কেবল বাংলাদেশেই নয়, পৃথিবীর সব দেশেই সাধারণ মানুষের সাথে পুলিশের সরাসরি যোগাযোগ খুবই কম। পুলিশের প্রত্যক্ষ সংস্পর্শে আসার অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের শতকরা কতজন মানুষের আছে সে নিয়ে আলাদা কোন জরিপ নেই। তবে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রর অনেক জরিপে দেখা গেছে ঐদেশের মাত্র ২০% মানুষের পুলিশের সাথে মিথস্ক্রিয়া করার বাস্তব অভিজ্ঞতা রয়েছে। বলাবাহুল্য, এদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ পুলিশের সংস্পর্শে আসে যানবাহন চালনা তথা ট্রাফিক জনিত কারণে। থানায় যাওয়ার বা থানা পুলিশ কর্তৃক গ্রেফতার হওয়ার অভিজ্ঞতা খুব কম সংখ্যক মানুষেরই হয়। কিন্তু তারপরও মানুষ পুলিশ সম্পর্কে অনেক নেতিবাচক ধারণা পোষণ করেন যেগুলোর অধিকাংশই আসে মানুষের বদ্ধমূল পূর্বসংস্কার, প্রচার মাধ্যম কিংবা জনশ্রুতির মাধ্যমে।
পুলিশ রিমান্ড বা হেফাজত সম্পর্কেও আমাদের সমাজে একটি বদ্ধমূল নেতিবাচক ধারণা রয়েছে। সাধারণ মানুষ হয়তো জানেন না যে প্রতিদিন পুলিশের হাতে যেসব মানুষ গ্রেফতার হয়, তাদের সামান্য সংখ্যকই পুলিশ হেফাজতে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আদালতে অনুমতি দেয়। তাছাড়া গ্রেফতারকৃতদের গড়পড়তা পুলিশের রিমান্ডে আনার প্রয়োজনও নেই। যে মামলায় পুলিশ প্রকৃত রহস্য এখনও উদ্ঘাটন করতে পারেনি, যে ক্ষেত্রে আসামীর মুখ থেকে না শুনলে প্রকৃত রহস্য উদ্ঘাটন সম্ভব নয়, সেক্ষেত্রেই মূলত আসামীকে রিমান্ডে নেয়ার প্রয়োজন পড়ে। যৌতুকের জন্য স্ত্রী নির্যাতন কিংবা শিক্ষক কর্তৃক ছাত্রকে মারপিটের মামলায় আসামীকে রিমান্ডে নেয়ার কোন দরকার পড়ে না। কিন্তু তারপরও কেবল ফৌজদারি নয়, দেওয়ানি মামলার আসামিরাও রিমান্ডের ভয়ে ভীতু থাকে।
অনেকের বিশ্বাস, আসামীকে রিমান্ডে নেয়ার উদ্দেশ্য হল তাকে নির্যাতন করা। বিষয়টিকে অনেকে অনুমান করেন, আসামীকে মারপিট বা নির্যাতন করা বুঝি পুলিশের কাজেরই অবিচ্ছেদ্য অংশ। কেউ কেউ তো বিশ্বাসই করেন যে পুলিশের প্রশিক্ষণেও হয়তো নির্যাতনের কৌশল শেখান হয়। আমার দীর্ঘ দিনের পুলিশ জীবনে এমন প্রশ্নের মুখোমুখি অনেকবার হতে হয়েছে। এক শ্রেণির মানুষ মনে করেন, অভিযুক্তরা আদালতে যে স্বীকারোক্তিই দিক না কেন তার সবগুলোই পুলিশ জোর জবরদস্তি ও নির্যাতনপূর্বক আদায় করে। তাদের বিশ্বাস, পুলিশের কাছে কেউ বিনা নির্যাতনে দোষ স্বীকার করে না।
কিন্তু বাস্তব ঘটনা বহুলাংশে পৃথক। পুলিশের হাতে গ্রেফতার হওয়া যেসব আসামী দোষস্বীকারোক্তি দেন তাদের সিংহভাগই স্বেচ্ছায় স্বীকারোক্তি দিয়ে থাকেন। সমাজে অপরাধের অস্তিত্ব থাকলেও গড়পড়তা মানুষ অপরাধী নন। কেউ কেউ দুর্ঘটনাক্রমে, কেউ কেউ দায়ে পড়ে কেউ বা আবার শখের বসেও অপরাধে জড়িয়ে পড়েন। কোন সমাজেই নির্জলা অপরাধীর সংখ্যা শতকরা ৬ ভাগের বেশি নয়। হয়তো এ ছয় ভাগ ব্যক্তি দোষ স্বীকারে কখনই রাজি হবে না। কিন্তু সাধারণ শ্রেণির মানুষ দক্ষ তদন্তকারীদের কাছে সহজেই দোষ স্বীকার করেন। যারা স্বীকারোক্তি দিতে রাজি হবেন না, তাদের শত নির্যাতন করলেও শেষ পর্যন্ত আদালতে গিয়ে স্বীকারোক্তি দিতে অস্বীকার করেন।
পৃথিবীর কোন দেশের আইনেই গ্রেফতারকৃত আসামীর উপর নির্যাতন আইনসিদ্ধ নয়। তারপরও বিভিন্ন কারণে আসামীর উপর নির্যাতন করা হয়। এর জন্য পুলিশ সাংগঠনিকভাবে যতটা না দোষী তার চেয়েও দোষী হল ব্যক্তি-অফিসার। ঘটনা উদ্ঘাটনের জন্য তদন্তকারী কর্মকর্তাদের উপর ঊর্ধ্বতনের চাপ অবশ্যই থাকে। কারণ নিজ অধিক্ষেত্রে অপরাধ নিয়ন্ত্রণ, উদ্ঘাটন ও অপরাধীদের বিচারের আওতায় নিয়ে আসার বাধ্যবাধকতা বর্তায় ইউনিট কমান্ডারের উপর। তাই থানা পুলিশের কাজের তদারক করা ও সংঘটিত অপরাধের দ্রুততর সময়ে রহস্য উদ্ঘাটন করার জন্য ইউনিট কমান্ডারদের তাগিদ থাকতেই হবে।
অনেক সময় এ তাগিদ থেকেই তদন্তকারী কর্মকর্তাগণ শর্টকাটে আসামীর কাছ থেকে সরাসরি তথ্য আদায় করে তদন্ত শেষ করার চেষ্টা করতে পারেন। এ জন্য অনেক তদন্তকারী কর্মকর্তা আসামীকে কষ্ট দিয়ে তার কাছ থেকে তথ্য আদায়ের উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারে । কিন্তু অভিযুক্ত যদি ‘জেলে ঘুঘু’ হয়, শত চেষ্টাতেও তার কাছ থেকে তথ্য আদায় করা সম্ভব হবে না। অন্যদিকে প্রথমবার অপরাধে জড়িত ব্যক্তিগণ কিংবা ঘটনাচক্রে যারা অপরাধে জড়িয়ে পড়েছে তাদের কাছ থেকে তথ্য আদায়ের জন্য শারিরীক কষ্ট দেয়ার কোন প্রয়োজনই পড়ে না। অভিজ্ঞ জিজ্ঞাসাবাদকারীদের কথার মারপ্যাঁচেই তাদের থলের বেড়াল অল্পতেই বের হয়ে পড়ে। কারণ, পৃথিবীর সর্বাধিক কঠিন কাজগুলোর একটি হল, গোপন কথাকে গোপন রাখা। কেউ যদি মুখে সত্য স্বীকার করতে না চান, তার চেহারায় সত্য উদ্ভাসিত হয়।
অনেকে মনে করেন, গ্রেফতারকৃত ব্যক্তির কাছ থেকে তথ্য আদায় করা ছাড়া অপরাধের রহস্য উদ্ঘাটন করা সম্ভব নয়। কিন্তু মানুষের এ ধারণা বর্তমানে প্রায় অচল। ত্রিশ-চল্লিশ বছর আগে জ্বরের জন্য দেয়া তিতা ঔষধের দিন যেমন বর্তমানে আর নেই, তেমনি তথ্য আদায়ের জন্য আসামীকে শারিরীকভাবে কষ্ট দেওয়ার দিনও আর অবশিষ্ট নেই। আধুনিক তথ্য প্রযুক্তি, ফরেনসিক সাইন্সের ব্যবহার ও উন্নত জিজ্ঞাসাবাদ কৌশল প্রয়োগ করলে হার্ডকোর ক্রিমিনালগণও পুলিশের কাছে মুখ খুলতে বাধ্য হয়। কিন্তু সমস্যা হল, এব প্রযুক্তি আর কৌশল আয়ত্ত করার ব্যাপারে আমাদের পুলিশের পারঙ্গমতা এখনও কাঙ্খিত মানের নয়। তাই আমাদের উচিৎ হবে অতি দ্রুত এসব কৌশল অর্জনের চেষ্টা করা। একই সাথে পুলিশকে সাধারণ মানুষের সাথে জনসংযোগ বৃদ্ধি করতে হবে। জনশ্রুতির মাধ্যমে অর্জিত বিশ্বাস মানুষের বাস্তব অভিজ্ঞতায় বহুলাংশে পরিবর্তন করতে পারে। তাই আধুনিক পুলিশ নৈর্ব্যক্তিক নয়, ব্যক্তি ও সমাজ নির্ভর। পুলিশ অফিসারদের তাই আরো অধিকহারে গণসংযোগ করা উচিত। পুলিশের কর্মপদ্ধতির ধরন, কাজের সুযোগ ও সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে সাধারণ মানুষকে নানা উপায়ে অবহিত করা উচিত। কমিউনিটি পুলিশিং কার্যক্রম এক্ষেত্রে উত্তম ফল দিতে পারে।
লেখকঃ মোঃ আব্দুর রাজ্জাক
এআইজি, পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স, ঢাকা।