পিটিয়ে মানুষ বানানো ছিল আমাদের জাতীয় সংস্কৃতি। ছোটবেলায় আমাদের অভিভাবকগন স্কুলের শিক্ষকদের বলে দিতেন, মাংসগুলো আপনাদের, হাড্ডিগুলো আমার। না পড়লে পিটিয়ে পিঠের ছাল তুলে ফেলবেন, ইত্যাদি।
এমনকি বাসায় অভিযোগ করলে স্বান্তনাস্বরুপ বলা হতো, ওস্তাদ(শিক্ষকরা) মারলে সেই জায়গা দোযখের আগুনে জ্বলবে না। প্রাথমিক বিদ্যালয়েই ভয়াবহ পিটুনির অতীত ইতিহাস আছে অগণিত! স্কুলে বেত কেনার জন্য সম্ভবত বাৎসরিক বাজেটও থাকতো !
লম্বা বেত কেনার পর সেগুলোকে কেটে সাইজ করে সরিষার তেল মাখিয়ে রোদে শুকিয়ে চাঙ্গা করা হতো, আবার কোন কোন শিক্ষক জোড়া বেত নিয়ে ক্লাসের দুষ্টদের পিটাতেন। পড়া না পারলে, বাড়ির কাজ না করলে কিংবা পরীক্ষার খাতা দেয়ার সময়ও চলতো পিটুনি।
হাইস্কুলের শিক্ষকদের কেউ কেউ তো পিটানোর উপরেই ডিগ্রীপ্রাপ্ত ছিলেন, যাদেরকে ১ কিলো দূর থেকে দেখলেই ছাত্রদের কাঁপাকাঁপি শুরু হয়ে যেতো। ভয়ানক পিটুনি থেকে বাঁচতে স্কুলের দোতলা থেকে লাফ দেয়া, এমনকি কখনো কখনো স্যারের বেত কেড়ে নিয়ে উল্টো ঘটনাও ঘটতো! কোন কোন শিক্ষক তো চুল ধরে, কান মলেও প্রচন্ড ব্যাথা দিতেন!!এরকম হাজারো-লাখো ঘটনা পাওয়া যাবে। তখনকার সময়ের মিথই ছিল, না পিটলে বাচ্চা/ছাত্র-ছাত্রীরা মানুষ হয় না। বরং এটাই ছিল আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার এক ধরণের ঐতিহ্য! বেধড়ক পিটুনি খাওয়া ছাত্ররা সেইসব শিক্ষকদের সম্মানও করতেন প্রচন্ড, আর শিক্ষকগণও ভাল রেজাল্ট করা ছাত্রদের পরবর্তীকালে নিজের সন্তানের মতোই ভালবাসতেন। আজকাল যা নির্যাতনের সংজ্ঞা হিসেবে বিবেচিত। আমরাও এখন অনেক বেশী সোচ্চার।
বর্তমান সময়কালে সরকার সব ধরনের স্কুলে বেত নিষিদ্ধ করেছেন। একইভাবে মাদ্রাসাভিত্তিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও সেটা বাস্তবায়ন করা কঠিন কিছু নয়। গতকালের ভাইরাল হওয়া মাদ্রাসা শিক্ষকের ভিডিও দেখে অনেকেই মন্তব্য করেছেন, মাদ্রাসা শিক্ষা বন্ধ করে দেয়ার বিষয়ে। অথচ, নিজেদের বেদম মাইর খাওয়ার ইতিহাস তারা বেমালুম ভুলে গেছেন। অবহেলিত মাদ্রাসাভিত্তিক শিক্ষা ব্যবস্থায় সংস্কারের আলো পড়তে শুরু করেছে মাত্রই। আশাকরি বেধড়ক পিটুনির এই প্রথা জলদি বিলুপ্ত হয়ে যাবে। নইলে শক্তভাবে আইনের আওতায় আনতে হবে।
যে শিক্ষককে গতকাল মামলায় আসামী করা হয়েছে আইনের মুখোমুখি করার জন্য, তাঁর নিজের ছাত্রজীবনের ইতিহাস জানলে দেখা যাবে তিনিও এরকম পিটুনি খেয়েই বড় হয়েছেন, তথাকথিত মানুষ হয়েছেন। এবং সেটাই তার মজ্জায় গেঁথে আছে!
পিটুনি খেয়ে বড় হওয়া অভিভাবকদের সন্তানদের না পিটিয়ে মানুষ করার কাজটি অত্যন্ত কঠিন! এককালের শিক্ষকরা বেত দিয়ে পিটিয়ে যেসব দুষ্টদের সোজা করতেন, আজকের শিক্ষকরা কিন্তু তাদেরই জিন বয়ে বেড়ানো বংশধরদের না পিটিয়ে মানুষ করার কঠিন কাজটি করছেন। প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে একটি শ্রেণীকক্ষে যে পরিমাণ ছাত্র-ছাত্রী একসাথে ক্লাস করে, তাদের খুনসুঁটি নিয়ন্ত্রণ করা কতটা দূঃসাধ্য কাজ, সেটা শিক্ষকরা হয়তো বলতে পারবেন।
পরিশেষে তৎকালীন আর বর্তমান সময়ের শিক্ষকতা পেশার মৌলিক পার্থক্যটাও বিবেচনায় রাখা প্রয়োজন। শিক্ষকতা ছিল একসময় মহান পেশা, আর এখন সেটা কেবলই একা চাকুরীমাত্র। যোগ্যতার মাপকাঠিতে কিংবা মহান ব্রত নিয়ে এখন খুব কমই শিক্ষকতার পেশায় যোগদান করেন। শিক্ষকের নিজের শিক্ষায় ঘাটতি থাকলে সেটার প্রভাব তো তার আচরণে প্রকাশ পাবেই। গুনগত পরিবর্তনের জন্য শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের পাশাপাশি আমাদের পরিবারগুলোতেও উত্তম চর্চা জরুরি। পারিবারিক শিক্ষার চেয়ে কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা কখনো বড় হতে পারে না।