বছর কেটেছে মা !
‘তুই পারবি’ এক অসীম শক্তি! যাদুর মতো। মা কখনো আমাকে ‘যাদু’ ডাকতেন। পুত্রের আদুরে সম্বোধন। এ ডাকে পুত্রের বহু অসম্ভবের দোলাচল পাড়ি। দিশাহীন কিশোর গ্রাম থেকে সদ্য শহরে। কাদামাটির মতো নরম কোমল। বেতালের শহরে তাল খোঁজে। মা’র ওই যাদু নিরন্তর চলমান।
ঢাকায় নতুন। খাপ যেন খায় না। পড়াশোনায়ও। ফল খারাপ হলো। অনেকে বললো, পড়াশোনা ওর কাজ না। মানুষ হবে না। মা এসব কথায় ভীষণ বিব্রত।
সান্ত্বনা দিয়ে আমার মাথায় হাত রেখে মা বললেন, “শৈশবে দুরন্ত শের-ই-বাংলার মা’কে বলা হয়েছিল, তোমার ছেলেকে কুমিরে খাবে। তাঁর মহীয়সী মা বলেছিলেন, আমার ছেলে একদিন বাঘ হবে।, কুমির তাড়াবে। ঠিকই তিনি শের-ই-বাংলা হয়ে ইংরেজ তাড়িয়েছ্ন। তোমরা দেখো, আমার ছেলেও একদিন বাঘ হবে!” মা’র দৃঢ় কন্ঠের সে সংলাপ আজো কানে বাজে। গভীরভাবে উদ্দীপিত করে। সমগ্র অন্তরাত্মা আন্দোলিত করে।
ছেলেবেলা থেকেই শের-ই-বাংলা এ কে ফজলুল হক আমার কাছে অদম্য অনুপ্রেরণা। যে নাম মা’র কাছ থেকে প্রথম শোনা। বড় হয়ে তাঁকে যতো জেনেছি, মুগ্ধ হয়েছি।
শৈশবে দুরন্ত, দুষ্ট ছিলাম। পড়াশোনা ছাড়া সব করতাম। আড্ডা, বাইরে ঘোরা, পড়ায় অমনযোগ, অসময়ে ফেরা, খাওয়া, ঘুম, ঔদাসীন্য সবমিলে আমি মা’র ‘হতাশার সন্তান’!
আপাত: বখে যাওয়া ছেলের চিন্তায় মা। কিংকর্তব্যবিমুঢ়! পুত্র গড়ার চ্যালেঞ্জ নিলেন। জেদি পুত্রকে স্পন্দিত করে গেলেন। নিয়ত দম দিলেন। পুঁথিগত উচ্চশিক্ষিত তিনি ছিলেন না। ঈর্ষণীয় স্মৃতিশক্তি তাঁর! পরিশ্রম, ধর্ম, দেশপ্রম, সংস্কার, ও মানবিকতায় সমৃদ্ধ! সাত বছর বয়স থেকে পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়তেন। আট ভাইবোনকে একা মানুষ করেছেন।
বিসিএস দেব শুনে বললেন, বিদেশ যেতে পারবি না। দেশের যেকোন চাকরি করবি। সব ভালোরা বিদেশ গেলে দেশ দেখবে কে? কোথাও গেলে এক সপ্তাহর বেশী নয়। সন্তান দূরে থাকা খুব অপছন্দ।
চাকরির প্রথম দিকে ১৯৯৮এ ঢাকা বিমানবন্দরে পদস্থ হই। এক রাতে মুরগি মিলনের কাছ থেকে সাতচল্লিশ লাখ টাকা শুল্ককর জরিমানা আদায় করি। হুমকি ধমকে কাজ না হলে মুরগি মিলন বাসায় ফোন করে মা’কে “আপনার ছেলের জন্য কাফনের কাপড় পাঠাচ্ছি”। মা বলেছেন, তোমাকে ভয় পাবার জন্য ছেলে মানুষ করিনি। আমি ওকে আল্লাহর জিম্মায় ছেড়ে দিয়েছি। তুমি কিছুই করতে পারবা না!
১৯৮০ থেকে ২০২০ চল্লিশ বছরে মা থেকে আলাদা থাকিনি। যৌথপরিবারে ভাইবোন নিয়ে মা’র আঁচলের নিচে। ছেলের বউদের মেয়ে বলতেন। ছেলের জন্য নামাযে যতোটা কেঁদেছেন, বউয়ের জন্য কয়েকগুন বেশী। নিজের বাবা-মা’র চেয়ে শ্বশুর শাশুড়ির জন্য বেশী! শেষ নি:শ্বাস ত্যাগের কিছুদিন আগে আমার হাত ধরে বললেন, “আমাকে মাফ করে দে, তোকে অনেক জ্বালিয়েছি, আজকালের কোন ছেলে মা’র জন্য এতোটা করে না!” এটাই মা’র মাতৃত্বের মহত্ব। মা’র জন্য কিছুই করতে পারিনি। মা’দের জন্য করা যায় না। সন্তানরা পারেও না। আমার মতো অসহায় অপারগ সন্তান আরো পারে না।
এ আমার মা! এক মহীয়সী রমণী। সাহস ও স্পন্দনের অপার খনি। ভালোবাসার অতল আধার! নির্লোভ, সৎ ও দৃঢ়চেতা! আজ আমি যা, তার সবটাতেই মা!
একবছর হয়ে গেল, মা’কে দেখি না! সপ্তাহ যার কাটতো না!
আজ তাঁর কবরের পাশে আমরা দোয়ায়। চার ছেলে, চার নাতিসহ অনেকে। বেঁচে থাকতে যিনি সবাইকে একত্রে চাইতেন। সবাই তাঁর পাশে। মা সবকিছুর উর্ধে। সেই ডাক, সেই যাদু ডাকবে না। সেই সুন্দরতম শ্রেষ্ঠতম হাসি, হাসবে না। মা এমনি! হারিয়ে ফেলেছি, আর পাব না….গত বছর ৪ফেব্রুয়ারি এদিনে মা’ আল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়েছেন। রাব্বিরহামহুমা কামা রাব্বায়ানি সাগীরা….আল্লাহ মা’কে জান্নাতুল ফিরদাউসের সর্বোচ্চ স্থানে রাখুন।
বেলাল হোসেন চৌধুরী
কাস্টমস কমিশনার