ মিত্রদের সঙ্গে ট্রাম্প সম্পর্ক তিক্ত করে ফেলেছেন। মুসলিম দেশগুলোতেও ট্রাম্পের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের ভাবমূর্তি তলানিতে ঠেকেছে। ফলে অনেক মানুষই তাকে আর দ্বিতীয় মেয়াদে হোয়াইট হাউসে দেখতে চাচ্ছেন না। এ কারণে যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে এবার প্রায় একশ বছরের মধ্যে বেশি ভোট পড়বে বলে আশা করা হচ্ছে।
বিপুল ভোটারের উপস্থিতি ডেমোক্র্যাটদের জন্য একটি বিশাল সুখবর। এবার যুক্তরাষ্ট্রের ২৩ কোটি ৩৭ লাখ নাগরিক ভোটদানের যোগ্য। তবে নিবন্ধিত ভোটার ১৫ কোটি ৩০ লাখ। এর মধ্যে সাড়ে ৯ কোটি লোক আগাম ভোট দিয়ে ফেলেছেন। এটা একটা রেকর্ড। ২০১৬ সালের নির্বাচনে যত ভোট পড়েছিল তার দুই-তৃতীয়াংশ ইতোমধ্যেই দেওয়া হয়েছে। ভোটের আগের দিনও দুই প্রার্থী প্রচারে ব্যস্ত সময় কাটিয়েছেন।
আজ স্থানীয় সময় মঙ্গলবার সকাল ৬টায় (বাংলাদেশ সময় বিকেল ৫টায়) ভোটকেন্দ্র খোলা হবে। ভোট চলবে স্থানীয় সময় রাত ৯টা (বাংলাদেশ সময় বুধবার সকাল ৮টা) পর্যন্ত। যুক্তরাষ্ট্রের স্থানীয় সময় মঙ্গলবার গভীর রাতে ভোটের ফল পাওয়া যাবে বলে আশা করা হচ্ছে। গতবার স্থানীয় সময় রাত ৩টায় (বাংলাদেশ সময় পরদিন দুপুরে) ট্রাম্প নিজেকে বিজয়ী বলে ঘোষণা দেন।
বিপুলসংখ্যক আগাম ভোটের কারণে এবার ফল আসতে বেশ বিলম্ব হতে পারে বলে কর্মকর্তারা সতর্ক করে দিয়েছেন। কারণ নিয়ম হচ্ছে, ভোটকেন্দ্রে গিয়ে দেওয়া ভোট আগে গণনা করতে হয়। এরপর মেইল ও অ্যাবসেন্টি (অনুপস্থিত) ভোট গণনা করা হয়। তাই চূড়ান্ত ফল পেতে কয়েকদিনও লেগে যেতে পারে। আশঙ্কা করা হচ্ছে, এ সুযোগে ট্রাম্প আগেভাগেই নিজেকে জয়ী ঘোষণা করে বসতে পারেন। এরপর তিনি ক্ষমতা ছাড়তে অস্বীকৃতি জানাবেন। এ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে সহিংসতা ও বিক্ষোভের আশঙ্কা করা হচ্ছে। শেষ পর্যন্ত ভোটের ফল আদালতেও গড়াতে পারে। অবশ্য বাইডেন জনমত জরিপের পূর্বাভাস অনুযায়ী বড় ধরনের বিজয় পেলে ট্রাম্পের অনেক পরিকল্পনাই ভণ্ডুল হয়ে যাবে বলে মনে করা হচ্ছে।
রোববার ট্রাম্প সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘ভোট শেষ হওয়ার পরও সেগুলো সংগ্রহ করা ভয়ানক ব্যাপার। ভোট শেষ হওয়ার পরও দীর্ঘ সময় সেগুলো গণনা ভয়ানক জিনিস।’ ট্রাম্পের এ অবস্থানের কারণে যুক্তরাষ্ট্রে গৃহযুদ্ধের পর এবারই নির্বাচন নিয়ে সবচেয়ে বিপজ্জনক পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ট্রাম্প সেনাবাহিনী মোতায়েন করতে পারেন। অন্যদিকে ট্রাম্প গণরায় না মানলে দেশটির শত শত শহরে বিক্ষোভের প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে বিভিন্ন সংগঠন।
জাতীয় জরিপের ভিত্তিতে সিএনএনের গড় সমীক্ষায় বাইডেনের সমর্থন ৫২ শতাংশ, ট্রাম্পের ৪২ শতাংশ। দ্য নিউইয়র্ক টাইমসের সমীক্ষাতেও উইসকনসিন, পেনসিলভানিয়া, ফ্লোরিডা, আরিজোনার মতো রণক্ষেত্র রাজ্যগুলোতে এগিয়ে আছেন বাইডেন। অন্যান্য সমীক্ষাতেও পাল্লা ভারী বাইডেনেরই। তবে পপুলার ভোট তথা জাতীয় নির্বাচনের ভিত্তিতে করা এসব সমীক্ষা সবসময় শেষ কথা বলে না। এসব সমীক্ষায় এগিয়ে থেকেও শেষ পর্যন্ত ইলেকটোরাল কলেজের ভোটে হেরে যাওয়ার নজির অনেক রয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়-পরাজয় নির্ধারিত হয় ইলেকটোরাল কলেজ ভোটে। সর্বশেষ ২০১৬ সালের নির্বাচনেও হিলারি ক্লিনটন ৩০ লাখের বেশি ভোট পেলেও ইলেকটোরাল কলেজ ভোটে ট্রাম্পের কাছে হেরে যান। তখন ট্রাম্প ইলেকটোরাল কলেজ ভোট পেয়েছিলেন ৩০৬টি, হিলারির ঝুলিতে পড়েছিল ২৩২টি। অথচ মোট ভোটের ৪৮.২ শতাংশ পেয়েছিলেন হিলারি, ট্রাম্প পেয়েছিলেন ৪৬.১ ভাগ। কিন্তু এবার বাইডেন এতটাই এগিয়ে রয়েছেন যে, অশনিসংকেত দেখছে রিপাবলিকান শিবির।
যুক্তরাষ্ট্রের ৫৩৮টি ইলেকটোরাল কলেজ ভোটের মধ্যে জয়ের জন্য প্রয়োজন ২৭০টি। দেশটির বিভিন্ন জনমত জরিপে আভাস দেওয়া হয়েছে, বাইডেন ২৯০টি বা তারও বেশি ইলেকটোরাল কলেজ ভোট পেতে পারেন। ট্রাম্প ১৬৩টির মতো ইলেকটোরাল কলেজ ভোট পাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি করেছেন। শেষ দিকে দোদুল্যমান রাজ্যগুলো তার দিকে ঝুঁকে পড়লে তিনি অবিশ্বাস্যভাবে জয় পেতে পারেন। তবে গতরাতে নিউইয়র্ক টাইমস জানায়, গুরুত্বপূর্ণ রণক্ষেত্র রাজ্য ফ্লোরিডায় বাইডেন নিরাপদ ব্যবধানে এগিয়ে রয়েছেন।
প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পাশাপাশি দেশটির সিনেটের এক-তৃতীয়াংশ, প্রতিনিধি পরিষদের সব আসনে এবং কিছু রাজ্যে গভর্নর পদেও ভোট হবে। আশা করা হচ্ছে, এসব নির্বাচনেও ডেমোক্র্যাটরা রিপাবলিকানদের চেয়ে বেশি আসন পাবে।
প্রচারের শেষ দিনও রণক্ষেত্র রাজ্যে ট্রাম্প-বাইডেন :ভোটের আগের দিন এবং নির্বাচনী প্রচারের শেষ দিনে সোমবার রণক্ষেত্র রাজ্যগুলোতে প্রচার চালান ট্রাম্প ও বাইডেন। ট্রাম্প গতকাল নর্থ ক্যারোলাইনা, পেনসিলভানিয়া, উইসকনসিন ও মিশিগানে প্রচার চালান। আর বাইডেন পেনসিলভানিয়া ও ওহাইওতে সমর্থকদের সামনে হাজির হন।
এসব রণক্ষেত্র রাজ্যগুলোর ইলেকটোরাল কলেজ মিলিয়েই ট্রাম্প জয়ের আশা করছেন। গতকাল নর্থ ক্যারোলাইনা, পেনসিলভানিয়া ও উইসকনসিনে একটি করে ও মিশিগানে দুটি জনসভা করেন ট্রাম্প। ২০১৬ সালে ডেমোক্র্যাট প্রার্থী হিলারি ক্লিনটনের বিরুদ্ধে এ রাজ্যগুলোতে এক শতাংশ ব্যবধানে জয় পেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু এবার এই রাজ্যগুলো বাইডেনের কবজায় চলে যেতে পারে বলে জরিপে ইঙ্গিত পাওয়া গেছে। মিশিগানের গ্র্যান্ড র্যাপিডসে জনসভার মধ্য দিয়ে নির্বাচনী প্রচার শেষ করেন ট্রাম্প। ২০১৬ সালেও এখানেই নিজের শেষ প্রচার চালিয়েছিলেন তিনি।
অন্যদিকে বাইডেন ও তার রানিং মেট কমলা হ্যারিস গতকাল অধিকাংশ সময় পেনসিলভানিয়ায় কাটান। এদিন রাজ্যটির পিটসবার্গ এলাকায় শ্রমিক ইউনিয়নের সদস্যদের মধ্যে এবং আফ্রিকান-আমেরিকান সম্প্র্রদায়ের মধ্যে প্রচার চালান বাইডেন। সন্ধ্যায় এখানে সংগীতশিল্পী লেডি গাগার ড্রাইভ-ইন র্যালিতেও যোগ দেন তিনি।