অত্যন্ত চেনা শব্দ নিউমোনিয়া ।আপাতদৃষ্টিতে নিরীহ শুনতে লাগলেও অনেক সময় নিউমোনিয়া ভয়ানক হয়ে ওঠে ।বিশেষ করে বর্ষীয়ান মানুষদের নিউমোনিয়া হলে তাঁদের প্রাণ সংশয়ের ঝুঁকি খুবই বেশি ।সাম্প্রতিক কালে বিশ্বব্যাপী কোভিড ১৯ আক্রান্ত হয়ে মারাত্মক নিউমোনিয়ার কারণে অজস্র মানুষের মৃত্যু আতন্ক ধরিয়ে দেয় ।তাই কোনও অবস্থাতেই নিউমোনিয়া নামক ফুসফুসের এই অসুখটিকে হালকাভাবে নেওয়া উচিত নয় ।সদ্যোজাত এবং বয়স্ক মানুষদের ক্ষেত্রে নিউমোনিয়া অত্যন্ত মারাত্মক হয়ে দাঁড়াতে পারে ।নিউমোনিয়া কথাটির আক্ষরিক অর্থ হলো ফুসফুসের ইনফেকশন ও ইনফ্লামেশন ।অর্থাৎ ফুসফুসে সংক্রমণ হয় ও ফুলে ওঠে ।সোজা ভাবে বললে আমাদের ফুসফুস অনেকটা স্পন্জের মতো ।কোষগুলি ভর্তি থাকে বাতাস দিয়ে ।তাই স্বাভাবিক অবস্থায় ফুসফুসকে গ্যাসভর্তি বেলুনের সঙ্গে তুলনা করা যায় ।নিউমোনিয়া হলে ফুসফুস ক্রমশ কঠিন হয়ে যায় ।চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় একে বলে কনসোলিডেশন ।এক্স রে করলে সাদা দেখতে লাগে।এক্স রের ছবিতে ফুসফুস কালো দেখানো মানে ফুসফুস বাতাস ভর্তি এবং সুস্থ ।আর সাদা মানেই সমস্যা শুরু হয়েছে ।নিউমোনিয়ার প্রাথমিক রেডিওলজিক্যাল ফাইন্ডিংস হলো এই এক্স রে ।
নিউমোনিয়া হলে তিনটি প্রধান সমস্যা দেখা যায় ।জ্বর ,কাশি ও শ্বাসকষ্ট এর সঙ্গে বুকে ব্যাথাও থাকতে পারে ।জোরে শ্বাস টানলে বুকে ব্যাথা করে ।নিউমোনিয়ার শুরুতে শুকনো কাশি হয় ।পরের দিকে কাশির সঙ্গে সর্দি বেরোয় ।সর্দিতে রক্ত থাকতে পারে ।নিউমোনিয়ার সংক্রমণ ফুসফুস থেকে যখন শরীরের বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে পড়ে ,তখন রোগটি ক্রমশ ভয়ংকর হয়ে ওঠে ।ছোট বাচ্চা এবং বয়স্কদের ক্ষেত্রে (এক্সট্রিম এজ গ্রুপ ),বিশেষ করে বেশি বয়সী যাদের ডায়াবেটিস ও হ্রদরোগের সমস্যা আছে তাঁদের জন্য নিউমোনিয়া প্রাণঘাতী হয়ে ওঠার ঝুঁকি খুবই বেশি ।যেমন এখন সার্স কোভ ২ ভাইরাসের সংক্রমণে নিউমোনিয়ার ঝুঁকি বেড়েছে ।তাছাড়া যে কোনও ইনফ্লুয়েন্জা ভাইরাস এবং রেসপিরেটরি ভাইরাস বা আরএসভি ও রাইনো ভাইরাসের সংক্রমণের কারণে নিউমোনিয়া হতে পারে ।এছাড়া ব্যাকটেরিয়া ও ফাংগাস এর কারণেও নিউমোনিয়া হতে পারে ।এছাড়াও বিভিন্ন ধরনের নিউমোনিয়ার মধ্যে আছে কমিউনিটি অ্যাকোয়ার্ড নিউমোনিয়া ,হসপিটাল অ্যাকোয়ার্ড নিউমোনিয়া ,ভেন্টিলেটর অ্যাকোয়ার্ড নিউমোনিয়া এবং এসপিরেশন নিউমোনিয়া ।অর্থাৎ খাবার গ্রহণের সময় সরাসরি ফুসফুসে খাবার গিয়ে বা পানি সহ অন্যান্য পানীয় ফুসফুসে ঢুকে নিউমোনিয়া হওয়ার ঝুঁকি থাকে ।
ভাইরাল ও ব্যাক্টেরিয়াল নিউমোনিয়া হলে হাঁচি কাশির মাধ্যমে জীবানু ছড়িয়ে পড়ে ।ঠিক যেমন ২০২০ মহামারি সৃষ্টিকারী ভাইরাস সার্স কোভ ২ পৃথিবী জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে ।যে কোনও জীবানু হাঁচি কাশি ও কথা বলার মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়তে পারে ।মাস্ককে আমাদের জীবনের অঙ্গ করে নিতে পারলে এই সমস্যা অনেকাংশেই প্রতিরোধ করা যেতে পারে ।
কোভিড ১৯ সংক্রমণের ফলে যে নিউমোনিয়া হয় তা ক্লাসিক্যাল নিউমোনিয়া থেকে পুরোপুরি আলাদা ।ফুসফুসের উপরিভাগ পুরোপুরি বা আংশিক আক্রান্ত হয় ।একে বলে পেরিফেরাল নিউমোনিয়া ।যদি ফুসফুসের সিটি স্ক্যান এ দেখা যায় শুধুমাত্র পেরিফেরাল অংশে হালকা সাদাটে প্যাঁচ আছে তাহলে নভেল করোনা ভাইরাসের কথা ভাবতে হবে ।অল্পচেনা করোনা ভাইরাসের কারণে নিউমোনিয়া হলে ফুসফুসের অবস্থা গ্রাউন্ড গ্লাস ওপাসিটির মতো অর্থাৎ গুঁড়ো কাঁচের মতো অস্বচ্ছ হয় ।যদিও ক্লাসিক নিউমোনিয়া থেকে এই ধরনের নিউমোনিয়ায় ফুসফুস কম ক্ষতিগ্রস্ত হয় ।
করোনা ভাইরাস সংক্রমণের ফলে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ফুসফুস ।ফলে দেখা দিচ্ছে শ্বাসকষ্টের সমস্যা ।এই মারণব্যাধির বিরুদ্ধে লড়াই করতে ফুসফুস সুস্থ রাখতে বিশেষ নজর দিতে হবে ।বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ফুসফুসের কার্যক্ষমতা ধীরে ধীরে কমতে থাকে ।
তাই অল্প বয়স থেকে ফুসফুসের প্রতি বিশেষ যত্ন নেয়া জরুরি ।কেবল ফুসফুসই নয় ,করোনা ভাইরাস হ্রৎপিন্ড কিডনি, স্নায়ুতন্ত্রসহ একাধিক অঙ্গের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলতে পারে।ফুসফুস সুস্থ রাখার জন্য সুষম খাদ্যের পাশাপাশি বেশ কয়েকটি বিষয়ের উপর নজর দেয়া উচিত যেমন: ১. ধুমপান ত্যাগ ২.শ্বাস প্রশ্বাসের ব্যয়াম ৩.শরীর চর্চা ৪. সুষম খাবার ৫.পর্যাপ্ত বিশ্রাম
এই অবস্থায় সুস্থ থাকতে চাইলে মাস্ককে সঙ্গী করার পাশাপাশি ওজন ঠিক রাখতে নিয়মিত ব্যায়াম করুন এবং ভালো থাকুন ।
লিখেছেন:
ডা: মজিব রাহমান, পরিচালক কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল।