এক মুসলিম নারীকে হত্যার পর সনাতন রীতি মোতাবেক দাহ করার অভিযোগে তার হিন্দু ধর্মাবলম্বী স্বামীকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। শুক্রবার (২০ আগস্ট) বিকেলে বোয়ালখালী উপজেলার শ্রীপুর খরণদ্বীপ ইউনিয়ন এলাকা থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয়।
গ্রেফতার বাবুল দে ওরফে তনু (৩০) চট্রগ্রাম বোয়ালখালী উপজেলার শ্রীপুর খরণদ্বীপ ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের জ্যৈষ্ঠপুরা হারুনের বাড়ির বাসিন্দা। তার বাবার নাম অজিত দে বলে জানা গেছে।
পুলিশ জানায়, নিহত ইয়াছমিন আক্তার এনির (২৪) মা রোকসানা বেগম গত ১৬ আগস্ট তার মেয়েকে হত্যা করা হয়েছে মর্মে চট্টগ্রাম আদালতে একটি ফৌজদারি অভিযোগ দায়ের করেন। আদালত অভিযোগ আমলে নিয়ে বোয়ালখালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে (ওসি) নিয়মিত মামলা হিসেবে রুজু করতে আদেশ দেন। আদালতের আদেশপ্রাপ্ত হয়ে পুলিশ বাবলু দে, স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. মোকারম ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি রতন চৌধুরীসহ মোট ১৮ জনের বিরুদ্ধে মামলা রুজু করেন।
মামলার অন্যান্য আসামিরা হলেন- পবন দাশ (৫৫), সাধন মহাজন (৬০), নিমাই দে (৪৫), শংকর দত্ত (৩৩), অরবিন্দ মহাজন (৫০), অরুন দাশ (৫০), দিলীপ দেব (৪৫), প্রদীপ সুত্রধর (৪০), রাম প্রসাদ (৩৮), রনি দে (৩০), অরুপ মহাজন (৪২), সমর দাশ (৫৫), রবীন্দ্র ধর (৬০), নিপুন সেন (৬০) ও ইউসুফ ওরফে ড্রেজার ইউসুফ (৩৫)। এদের মধ্যে পুলিশ শুক্রবার বিকেলে মামলার প্রধান আসামি বাবলুকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়।
মামলার এজাহার সূত্রে জানা গেছে, ইয়াছমিন আক্তার এনির গ্রামের বাড়ি বাগেরহাটের মোংলা থানায়। জীবিকার তাগিদে ইয়াসমিন নগরের ইপিজেড এলাকার ‘ক্যান পার্ক’ নামে একটি পোশাক কারখানায় চাকরি করতেন। চাকরির সুবাদে তিনি বন্দরটিলা এলাকায় একটি ভাড়া বাসায় থাকতেন। আর বাবলু দে বন্দরটিলা এলাকায় ‘পূজা’ নামে একটি সেলুনে কাজ করতেন। প্রতিদিন বাসায় যাতায়াতের পথে তাদের দেখা হতো। এর একপর্যায়ে ইয়াসমিন ও বাবলুর মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। তাদের এ সম্পর্ক বিয়েতে গড়ায়। পরিচয় গোপন রেখে বাবলু ২০১৯ সালে ইয়াসমিনকে বিয়ে করেন। তাদের সংসারে ইশা মনি নামে দেড় বছরের একটি কন্যা সন্তান রয়েছে।
এদিকে বিয়ের পর ইয়াসমিন জানতে পারেন তার স্বামী হিন্দু। এ নিয়ে তিনি চরম অনিশ্চয়তায় ভুগছিলেন। বিপরীতে বাবলু তার স্ত্রীকে ধর্মান্তরিত করার চেষ্টা করেন। দুই বছর আগে বাবলু তার স্ত্রীকে নিয়ে বোয়ালখালী উপজেলায় বসবাস শুরু করেন। ইয়াসমিনের সঙ্গে পরিবারের যোগাযোগও বন্ধ হয়ে যায়। মৃত্যুর তিনদিন আগে ইয়াসমিন তার কাছের বান্ধবী ও খালাতো বোন হাসিকে (২৪) ফোন করে জানান- তার স্বামী ধর্মান্তরিত হবেন। এজন্য তিন হাজার টাকা প্রয়োজন। হাসি বিষয়টি ইয়াসমিনের মাকে জানান। ইয়াসমিনের মা টাকা দিতে ব্যর্থ হলে বাবলু দে ক্ষিপ্ত হন।
সর্বশেষ গত ৩ আগস্ট বাবলু হাসিকে ফোন দিয়ে জানান ইয়াসমিন স্ট্রোক করে মারা গেছেন। হাসি বিষয়টি ইয়াসমিনের পরিবারকে জানান। ঘটনা শুনে ইয়াসমিনের পরিবারের সদস্যরা দ্রুত রওনা দেন। কিন্তু তখন দেশব্যাপী কঠোর লকডাউন চলায় আসতে বিলম্ব হয়।
এদিকে ইয়াসমিনের পরিবার আসার আগেই বাবলু তার স্ত্রী মুসলিম জেনেও স্থানীয় চেয়ারম্যানসহ বিভিন্ন ব্যক্তির সঙ্গে পরামর্শ করে হিন্দু রীতি মোতাবেক দাহ করেন। এ ঘটনায় নিহতের মা থানায় মামলা দায়ের করতে গেলে আসামিরা প্রভাবশালী হওয়ায় পুলিশ আদালতে মামলা দায়েরের পরামর্শ দেন। পরে বাদী মানবাধিকার সংগঠন বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের (বিএইচআরএফ) সহায়তায় আদালতে ফৌজদারি অভিযোগ দায়ের করেন। আদালত অভিযোগটি বোয়ালখালী থানায় নিয়মিত মামলা হিসেবে রুজুর আদেশ দেন।
জানতে চাইলে বোয়ালখালী থানার ওসি আবদুল করিম বলেন, ‘আদালতের আদেশপ্রাপ্ত হয়ে ইয়াসমিন আক্তার নিহতের ঘটনায় থানায় একটি হত্যা মামলা রুজু হয়েছে। শুক্রবার বিকেলে প্রধান আসামি ও নিহতের স্বামী বাবলু দে ওরফে তনুকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাকে আজ (শনিবার) সকালে আদালতে প্রেরণ করা হচ্ছে। ঘটনাটি তদন্ত করা হচ্ছে।’
মামলার বাদীপক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট জিয়া হাবিব আহসান বলেন, ‘বাদি আর্থিকভাবে দুর্বল হওয়ায় মানবাধিকার সংগঠন বিএইচআরএফের সহায়তায় মামলা দায়ের করা হয়েছে। এ ঘটনায় প্রধান আসামিকে গ্রেফতার করা হয়েছে বলে শুনেছি। পুরো ঘটনাটি তদন্ত করে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানাচ্ছি