টঙ্গীর তুরাগ নদের তীরে শুরু হয়েছে বিশ্ব ইজতেমা, কানায় কানায় ভরে গেল ইজতেমার মাঠ। জায়গা না পেয়ে ফিরে যাচ্ছে হাজার হাজার মুসুল্লিরা–
টঙ্গীর তুরাগ নদের তীরে শুরু হয়েছে দাওয়াতে তাবলিগের ৫৬তম বিশ্ব ইজতেমার প্রথমপর্ব। আজ বাদ ফজর আম বয়ানের মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে ইজতেমার কার্যক্রম শুরু হয়।
তবে এর আগে বৃহস্পতিবার দুপুরের আগেই ইজতেমা ময়দান ও আশপাশের এলাকা, সড়ক ও ভবন কানায় কানায় ভরে যায়। এ কারণে বাদ জোহর থেকেই শুরু হয় তালিমি বয়ান। আজ এ ময়দানে দেশের বৃহত্তম জুমার জামাত অনুষ্ঠিত হবে। রোববার দুপুরের আগে মোনাজাতের মধ্য দিয়ে শেষ হবে প্রথমপর্ব।
১১ জানুয়ারি বুধবার থেকেই ধর্মপ্রাণ মুসল্লিরা ময়দানে যোগদান শুরু করেন। বৃহস্পতিবার সকাল হতে না হতেই ইজতেমার ময়দান ও আশপাশের এলাকা মুসল্লিদের জমায়েতে পূর্ণ হয়ে ওঠে। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে দুপুর বা এরপর আসা মুসল্লিদের বড় অংশকেই ফিরে যেতে হয়েছে। কেউ কেউ এখানে ঠাঁই না পেয়ে ঢাকায় তাদের নিকটাত্মীয়দের কাছে আশ্রয় নিয়েছেন।
তবে সন্ধ্যায় এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত মুসল্লিদের ময়দানমুখী স্রোত অব্যাহত ছিল। তারা জানিয়েছেন, থাকার জায়গা না পেলেও বয়ান শুনে অন্য কোথাও গিয়ে অবস্থান নেবেন।
বৃহস্পতিবার সন্ধার হওয়ার আগ পর্যন্ত ভারত, সিরিয়া, পাকিস্তান, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, চাঁদ, মিয়ানমার, আফগানিস্তানসহ ৪০ দেশের প্রায় দুই হাজার বিদেশি মেহমান ময়দানের নির্ধারিত নিবাসে অবস্থান নিয়েছেন। এ তথ্য জানিয়েছেন বিশ্ব ইজতেমার মিডিয়া সমন্বয়কারী মুফতি জহির ইবনে মুসলিম । তিনি বলেন, বিদেশিদের মধ্যে ভারত থেকে সর্বোচ্চ সংখ্যক মুসল্লি ময়দানে অবস্থান নিয়েছেন।
ইজতেমা শুরুর মধ্য দিয়ে ইবাদত-বন্দেগি আর আল্লাহর গুণবাচক ধ্বনিতে মুখর হয়ে উঠেছে ময়দান। বয়ান, কারগুজারি, তাশকিল, তালিম, কুরআন তিলাওয়াত, জিকির-আসকার ও ইবাদত বন্দেগিতে মশগুল মুসল্লিরা। বাংলাদেশের মাওলানা রবিউল হক বাদ জোহর তালিমি বয়ান করেন। বাদ আছর বয়ান করেন ভারতের মাওলানা ফারুক, বাদ মাগরিব ভারতের মাওলানা ইব্রাহিম দেওলা। তার বয়ান বাংলায় ভাষান্তর করেন কারি জুবায়ের আহমেদ।
আজ বাদ ফজর পাকিস্তানের মাওলানা জিয়াউল হকের আম বয়ানের মধ্য দিয়ে ইজতেমার আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু হয়। ইজতেমায় আসা দুই মুসল্লি বৃহস্পতিবার ইন্তেকাল করেছেন। এরা হলেন-সিলেটের জৈন্তাপুর থানার হরিপুরের হেমুবটে পাড়া গ্রামের ফজলুল হকের ছেলে নুরুল হক (৬৩) ও গাজীপুর মহানগরীর ভিরুলিয়া এলাকার আবু তৈয়ব ওরফে আবু তালেব (৯০)।
ময়দানের লাশের জিম্মাদার মাওলানা মহাম্মদ শাকের জানিয়েছেন, ৬২ নম্বর খিত্তায় অবস্থানকালে নুরুল হক জানান, শ্বাসকষ্টজনিত রোগে ও তৈয়ব আলী বার্ধক্যজনিত কারণে মারা যান। ময়দানে জানাজা শেষে স্বজনদের কাছে লাশ হস্তান্তর করা হয়েছে।
যেসব শূরা সদস্য ময়দানে : ইজতেমা ময়দানে ভারত ও পাকিস্তানের বেশ কয়েকজন শূরা সদস্য উপস্থিত রয়েছেন। এর মধ্যে রয়েছেন-ভারতের মাওলানা আহমদ লাট, মাওলানা ইব্রাহিম দেওলা, মাওলানা ফারুক, মাওলানা জুহায়েরুল হাসান, মাওলানা ইসমাইল গোদরা ও পাকিস্তানের মাওলানা জিয়াউল হক, মাওলানা খুরশিদ আলম, মাওলানা ডা. নওশাদ, মাওলানা হাসমত উল্লাহ, মাওলানা আনিসুর রহমান, মাওলানা বখতে মুনির ও মাওলানা শাহেদ। এ ছাড়াও মাওলানা মুফতি মাহফুজ, মুফতি আকবর শরিফ, মাওলানা ওয়াহিদ, মাওলানা শওকত ময়দানে রয়েছেন।
মেডিকেল ক্যাম্প চিকিৎসার স্থান: বৃহস্পতিবার দুপুরে যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেল ইজতেমা ময়দান পরিদর্শন করেন। পরে তিনি ময়দানের উত্তর-পশ্চিম কোণে অলিম্পিয়া টেক্সটাইল মিলস উচ্চবিদ্যালয় মাঠে স্থাপিত হামদর্দ ল্যাবরেটরিজের স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র উদ্বোধন করেন।
ইজতেমার ময়দানে থাকা ও বসান স্থান সংকট :
যারা নির্ধারিত খিত্তায় স্থান পাননি তারা বাধ্য হয়ে ময়দানের বাউন্ডারির বাহিরে চার পাশের খালি জায়গা ও ফুটপাতে ইস্তেমায়ি সামানা নিয়ে বসে পড়েছেন। গাইবান্ধার মুসল্লি আলী নেওয়াজ (৬৫) জানালেন তাদের জন্য নির্ধারিত ৩৩নং খিত্তায় মুসল্লি পূর্ণ হয়ে যাওয়ায় তিনি বাধ্য হয়ে বাটা সু কারখানার সামনের রাস্তায় অবস্থান নিয়েছেন।
চট্টগ্রাম থেকে আসা মুসল্লি সোলেমান মিয়া (৬০) বলেন, ময়দানের আমাদের খিত্তা নং-৭৪। রাতে ময়দানে গিয়ে দেখি পুরো খিত্তায় মুসল্লিতে ঠাসা। খিত্তায় জায়গা না পেয়ে ময়দানের বাইরে অবস্থান নিয়ে ইবাদত-বন্দেগি করে যাচ্ছি।
জায়গা না পেয়ে ফিরে যাচ্ছেন হাজার হাজার মুসল্লিরা
ময়দানে ও তার আশপাশে কোথাও ঠাঁই না পেয়ে ফিরে যাচ্ছেন অনেক মুসল্লি-এমনটি জানিয়েছেন রাজশাহী থেকে আসা মুসল্লি বজলুর রহমান, হাসান মিয়া, ওমর আলী। তারা জানান, বৃহস্পতিবার সকালে প্রথমে ৬০ জনের একটি দল ময়দানে স্থান না পেয়ে মুš্নু গেটসংলগ্ন ফুটপাতে অবস্থান নিয়েছেন।
পরে তাদের আরও চারটি বাসে করে ২০০ জন মুসল্লি ময়দানে প্রবেশের চেষ্টা করে না পেরে ফের রাজশাহীর উদ্দেশে চলে গেছেন। বিশ্ব ইজতেমা আয়োজক কমিটির শীর্ষ মুরুব্বি প্রকৌশলী মাহফুজ হান্নান আগামীতে ময়দানের পরিধি বর্ধিত করার জন্য সরকারের কাছে আহ্বান জানান।
মোবাইল নেটওয়ার্কে সমস্যা : প্রতি বছরের মতো এবার ময়দানে চার পাশে অস্থায়ী মোবাইল টাওয়ার না বসানোয় মোবাইল নেটওয়ার্কে সমস্যা দেখা দিয়েছে। ময়দানে লাখ লাখ মুসল্লি মোবাইল নেটওয়ার্কের ভোগান্তিতে পড়েছেন।
গণপরিবহণ সংকট : ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে বৃহস্পতিবার সকাল থেকে গণপরিবহণ সংকট দেখা দিয়েছে। এতে ভোগান্তিতে পড়েন ইজতেমার মুসল্লিসহ যাত্রী সাধারণ। ঢাকার মহাখালী থেকে টঙ্গীর দক্ষিণ আউচপাড়ায় আসা ইকোক্যাম কারখানার স্টোর অফিসার নয়ন মিয়া জানান, মহাসড়কে গণপরিবহণের চরম সংকট দেখা দিয়েছে। পাবলিক গাড়ি নেই বললেই চলে। যা দু-একটা চলে তাও গেট বন্ধ করে রাখে। মহাখালী থেকে টঙ্গী আসতে আমার প্রায় ৫ ঘণ্টা সময় লেগেছে।
চার দিন বিরতি দিয়ে ২০ জানুয়ারি দিল্লির নিজামুদ্দিন মারকাযের অনুসারী (ওয়াসিফুল ইসলামপন্থি) মুসল্লিরা বিশ্ব ইজতেমার দ্বিতীয়পর্বে অংশ নেবেন। ২২ জানুয়ারি আখেরি মোনাজাতের মাধ্যমে এবারের বিশ্ব ইজতেমার সমাপ্তি ঘটবে। ২০২০ সালে ৫৫তম বিশ্ব ইজতেমা অনুষ্ঠিত হওয়ার পর করোনা-১৯ মহামারির কারণে গত দুই বছর ২০২১ ও ২০২২ সালে ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয়নি।