ইয়াবার মতো স্পর্শকাতর মাদক ব্যবসায়ীদের পৃষ্ঠপোষকতা করে বিপুল পরিমাণ অবৈধ সম্পদ অর্জন এবং রোহিঙ্গাদের জন্মনিবন্ধন, ভোটার তালিকাভুক্তি ও পাসপোর্ট পেতে সহযোগিতার অভিযোগে ৫ জন পুলিশ সদস্য, ২ জন ইউপি চেয়ারম্যান, ২জন ইউপি সচিব, ১জন আইনজীবী এবং ৭ জন পৌর কাউন্সিলরসহ মোট ৫৬ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
পৃথক ১২টি মামলায় আসামির তালিকায় আরো রয়েছেন- রোহিঙ্গা, স্থানীয় প্রভাবশালী ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা। গত ২৫ মার্চ দুদকের সমন্বিত জেলা কার্যালয় চট্টগ্রাম-২ এ এসব মামলা হয়েছে। মামলাগুলোতে অন্তর্ভুক্ত আসামিদের গ্রেফতারে অভিযান চালাচ্ছে দুর্নীতি তদন্তে নিয়োজিত সরকারি সংস্থাটি।
ইতোমধ্যে মামলার অন্তর্ভুক্ত চারজন আসামিকে রোববার (২৮ মার্চ) সকালে শহরের বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে কক্সবাজার পৌরসভার বর্তমান-সাবেকসহ তিন কাউন্সিলর এবং এক পৌর কর্মচারীকে গ্রেপ্তার করেছে দুদক। তারা হলেন- কক্সবাজার পৌরসভার সাবেক প্যানেল মেয়র রফিকুল ইসলাম, সাবেক কাউন্সিলর জাবেদ মোহাম্মদ কায়সার নোবেল, ২নং ওয়ার্ডের বর্তমান কাউন্সিলর মিজানুর রহমান এবং জন্মনিবন্ধন শাখার অফিস সহকারী দিদারুল আলম।
গ্রেপ্তারদের কক্সবাজারের বিশেষ জজ আদালতে পাঠানো হলে বিচারক জেল হাজতে পাঠানোর নির্দেশ দেন। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন দুদকের সমন্বিত জেলা কার্যালয়-চট্টগ্রামের উপ-পরিচালক মো. মাহাবুবুল আলম।
৫ জন পুলিশ সদস্যকে আসামী করা হয়েছে, যারমধ্যে মহেশখালী থানার সাবেক ওসি বর্তমানে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় কর্মরত প্রভাষ চন্দ্র ধর, পেকুয়া থানার সাবেক ওসি বর্তমানে চট্টগ্রাম সিআইডির পরিদর্শক মিজানুর রহমান, কক্সবাজার ডিএসবির সাবেক পরিদর্শক বর্তমানে ব্রাহ্মণবাড়িয়া কোর্ট পরিদর্শক কাজি দিদারুল আলম, ডিএসবির সাবেক এসআই বর্তমানে রাঙামাটিতে কর্মরত সাজেদুর রহমান, ডিএসবির সাবেক এসএসআই বর্তমানে ফেনিতে কর্মরত জাহেদুল ইসলাম।
তারা সবাই কক্সবাজার জেলা পুলিশের বিশেষ শাখায় (ডিএসবি) দায়িত্ব পালনকালে পাসপোর্ট তদন্ত প্রতিবেদনে দুর্নীতির তথ্য পেয়েছে দুদক। এরমধ্যে পৌরসভার সাবেক প্যানেল মেয়র ও জেলা শ্রমিক দলের সভাপতি রফিকুল ইসলাম, সাবেক কাউন্সিলর ও আওয়ামী লীগ নেতা জাবেদ মোহাম্মদ কায়সার নোবেল, ২নং ওয়ার্ডের বর্তমান কাউন্সিলর মিজানুর রহমান, ১০ নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আওয়ামী লীগ নেতা সালাউদ্দিন সেতু, ৭ নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর বিএনপি নেতা আশরাফুল হুদা সিদ্দিকী জামশেদ, সংরক্ষিত সদস্য (১০, ১১, ১২ নং ওয়ার্ড) মহিলাদল নেত্রী নাসিমা আকতার বকুল এবং সাবেক নারী সদস্য (১, ২, ৩ নং ওয়ার্ড) মহিলাদল নেত্রী হুমায়রা বেগমসহ ৭ জন কাউন্সিলরকে আসামী করা হয়।
মহেশখালীর কুতুবজোমের সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান মোশারফ হোসাইন খোকন এবং কক্সবাজার সদরের পোকখালীর রফিক আহমদ। ২ জন ইউপি সচিবের মধ্যে একজন কুতুবজোমের প্রিয়তোষ দে। অপরজন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন এলাকার। এ মামলায় আইনজীবী হিসেবে একমাত্র আসামি রয়েছেন কক্সবাজার শহরের নতুনবাহারছড়া এলাকার বাসিন্দা ও কক্সবাজার আদালতের এপিপি আবুল কালাম আজাদ-৬। বাকি আসামির মধ্যে রোহিঙ্গা, রাজনৈতিক নেতা, সমাজপতি রয়েছেন।
দুদকের সমন্বিত জেলা কার্যালয় চট্টগ্রাম-২ এর সহকারী পরিচালক মো. শরীফ উদ্দিন জানান, রোহিঙ্গাদের পাসপোর্ট পেতে যেসব ডকুমেন্টস দরকার তা জনপ্রতিনিধিরা ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। সে অনুযায়ী রোহিঙ্গারা পাসপোর্টের জন্য আবেদন করেছে।
তিনি বলেন, জেলা পুলিশের বিশেষ শাখা-ডিএসবি অফিসে তদন্তের জন্য প্রেরিত আবেদনের ফাইলগুলো সঠিকভাবে তদন্ত না করে পাসপোর্ট অফিসে পাঠিয়ে দিয়েছে। যে কারণে বাংলাদেশী পাসপোর্ট পেয়ে গেছে রোহিঙ্গারা। এতে বড় ধরণের অনিয়ম, দুর্নীতির অভিযোগ মিলেছে।
দুদক কর্মকর্তা বলেন, রোহিঙ্গা নাগরিকদের বাংলাদেশী পাসপোর্ট পেতে সহযোগিতাকারী হিসেবে পুলিশ, জনপ্রতিনিধি, রাজনৈতিক নেতাদের সরাসরি সম্পৃক্ততা রয়েছে। যা তদন্তকালে সত্যতা পাওয়া যায়। প্রাথমিকভাবে পৃথক ১২টি মামলায় ৫৬ জনকে আসামি করা হয়েছে। সেখানে চারটির অধিক মামলায় পৌর কাউন্সিলররা আসামি রয়েছেন। আসামিদের মধ্যে রবিবার (২৮ মার্চ) চারজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে সব আসামিকে আইনের আওতায় আনা হবে বলে দুদক জানিয়েছেন।
দুদকের সংশ্লিষ্টরা জানান, দুদকের একটি অনুসন্ধান দল দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে আসছিল। পরবর্তীতে অভিযোগের সত্যতা পাওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে ১২টি মামলা দায়ের করা হয়। ৪ জনকে গ্রেপ্তার করে বিশেষ জজ আদালতে পাঠানো হলে বিচারক জেল হাজতে পাঠানোর নির্দেশ দেন।
জানা গেছে, শরণার্থী হিসেবে বাংলাদেশে থাকা ১১ লাখ রোহিঙ্গাদের কেউ কেউ ফাঁকি দিয়ে বাংলাদেশের জাতীয় পরিচয়পত্র ও পাসপোর্ট পেয়ে আসছিলেন। ২০১৯ সালে এক সঙ্গে এ ধরনের অনেক ঘটনা ধরা পড়ে। এরপর সবগুলো কর্তৃপক্ষ নড়েচড়ে বসে। ইসির তদন্তের পাশাপাশি চট্টগ্রাম, কক্সবাজারের তিনটি পাসপোর্ট কার্যালয়সহ বিভিন্নভাবে সংগ্রহ করা প্রায় দেড়শ পাসপোর্ট আবেদনপত্রের নথি সংগ্রহ করে দুদকও নামে তার তদন্তে। কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম অঞ্চলে রোহিঙ্গাদের জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) দেওয়ার পেছনে দুই নির্বাচন কর্মকর্তাসহ সাতজনের সংশ্লিষ্টতার প্রাথমিক প্রমাণ পাওয়ার দাবি করেন দুদক কর্মকর্তারা।
দুদক থেকে অভিযান চালানোর পর ২০১৯ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম জেলা নির্বাচন অফিস কোতোয়ালি থানায় এবং ১৩ সেপ্টেম্বর কক্সবাজারের জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা শিমুল শর্মা বাদী হয়ে জেলার সদর থানায় ভোটার তালিকায় ৬০০ রোহিঙ্গাদের নাম উঠানোর অভিযোগে মামলা করেন।
এ বিষয়টি উল্লেখ করে দুদকের এক অভ্যন্তরীণ প্রতিবেদনে বলা হয়, এটা আইওয়াশ ও দায়িত্ব এড়ানোর কৌশলমাত্র মর্মে প্রতীয়মান হয়। নির্বাচন কমিশনের অসৎ কর্মকর্তা/কর্মচারীদের অসৎ সহযোগিতা ব্যতীত ভোটার তালিকায় নাম উঠানো কিংবা জাতীয় পরিচয়পত্র পাওয়া সম্ভব নয় মর্মে প্রতীয়মান হয়।
প্রসঙ্গত, রোহিঙ্গাদের পাসপোর্ট ও এনআইডি দেওয়ার পেছনে কাজ করেছে একটি সংঘবদ্ধ চক্র। ওই চক্রে সরকারি কর্চারীদের পাশাপাশি জনপ্রতিনিধিরাও যুক্ত আছেন। তাদের শনাক্ত করতে কাজ করছে দুদক।সুত্র:সকস্ব।