গাজীপুর সিটি করপোরেশনে সুষ্ঠু নির্বাচনে ‘সন্তুষ্টি’ প্রকাশ করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। সংসদ নির্বাচনের আগে ট্রায়াল রানে নিজেদের উত্তীর্ণ দাবিও করেছে তারা। সিটি নির্বাচনের প্রথম দফার নির্বাচনের মাধ্যমে নিজেদের কিছুটা হলেও নির্ভার ভাবতে শুরু করেছে এই সাংবিধানিক সংস্থাটি। নির্বাচন বিশ্লেষকরাও নির্বাচনকে ‘সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ’ বলে উল্লেখ করেছেন। অন্যতম বিরোধী দলের প্রার্থী না থাকায় অন্য চার সিটির নির্বাচনও এমনটা হবে বলেও প্রত্যাশা তাদের।
তবে কেউ কেউ বলছেন, সিটি নির্বাচনের সঙ্গে তুলনা করে জাতীয় সংসদ নির্বাচনও এমন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হবে; সেটা ভাবার সুযোগ নেই। দুটি নির্বাচন সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের। সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট জাতীয় নির্বাচনের সঙ্গে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে কোনোভাবেই মেলানো যাবে না। গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন বিষয়ে বাংলা ট্রিবিউনকে দেওয়া প্রতিক্রিয়ায় নির্বাচন সংশ্লিষ্টরা এমন কথা বলেন।
ইসি ঘোষিত তিন দফায় ৫ সিটির ভোটের প্রথম দফায় বৃহস্পতিবার গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী আজমত উল্লা খানকে পরাজিত করে মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী জায়েদা খাতুন। ১৬ হাজার ১৯৭ ভোটের ব্যবধানে তিনি নৌকা প্রতীকের প্রার্থী পরাজিত করেছেন কোনও রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত না থাকা জায়েদা খাতুন। অবশ্য তিনি গাজীপুর সিটির সদ্য সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীরের মা, এই পরিচয়েই তার নির্বাচনে অংশগ্রহণ এবং ছেলের জনপ্রিয়তার সূত্র ধরে নির্বাচিত হয়েছেন জায়েদা খাতুন।
নির্বাচনপূর্ব কিছু আচরণবিধি লঙ্ঘনের মতো ঘটনা ছাড়া নির্বাচনটি সম্পূর্ণ অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ হয়েছে। নির্বাচনে জয়লাভ করে জায়েদা দেশের প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন। তিনি এই বিজয় গাজীপুরবাসী এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে উৎসর্গ করেছেন।
পাশাপাশি বিজিত প্রার্থী আজমত উল্লাহ খানও নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে উল্লেখ করে ফলাফল মেনে নিয়েছেন। তিনি বলেছেন, পরাজয়ের কারণ পর্যালোচনা করা হবে। পরাজয়ের কী কী কারণ ছিল তা জানানো হবে। তিনি বিজয়ী মেয়র জায়েদাকে সবধরনের সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। অবশ্য ভোটগ্রহণের সময় ইভিএমে কিছু ত্রুটি ছিল ছিল উল্লেখ করে বলেছেন, অনেকে ভোট দিতে পারে নাই।
কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন বর্তমান কমিশনের অধীনে অনুষ্ঠিত তৃতীয় এই সিটি করপোরেশন নির্বাচনটি সুষ্ঠু ও সুন্দর হয়েছে বলে জানিয়েছেন নির্বাচন সংশ্লিষ্টরা। তারা নির্বাচনটিকে ‘আইনানুগ ও গ্রহণযোগ্য’ বলে উল্লেখ করেছেন। এর পেছনে মার্কিন নতুন ভিসানীতি কাজ করতে পারে বলেও তারা মনে করেন। নির্বাচনটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হলেও সংসদ নির্বাচনের আগে এটা ‘ট্রায়াল রান’ আখ্যায়িত করে ইসি যে সন্তুষ্টি প্রকাশ করছে সেটি ঠিক নয় বলেও মন্তব্য করেছেন কেউ কেউ। তারা বলছেন, এই নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে বলেই আসন্ন দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন তেমনটি হবে এটা বলা যাবে না। তাদের অভিমত, সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট না থাকা কোনও নির্বাচনকে সরকার পরিবর্তন সম্পর্কিত কোনও নির্বাচনের সাথে মেলানো যাবে না।
অবশ্য বর্তমান কমিশনের অধীনে এর আগে অনুষ্ঠিত কুমিল্লা ও রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনও সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ হয়েছিল। তবে, ফলাফল ঘোষণা নিয়ে কুমিল্লায় কিছুটা সমালোচনা তৈরি হয়েছিল।
নির্বাচন কমিশন আগেই গাজীপুর সিটি করপোরেশনসহ তফসিল ঘোষিত অন্য চার সিটির নির্বাচনে ‘স্টেজ রিহার্সেল’ বলে আখ্যায়িত করেছে নির্বাচন কমিশন। গাজীপুরের ভোট শেষে কমিশনার আলমগীর বলেছেন, স্টেজ রিহার্সেলে তারা সন্তুষ্ট। তিনি বলেন, ‘নির্বাচন অত্যন্ত সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ হয়েছে। অবাধ ও সুন্দরভাবে নির্বাচন হয়েছে। নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী মেয়র প্রার্থীরাও বলেছেন, নির্বাচন ব্যবস্থাপনায় তারা অত্যন্ত সন্তুষ্ট। সবাই বলেছে নির্বাচন নিরপেক্ষভাবে হয়েছে।’
‘নির্বাচন সুষ্ঠু ও সুন্দর হয়েছে’ জানিয়ে সুশাসনের জন্য নাগরিক সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার এক প্রতিক্রিয়য়ি বলেন, ‘এই ভোটে দৃশ্যমানভাবে কোনও অশান্তি ঘটেনি। কোনও অনিয়ম ও সহিংসতা হয়নি বলেও আমাদের কাছে প্রতীয়মান হয়েছে। তবে এটা এই নয় যে, এই নির্বাচনটি যেভাবে হয়েছে দেশের সব নির্বাচন সেইভাবে হবে।’
মার্কিন নতুন ভিসানীতির প্রভাব নির্বাচনে পড়েছে এমনটা মনে করেন তিনি। বলেন, ‘তারা ভিসা প্রদানের ক্ষেত্রে যে বিধি নিষেধের কথা বলেছে, সেটার জন্য ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মী, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ প্রশাসনের লোকজন এমন কি খোদ নির্বাচন কমিশনকে দায়িত্বশীল আচরণ করতে হয়তো বাধ্য করেছে। কারণ তাদের মাথার ওপর একটি খড়গ চেপেছে।’
নির্বাচন শান্তিপূর্ণ হলেও বিশ্বাসযোগ্য ছিল না বলে দাবি করে বদিউল আলম বলেন, ‘এই নির্বাচনে কোনও বিশ্বাসযোগ্য বিকল্প ছিল না। জায়েদা খাতুন ও আজমত উল্লা খানের মধ্যে বিস্তর ফারাক। সেটা শিক্ষাগত যোগ্যতা, রাজনীতিসহ সকল ক্ষেত্রে। জায়েদা খাতুনকে তো মানুষ চেনেই না। তিনি জাহাঙ্গীরের মা এটাই ছিল তার একমাত্র পরিচয়। বিশ্বাসযোগ্য না হলে তাকে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ বলা যাবে না।
দেশের প্রধান বিরোধী দলের প্রার্থী না থাকার নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘বিরোধী দল না থাকার কারণে সরকারি দল, প্রশাসন বা অন্য কারও বাড়াবাড়ি করার প্রয়োজন হয়নি। আমার মনে হয় বাকি সিটি করপোরেশনগুলোর নির্বাচনও এ ধরনের গ্রহণযোগ্য হবে। একমাত্র বরিশালে ব্যতিক্রম কিছু হয়তো হতে পারে। তবে, এর থেকে কোনোভাবেই বলা যাবে না-আগামী জাতীয় নির্বাচন এমনটা হবে। কারণ জাতীয় নির্বাচনের হিসাব-নিকাশ ভিন্ন। সেখানে ক্ষমতার রদবদলের প্রশ্ন রয়েছে। কাজেই এখানে শান্তিপূর্ণ হয়েছে বলেই সংসদ নির্বাচনে এমন হবে তা কোনোভাবেই বলা যায় না।’
নির্বাচন কমিশনের ট্রায়াল রান প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘এই নির্বাচনকে কোনোভাবেই জাতীয় নির্বাচনের ট্রায়াল রান বলা যাবে না। নির্বাচন কমিশন যে পরীক্ষায় পাস করার কথা বলছেন। সেই পরীক্ষা আর সংসদ নির্বাচনের পরীক্ষা ভিন্ন। সেটা আরও কঠিন ও জটিল। কাজেই এটাতে পাস করলেই যে জাতীয় নির্বাচনে পাস করে যাবেন এটা ভাবার কোনও কারণ নেই।’
সাবেক নির্বাচন কমিশনার মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন বলতে যেটা বুঝায় তা লম্বা প্রক্রিয়া। এটা বাংলাদেশের মতো দেশে কোনোদিনই করা সম্ভব হয় না। যেটা হয় তা হলো আইনানুগ ও গ্রহণযোগ্য। যেহেতু প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক ও আইনের মধ্য থেকে হয়েছে এবং ফলাফল সকলের কাছে প্রতীয়মান হয়েছে। সেজন্য আমরা এটাকে আমরা গ্রহণযোগ্য নির্বাচন বলতে পারি। তবে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর আচরণবিধি লঙ্ঘন, নির্বাচনি প্রচারণায় বাধা দেওয়া হয়েছে। অনেক জায়গায় এজেন্ট ঢুকতে দেওয়া হয়নি, গণমাধ্যমের প্রবেশাধিকারেও কড়াকড়ি ছিল। এগুলো কিন্তু এই নির্বাচনেও ছিল। আমার মনে হয় আমাদের দেশ থেকে এটা রাতারাতি তুলে দেওয়া যাবে না।’
তিনি বলেন, ‘স্থানীয় সরকার নির্বাচনের সাথে জাতীয় নির্বাচনের তেমন কোনও সম্পর্ক থাকে না। এখানে সমস্ত ফোর্স নিয়ে একটি মাত্র ভোট পরিচালনা হচ্ছে। কিন্তু সংসদ নির্বাচনে এক দিনে ৩০০ আসনে ভোট করতে হয়।’
এদিকে শুক্রবার এক অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ও সড়ক পরিবহন মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘গাজীপুর সিটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী বিজয়ী হলে দেশের মানুষ যতটা খুশি হতেন, তার চেয়ে বেশি খুশি হয়েছেন ফ্রি অ্যান্ড ফেয়ার নির্বাচন হওয়ায়। এ জন্য নির্বাচন কমিশনকে ধন্যবাদ জানাই, জনগণকে ধন্যবাদ জানাই এবং বিজয়ী প্রার্থীকে অভিনন্দন জানাই।’
এই নির্বাচনে একটা বিষয় পরিষ্কার হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, বিএনপি এতদিন মিথ্যাচার করে আসছে— এই সরকারের অধীনে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব নয়, সেটি মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। শেখ হাসিনা ওয়াদা পূরণ করেছেন। আওয়ামী লীগ প্রার্থী হারবে কিনা তার চেয়ে বড় কথা হলো গণতন্ত্র জয়লাভ করেছে। বিট্রি