সম্প্রতি শ্রম আইনের বিধি মোতাবেক বাংলাদেশের একমাত্র নোবেল বিজয়ী প্রফেসর ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে রায় ঘোষণা করা হয়েছে। রায় ঘোষণার পরবর্তী সময়ে রায়কে ঘিরে পক্ষ বিপক্ষ মন্তব্য এসেছে এবং আসাটাই স্বাভাবিক।
একজন নোবেল বিজয়ীর বিরুদ্ধে বাংলাদেশের আদালতে বিচারকাজ নিষ্পত্তি হয়ে রায় হয়েছে বিষয়টিকে ইতিবাচক হিসেবেই নেয়া বাঞ্ছনীয় বলে মনে করি।
মামলার রায়ে যে বিষয়গুলো বলা হয়েছে দেশের যেকোন নাগরিক সহজে বুঝতে পারবেন।
কেননা আইনের দৃষ্টিতে বাংলাদেশের নাগরিক সমান। আপনার সামাজিক পরিচয় তথা প্রাতিষ্ঠানিক পরিচয় কিংবা রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় আপনি কোথায় রয়েছেন, সেটি বিবেচনায় না নিয়ে রাষ্ট্র আপনার কর্মকান্ডকে বিবেচনায় নিয়ে বিচার করবে এটাই আইনত। এর ব্যত্যয় হলে সেটি পক্ষপাতদুষ্ট হয়ে থাকে,পক্ষপাতমূলক বলা যায় তখন।
প্রফেসর ড. ইউনূস নি:সন্দেহে একজন সম্মানীয় ব্যক্তিত্ব। তার কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের আদালতে বিচার হয়েছে সেটি নিয়ে আলোচনা হবে সেটিও স্বাভাবিক। তবে যে জন্য আলোচনা যার জন্য বিচার হয়েছে ঘটনাটির পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ জরুরী এবং ঘটনার কার্যাকারণ না জানলে বিষয়টির মূল্যায়ন দূরহ হয়ে উঠবে। হুজুগে বিশ্বাসী অনেকেই বিচারের রায়কে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করবার চেষ্টা করবে এটাও মেনে নিতে হবে।
শ্রম আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে ১ জানুয়ারি নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনুস এবং তার তিন সহযোগীর প্রত্যেককে শ্রম আইনের ৩০৩ (ঙ) ধারা অনুযায়ী ছয়মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড ও পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা এবং ৩০৭ ধারা অনুযায়ী পঁচিশ হাজার টাকা জরিমানা প্রদান করেছেন আদালত। কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর কর্তৃক শ্রম আইন লংঘনের অভিযোগে গ্রামীণ টেলিকমের চেয়ারম্যান ডঃ মুহাম্মদ ইউনুস, ব্যবস্থাপনা পরিচালক আশরাফুল হাসান, পরিচালক নূর জাহান বেগম ও পরিচালক মোঃ শাহজাহানের বিরুদ্ধে ২০২১ সালে ৯ই সেপ্টেম্বর দায়েরকৃত মামলায় এই রায় প্রদান করেছেন শ্রম আদালত।
শ্রম আইন অনুযায়ী বিচারের রায় প্রদান করা হয়েছে, এ নিয়ে গুজবের কিছু নেই। একই সাথে আদালত প্রতিষ্ঠানটির শ্রমিকদের চাকুরি স্থায়ীকরণ, কল্যাণ ফান্ড গঠন, ছুটি নগদায়ন এবং কোম্পানির লভ্যাংশের ৫% শ্রমিকদের প্রদানপূর্বক আদালতকে অবহিত করার নির্দেশনা প্রদান করেছেন।
শ্রম আইন অনুযায়ী বিচারের রায় প্রদান করা হয়েছে, এ নিয়ে গুজবের কিছু নেই। একই সাথে আদালত প্রতিষ্ঠানটির শ্রমিকদের চাকুরি স্থায়ীকরণ, কল্যাণ ফান্ড গঠন, ছুটি নগদায়ন এবং কোম্পানির লভ্যাংশের ৫% শ্রমিকদের প্রদানপূর্বক আদালতকে অবহিত করার নির্দেশনা প্রদান করেছেন।
তবে মামলার শুরু থেকে মামলাটিকে ভিন্নখাতে নেয়ার লক্ষ্যে অনেকের প্রচেষ্টা লক্ষ্য করা গেছে। বিশেষ করে ডঃ মুহাম্মদ ইউনুসের আইনজীবী এবং দেশে বিদেশের তার কতিপয় শুভাকাঙ্ক্ষীগণ বলেছেন ড. মুহাম্মদ ইউনুসের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করার জন্যই মামলাটি দায়ের করা হয়েছে। ড. ইউনুসের পক্ষে বিবৃতি প্রদান করেছেন অনেক স্বনামধন্য ব্যক্তিবর্গও। দেশে বিদেশী নানাও গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে নানা বিভ্রান্তিকর প্রতিবেদন। তবে মামলার রায় ঘোষণার মধ্য দিয়ে তাদের বোধোদয় জাগ্রত হবে বলে মনে করি।
আদালতের রায়ে সুষ্পষ্টভাবে বর্ণিত হয়েছে, আদালত কোন নোবেল বিজয়ীয় বিচার করেনি, বরং গ্রামীণ টেলিকমে শ্রম আইন লংঘনের জন্য দায়ি ব্যক্তিদের বিচার করেছে। কাজেই এ মামলা নিয়ে যাদের বিভ্রান্তি ছিল, বিভিন্নভাবে প্ররোচিত হয়েছিল তাদের ভুল ভাঙবে এবং তাদের নিকট একটি বার্তা সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হবে বাংলাদেশের সরকার আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় বদ্ধপরিকর। একজন নোবেল বিজয়ীর কৃতকর্মের বিরুদ্ধে বিচার হয়েছে এবং এর প্রেক্ষিতে দেশি বিদেশী বিভিন্ন মহলের চাপের মুখে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে সরকারের। তা জেনেও এ মামলার বিচার কাজ নিষ্পত্তি করা সরকারের একটি সাহসী সিদ্ধান্ত।
মামলার নথিপত্র থেকে জানা যায়, কল কারখানা এবং প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের পরিদর্শক এস এম আরিফুজ্জামানের নেতৃত্বে একটি পরিদর্শন টিম ২০২০ সালে ৯ ফেব্রুয়ারি গ্রামীণ টেলিকম পরিদর্শন করে উক্ত প্রতিষ্ঠানে শ্রম আইনের কিছু বড় ধরনের লঙ্ঘন দেখতে পান। তারা দেখেন যে, প্রতিষ্ঠানটিতে শ্রমিকদের শিক্ষানবীশ কাল অতিক্রম করার পরেও স্থায়ী না করে তিন বছর অন্তর অন্তর চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ প্রদান করা হয় যা শ্রম আইনের লঙ্ঘন। আইনানুযায়ী স্থায়ী না করায় শ্রমিকগণ বিভিন্নভাবে ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত হচ্ছিলেন।
এছাড়া উক্ত প্রতিষ্ঠানে শ্রমিকদের শ্রম আইন অনুযায়ী বাৎসরিক ছুটি প্রদান করা হতো না, গঠন করা হয়নি কোন কল্যাণ তহবিল এবং শ্রমিকদের দেয়া হতো না কোম্পানির লভ্যাংশ থেকে প্রাপ্য ন্যায্য অংশ। পরিদর্শন শেষে এসকল ব্যত্যয়ের বিষয়ে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহনের নির্দেশনা দিয়ে চিঠি প্রদান করা হয় গ্রামীণ টেলিকম কর্তৃপক্ষকে।
পরবর্তীতে ২০২১ সালে ১৬ আগস্ট পুনরায় গ্রামীণ টেলিকম পরিদর্শনে যায় পরিদর্শন টিম। তখনো এই প্রতিষ্ঠানে পূর্বোক্ত শ্রম আইনসমূহের লংঘন পরিলক্ষিত হওয়ায় পুনরায় নোটিশ প্রদান করা হয়। গ্রামীণ টেলিকম থেকে প্রাপ্ত জবাবে সন্তুষ্ট না হয়ে অবশেষে একই বছরের ৯ সেপ্টেম্বর তৃতীয় শ্রম আদালতে মামলাটি দায়ের করা হয়।
অর্থাৎ এটি পরিষ্কার যে, কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর বিভিন্ন সময়ে নোটিশ প্রদান করে অসঙ্গতি তুলে ধরে তা সমাধানের ব্যাপারে তাগাদা দিতে থাকেন। সকল কিছুর পরেও যখন পরিস্থিতির উত্তরণ ঘটেনি তখন অধিদপ্তর শ্রম আদালতে মামলা দায়ের করেন।
২০২১ সালের ৯ সেপ্টেম্বর শ্রম আদালতে মামলা দায়ের হবার পর উক্ত মামলা বাতিলের দাবিতে উচ্চ আদালতে রিট পিটিশন দায়ের করেন ডঃ মুহাম্মদ ইউনুস। উক্ত রিট পিটিশন খারিজ হবার প্রেক্ষিতে সুপ্রিম কোর্টে আপিল আবেদন করেন। সেটিও খারিজ হবার পর শ্রম আদালতে মামলার কার্যক্রম তথা চার্জ গঠন করা হয়।
উক্ত চার্জ গঠনের বাতিল চেয়ে পুনরায় উচ্চ আদালতে রিট পিটিশন এবং সেটি খারিজ হবার পর সুপ্রিম কোর্টে আপিল আবেদন করেন ডঃ মুহাম্মদ ইউনুস।
সেটিও চূড়ান্তভাবে খারিজ হবার পর ২০২৩ সালের ২২ আগস্ট অর্থাৎ মামলা দায়ের প্রায় দুই বছর পর শ্রম আদালতে মামলার সাক্ষ্যগ্রহন কার্যক্রম শুরু হয়। উক্ত মামলা বাতিলের দাবিতে ড. ইউনূস একাধিবার উচ্চ আদালতে রিট পিটিশন এবং সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে আপিল দায়ের করেছেন।
যথাযথ আইনী প্রক্রিয়ায় সেগুলো সুরাহা হবার পরেই মামলাটির নিয়মতান্ত্রিক কার্যক্রম চালু হয়। উক্ত মামলায় সর্বমোট ২১ কার্যদিবসের শুনানি অনুষ্ঠিত হয়।
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের আইনজীবী মামলার বাদীকে সর্বমোট ৭ কার্যদিবস জেরা করেন যা নজিরবিহীন। এছাড়াও তিনি ৮ কার্যদিবস যুক্তি তর্ক উপস্থাপন করেন। এতো দীর্ঘসময় যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের নজির শ্রম আইন সংক্রান্ত কোন মামলায় কখনো দেখা যায়নি।
চলতি নতুন বছরের প্রথম দিন প্রদানকৃত আলোচিত রায়টি শ্রমিকদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।আশা রাখি ড. ইউনুস আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার প্রদান করবেন। তবে আমরা আরও প্রত্যাশা করি ও বিশ্বাস রাখি, যারা রাঘববোয়াল রয়েছেন হোয়াইট কলার ক্রাইমের সঙ্গে যুক্ত, মানি লন্ডারিং এর সাথে সম্পৃক্ত, ঋণ খেলাপি তাদেরকে সনাক্ত করে যথাযথ প্রক্রিয়ায় আইনের মুখোমুখি করতে হবে।
প্রমাণ করতে হবে রাষ্ট্রীয় আইন সকলের জন্যই প্রযোজ্য এবং আপনি যেই হোন না কেন রাষ্ট্রীয় আইনের উর্ধ্বে আপনি নন। এ বার্তা সকলের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে পারলে সামাজিক অবস্থান, প্রাতিষ্ঠানিক অবস্থানকে কাজে লাগিয়ে কেউ অপরাধ করার দুঃসাহস দেখাবে না।
সূত্র: চ্যানেল আই অনলাইন