প্রাথমিক থেকে উচ্চ মাধ্যমিক, সর্বস্তরের শিক্ষকরাই আন্দোলনে। তাদের কেউ জোটবদ্ধ হয়ে, আবার কেউ স্বতন্ত্র সংগঠন হিসেবে আন্দোলন করছেন। অনেক সংগঠনের অস্তিত্ব আবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেই সীমাবদ্ধ। নেতা হলেই বাড়ে পরিচিতি। তাই একদল শিক্ষক ব্যস্ত সংগঠনের সংখ্যা বাড়াতে। তাদের এ বিভক্তির পেছনে রয়েছে রাজনীতিও। দেশের প্রধান দুই দলের অনুসারীরা আলাদা আলাদাভাবে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন। ফলে দিন শেষে দাবি আদায় হচ্ছে না বলে মত সংশ্লিষ্টদের।
জানা গেছে, গ্রেড বৃদ্ধি ও পদোন্নতির দাবিতে দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করছেন প্রাথমিকের শিক্ষকরা। তাদের মূল সংগঠন ছিল চারটি। এগুলো হলো প্রাথমিক শিক্ষক সমিতি, প্রাথমিক সহকারী শিক্ষক সমিতি, প্রাথমিক সহকারী শিক্ষক সমাজ এবং বাংলাদেশ প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রধান শিক্ষক সমিতি। তবে বিভিন্ন মতপার্থক্যের কারণে এসব সংগঠনে দেখা দিয়েছে ভাঙন। এতে প্রাথমিক শিক্ষক সমিতি পাঁচ ভাগ, প্রাথমিক সহকারী শিক্ষক সমাজ চার ভাগ, প্রাথমিক সহকারী শিক্ষক সমিতি দুই ভাগ এবং বাংলাদেশ প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রধান শিক্ষক সমিতি চার ভাগ হয়েছে। সব মিলিয়ে এখন প্রাথমিকের শিক্ষকদের সংগঠন আছে অন্তত ১৬টি। তাদের এই বিভক্তির মূলে রয়েছে নেতা হওয়ার অভিপ্রায়।
প্রাথমিকের শিক্ষক নেতারা জানান, ১৯৩৫ সালে নিখিল বঙ্গ প্রাথমিক শিক্ষক সমিতি গঠিত হয়। এরপর ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাজনের পর ইস্ট পাকিস্তান প্রাইমারি টিচার্স অ্যাসোসিয়েশনের আত্মপকাশ ঘটে। ১৯৭২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি যাত্রা শুরু করে বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষক সমিতি। ১৯৯৪ সালে এই সংগঠনের কাউন্সিলের পর নেতৃত্বে আসতে না পেরে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি নামে আরেকটি সংগঠনের জন্ম হয়।
এদিকে প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির অধ্যাপক আবুল কালাম আজাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, তাই তিনি প্রাথমিকের শিক্ষক সংগঠনের নেতা হতে পারবেন না মর্মে ২০০৮ সালে মামলা করে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি। হাইকোর্টের নির্দেশনা মেনে তিনি সরে দাঁড়ালেও প্রাথমিক শিক্ষক সমিতি নামে আরেকটি সংগঠনের আত্মপ্রকাশ ঘটে। পরে ২০১২ সালের কাউন্সিলে নেতৃত্বে আসতে না পেরে একই নামে আরও একটি সংগঠন গঠিত হয়। ২০১৬ সালের কাউন্সিলে একজন সাধারণ সম্পাদক পদপ্রার্থীর অর্থ আত্মসাতের মামলার বিষয়টি সামনে আসে। তাকে সমিতি থেকে বহিষ্কার করা হলে ওই বছরের কাউন্সিলের আগেই নিজেকে সভাপতি ঘোষণা করে আরেকটি সংগঠন দাঁড় করান তিনি।
২০১৪ সালের ৯ মার্চ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রাথমিকের প্রধান শিক্ষকদের দ্বিতীয় শ্রেণির পদমর্যাদা ঘোষণা করেন। ফলে প্রধান শিক্ষক ও সহকারী শিক্ষক একসঙ্গে সংগঠন করতে পারবেন না মর্মে প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির একটি গ্রুপ থেকে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রধান শিক্ষক সমিতি গঠন করে। এই সমিতির কিছু শিক্ষক মিলে আবার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় সহকারী শিক্ষক সমিতি, আর কিছু শিক্ষক সহকারী শিক্ষক সমাজ গড়ে তোলেন। এগুলোও পরে কয়েক ভাগ হয়।
বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির সভাপতি আবুল কাশেম বলেন, সবাই নেতা হতে চায়, এটাই শিক্ষক বিভাজনের মূল কারণ। প্রাথমিকের বেশিরভাগ সংগঠনের কার্যক্রম ফেসবুকভিত্তিক। এসব সংগঠনের কাউন্সিল হয় না। ফেসবুকে ঘোষণা দিয়ে তারা কমিটি গঠন করে।
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বাইরে মাদ্রাসার ইবতেদায়ি স্তরের শিক্ষকদেরও কিছু সংগঠন রয়েছে। সেগুলো হলো বাংলাদেশ স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসা শিক্ষক সমিতি, স্বাধীনতা সংযুক্ত ইবতেদায়ি মাদ্রাসা শিক্ষক পরিষদ এবং জোট হিসেবে আছে স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসা শিক্ষক ঐক্যজোট।
শিক্ষক নেতারা জানান, স্কুল-কলেজ, মাদ্রাসা ও কারিগরিতে বেসরকারি এমপিওভুক্ত স্কুল-কলেজের শিক্ষকরা জাতীয়করণের এক দাবিতে আন্দোলন করছেন। প্রধানত, তিনটি সংগঠন এই আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। সেগুলো হলো বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি (বিটিএ), শিক্ষক-কর্মচারী ঐক্যজোট এবং স্বাধীনতা শিক্ষক পরিষদ (স্বাশিপ)। এর মধ্যে শিক্ষক-কর্মচারী ঐক্যজোটের মাধ্যমিক শিক্ষক সমিতি, কলেজ শিক্ষক সমিতি, মাদ্রাসা শিক্ষক সমিতি এবং কর্মচারী সমিতি রয়েছে। এ জোটে বিএনপিপন্থি শিক্ষক-কর্মচারী বেশি। তবে কিছু আওয়ামী ও বাম সমর্থক শিক্ষকও রয়েছেন। এ ছাড়া, স্বাধীনতা শিক্ষক পরিষদের সঙ্গে আছে স্বাধীনতা মাদ্রাসা শিক্ষক পরিষদ ও স্বাধীনতা কারিগরি শিক্ষক পরিষদ। সংগঠনটি পুরোটাই আওয়ামীপন্থি শিক্ষকে ভরপুর। অন্যদিকে বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতিও আওয়ামী অনুসারীদের নিয়ে গঠিত। রাজনৈতিক বিভক্তির কারণে একসঙ্গে তারা কোনো কর্মসূচি দিতে পারেন না। উল্টো, কর্মসূচিকে সামনে রেখে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পক্ষে-বিপক্ষে চলে বাকবিতণ্ডা।
এসব সমিতি, পরিষদ, ফোরামের বাইরেও রয়েছে অসংখ্য সংগঠন। সেসব সংগঠনেও আছে বিভক্তি। কিছু সংগঠন স্বতন্ত্র, আবার কিছু জোটবদ্ধ হয়ে আন্দোলন করে। জাতীয়করণের দাবিতে আন্দোলনকারী সংগঠনগুলো হলো বেসরকারি শিক্ষক ফোরাম, বাংলাদেশ শিক্ষক ফোরাম, বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারী ফোরাম, বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি (আমানউল্লাহ), বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি (মান্নাফি), বাংলাদেশ মাধ্যমিক শিক্ষক সমিতি, বাংলাদেশ মাধ্যমিক সহকারী শিক্ষক সমিতি, বাংলাদেশ সরকারি মাধ্যমিক শিক্ষক সমিতি, সরকারি মাধ্যমিক স্বাধীনতা শিক্ষক পরিষদ, বাংলাদেশ সরকারি কলেজ শিক্ষক পরিষদ/সোসাইটি, বেসরকারি কারিগরি শিক্ষক সমিতি, বাংলাদেশ কারিগরি কলেজ শিক্ষক সমিতি, বাংলাদেশ পলিটেকনিক শিক্ষক সমিতি, টেকনিক্যাল ইডুকেশন কনসোর্টিয়াম অব বাংলাদেশ, মাধ্যমিক কারিগরি শিক্ষক পরিষদ ইত্যাদি। এ ছাড়াও আছে এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারী জাতীয়করণপ্রত্যাশী ঐক্যজোট, বাংলাদেশ শিক্ষা জাতীয়করণ পরিষদ, বাংলাদেশ শিক্ষক-কর্মচারী জাতীয়করণ মঞ্চ ইত্যাদি।
সম্প্রতি জাতীয়করণের দাবিতে ৪৪ দিন জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেছে এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারী জাতীয়করণপ্রত্যাশী ঐক্যজোট। জোটের সদস্য সচিব জসিম উদ্দিন জানান, বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির তিনটি অংশ, শিক্ষক ফোরামের দুটি, বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষক ফোরাম, কারিগরি শিক্ষক পরিষদ, শিক্ষক ইউনিয়নসহ মোট ১৫টি সংগঠন জোটভুক্ত হয়ে জাতীয়করণের দাবিতে আন্দোলন করছে।
এক দাবিতে কেন এত সংগঠন–এ প্রসঙ্গে স্বাধীনতা মাদ্রাসা শিক্ষক পরিষদের সাধারণ সম্পাদক তেলাওয়াত হোসেন বলেন, এদেশে জাতীয়করণের দাবি স্বাধীনতা শিক্ষক পরিষদের সাধারণ সম্পাদক শাহজাহান আলী সাজুই সবার আগে তুলেছেন। মাদ্রাসা, কারিগরি, স্কুল, কলেজ সব মিলিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী একমাত্র সংগঠন স্বাধীনতা শিক্ষক পরিষদ। শুধু রাস্তায় শুয়ে থাকলেই তো দাবি আদায় হবে না। দাবি আদায় করতে প্রধানমন্ত্রীকে রাজি করাতে হবে।
স্বাধীনতা শিক্ষক পরিষদের (স্বাশিপ) সাধারণ সম্পাদক শাহজাহান আলী সাজু বলেন, ২০১৫ সালে সর্বপ্রথম আমিই ঘোষণা দেই, জাতীয়করণ ছাড়া স্বাশিপ ঘরে ফিরবে না। এখনো আমাদের সেই দাবি আছে; কিন্তু এখন যারা আন্দোলন করছেন তারা মূলত ফেসবুকভিত্তিক সংগঠন। হুট করেই অনেকে রাস্তায় শুয়ে পড়ছেন। আন্দোলন মানেই তো রাজপথ বন্ধ করে দেওয়া নয়।
কালবেলা পত্রিকা অনলাইনের সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
শিক্ষক-কর্মচারী ঐক্যজোটের আহ্বায়ক অধ্যক্ষ সেলিম ভূঁইয়া বলেন, শাহজাহান আলী সাজু কীভাবে সবার আগে জাতীয়করণের দাবি তোলে? যেখানে আমাদের আন্দোলনই শুরু হয়েছে ১৯৯৪ সাল থেকে। সাজু তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। এখন অনেকে সংগঠন দাঁড় করাচ্ছে, আবার অনেকে ফেসবুকে পেজ আর গ্রুপ খুলে নেতা হয়ে যাচ্ছে।
এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারী জাতীয়করণপ্রত্যাশী ঐক্যজোটের সদস্য সচিব জসিম উদ্দিন বলেন, অধ্যক্ষ সেলিম ভূঁইয়া যখন অবসর কল্যাণের দায়িত্বে ছিলেন, তখন দাবি বাস্তবায়ন না হলে হুট করেই চেয়ার ছেড়ে দিয়ে রাজপথে আন্দোলনের ঘোষণা দিয়েছিলেন এবং সেটি তিনি করেছেনও; কিন্তু শাহজাহান সাজু সেটি করেননি। তিনি সংবাদ সম্মেলন করেছেন। এ দিয়ে কি দাবি আদায় হয়? শাহজাহান আলী সাজু বলেছেন, আলোচনা করবেন। কোন দিন করবেন, ক্ষমতা চলে গেলে? আমরা তাকে অবমূল্যায়ন করতে চাই না; কিন্তু তিনি নিজেই তার কর্মকাণ্ড দ্বারা অবমূল্যায়িত হচ্ছেন।
এদিকে শিক্ষাবিদরা বলছেন, শিক্ষকদের দাবি আদায় করতে হলে ভেদাভেদ ভুলতে হবে এবং ঐক্যবদ্ধভাবে দাবি আদায়ে চাপ দিতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক মজিবুর রহমান বলেন, অন্য পেশার তুলনায় শিক্ষকরা নানাবিধভাবে বঞ্চিত। এর পেছনে অনেক কারণের মধ্যে একটি হলো, তারা ঐক্যবদ্ধভাবে তাদের দাবিগুলো চাপ সৃষ্টি করতে পারে না। আরেকটি হলো পেশাজীবী সংগঠন হিসেবে তাদের যে ধরনের কাজ করার কথা ছিল, তারা সেই ধরনের কাজ না করে নেতৃত্ব এবং খণ্ড-বিখণ্ড রাজনৈতিক মতাদর্শ দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছে।
তিনি বলেন, শিক্ষকরা গবেষণা করবে, লিখবে, সভা, সেমিনার, সিম্পোজিয়াম করবে। এর মাধ্যমে সাধারণ মানুষদের কাছে তাদের দাবির বিষয়গুলো জানাবে; কিন্তু সেটি না করে তারা রাজনৈতিক দলাদলি দ্বারা বিভক্ত। তাদের দাবির যৌক্তিকতা যদি নাগরিক সমাজ, অন্য পেশার মানুষসহ বিভিন্ন ফোরামের মধ্য দিয়ে উঠে আসে, তাহলে হয়তো সরকার চাপ অনুভব করবে। ভেদাভেদ ভুলে গেলে এটি করা গেলে তারা দাবি বাস্তবায়ন করতে পারবে।সুত্র: কালবেলা