করোনা মহামারির ধকল কাটিয়ে না উঠতেই ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সরবরাহ ব্যবস্থা বিঘ্নিত হওয়ায় অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক দুই ক্ষেত্রেই অনেক চ্যালেঞ্জ উপেক্ষা করে একটি বাস্তবসম্মত বাজেট প্রস্তাবের জন্য অর্থমন্ত্রী প্রশংসার দাবিদার বলে উল্লেখ করেছেন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান। বৃহস্পতিবার (৯ জুন) গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে প্রস্তাবিত বাজেট প্রতিক্রিয়ায় তিনি এ কথা বলেন।
প্রকৃতপক্ষে মাঠের বাস্তবতা বিবেচনায় বাজেট প্রত্যাশার চেয়ে বেশি বাস্তবসম্মত বলে মন্তব্য করে তিনি বলেন, অস্থিতিশীল বিশ্বে কৃষির জন্য ক্রমবর্ধমান বরাদ্দ এবং সে অনুযায়ী খাদ্য নিরাপত্তার দিকে মনোযোগ দেওয়া সত্যিই একটি অত্যন্ত বিচক্ষণ পদক্ষেপ। প্রকৃতপক্ষে, আমাদের শক্তিশালী কৃষি শুধু কোভিড-১৯ মহামারির কঠিন দিনগুলোতে অর্থনীতির চূড়ান্ত সুরক্ষাকবচই নয় বরং এটি এখনও কর্মসংস্থানের উৎস এবং দেশীয় চাহিদার শক্তিশালী যোগানদাতা। বর্ধিত উৎপাদনের পাশাপাশি এটি খাদ্য আমদানিকে প্রতিস্থাপন করছে। এভাবে এটি আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের স্থিতিশীলতা রক্ষায় সহায়তা করছে। কৃষি এতোটা প্রাণবন্ত না হলে বাণিজ্য ভারসাম্যহীনতা আরও খারাপের দিকে যেতে পারতো।
তিনি আরও বলেন, বাজেট ডিজিটাল উদ্যোক্তাদের স্টার্টআপগুলোতে কর কমিয়ে অতিরিক্ত প্রণোদনা দিচ্ছে। এটি দেশকে ডিজিটাল পণ্য ও পরিষেবা থেকে পাঁচ বিলিয়ন ডলারের রফতানি আয় অর্জনের পথে অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যাবে। ডিজিটাল কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুদ্রার সম্ভাব্যতা সমীক্ষার সিদ্ধান্ত একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ। মোবাইল ব্যাংকিং এবং ইন্টারনেট ব্যাংকিংকে ক্যাশলেস সমাজে উন্নীত করতে আমরা অনেক এগিয়ে গেছি। এই যাত্রাকে আরও সামনের দিকে নিয়ে যাবে এ বাজেট।
‘ব্রডব্যান্ড পরিষেবা এবং মোবাইল সেটের খুচরা বিক্রির ওপর পাঁচ শতাংশ ভ্যাট বাড়লে ডিজিটাল পরিষেবার দাম বাড়বে যা আরও ডিজিটাল বিভাজনের দিকে নিয়ে যাবে। কোভিড পরবর্তী পুনরুদ্ধার আসলে ডিজিটাল রূপান্তরের জন্য আরও সহায়তার প্রত্যাশা করেছিল। পিরামিডের নিচের অংশসহ বাংলাদেশের প্রায় সব মানুষই মোবাইল ফোন ব্যবহার করে। ফলে মুদ্রাস্ফীতির এই কঠিন বছরে এটি তাদের দুঃখ বাড়িয়ে তুলবে। আমি জোরালোভাবে এই ভ্যাট প্রস্তাব পুনর্বিবেচনার সুপারিশ করবো।
তরুণ প্রজন্ম এ থেকে ভুল সংকেত পাবে। শিক্ষা খাতও ক্ষতিগ্রস্ত হবে’ প্রতিক্রিয়ায় উল্লেখ করেন ড. আতিউর।
তিনি বলেন, দেশীয় শিপিং শিল্পে শূন্য করসহ রফতানি শিল্পের জন্য অব্যাহত সমর্থন আরএমজি এবং অন্যান্য রফতানির জন্য ফ্রেইট চার্জ কমাতে সাহায্য করবে। শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধীদের জন্য বাড়তি সমর্থন এবং চরম দরিদ্রদের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা জালের সম্প্রসারণ সঠিক পদক্ষেপ। যাই হোক, বয়স্কদের জন্য মাসিক ৫০০ টাকা সহায়তা বেশ কম। ক্রমাগত খাদ্য মূল্যস্ফীতির প্রেক্ষিতে এটি কিছুটা বাড়ানো যেতো।
সর্বজনীন পেনশন প্রকল্প চালু করার সিদ্ধান্ত একটি স্মার্ট পদক্ষেপ উল্লেখ করে তিনি বলেন, বাজেট প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী একটি নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ বিকাশের আইনি কাঠামো সবার জন্য এই বহুল প্রতীক্ষিত পেনশন স্কিম চালু করবে। অনেক ব্যবস্থা রয়েছে। আমাদের অবশ্যই সেগুলো থেকে শিক্ষা নিতে হবে এবং আমাদের নিজস্ব দেশীয় স্কিম শুরু করতে হবে। আমাদেরও বেসরকারি খাতে স্বাস্থ্য সম্পর্কিত পেনশন স্কিমের কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা আছে এবং এই অভিজ্ঞতাগুলোকে মূলধারায় নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা উচিত।
‘তামাকজাত দ্রব্যের ওপর বর্ধিত করারোপ এবং শিক্ষা খাতে বর্ধিত বরাদ্দও ইতিবাচক পদক্ষেপ। বিলাসবহুল পণ্যের ওপর কর আরও বৃদ্ধি আমদানি ব্যয় এবং বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে সাহায্য করবে। এটি মধ্যবিত্ত এবং উন্নত ভোক্তা গোষ্ঠীর ব্যবহৃত হোম অ্যাপ্লায়েন্স এবং টেকসই সামগ্রীর মতো পণ্যগুলোর জন্য আমদানি প্রতিস্থাপন শিল্পকে পরোক্ষ সুবিধা দেবে।’
পরিবহন খাতের জন্য বর্ধিত বরাদ্দ যানজট নিরসন করতে পারে এবং পণ্য ও পরিষেবার দ্রুত চলাচলের জন্য সংযোগ বৃদ্ধি করতে পারে। সামগ্রিকভাবে প্রস্তাবিত বাজেটকে বিচক্ষণ হিসেবে দেখা হবে— বলে মন্তব্য করেন তিনি।
‘যারা মূলধন উড়ানোর সঙ্গে জড়িত ছিল তাদের প্রতি আনুকূল্য যদিও আরও বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের জন্য সরকারের একটি মরিয়া পদক্ষেপ, তবে নৈতিক দিক থেকে পর্যবেক্ষকদের কাছ থেকে এ নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। সেই সঙ্গে এটি সাধারণ করদাতাদেরও হতাশ করতে পারে।’ বলেন ড. আতিউর।
‘রাজস্ব আদায় এবং এডিপিতে শতকরা হিসাবে কিছু বৈপরীত্য সত্ত্বেও এ বাজেট স্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং সামাজিক সুরক্ষার মতো খাতে ব্যয় হ্রাস করেনি। তার বদলে এটি দক্ষতা উন্নয়নের জন্য আরও ভালো সহায়তাসহ মানুষের ওপর বিনিয়োগ বৃদ্ধি করেছে।’
কোভিড পরবর্তী এবং বৈশ্বিক ভূরাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও, বিশেষ করে ক্রমবর্ধমান এবং ক্রমাগত মুদ্রাস্ফীতি সত্ত্বেও পুনরুদ্ধারের অভিযান চালাতে রাষ্ট্র কতটা সক্ষম হবে তা বাজেটের বাস্তবায়নের উপর নির্ধারণ করবে বলে মনে করেন ড. আতিউর।