কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে পাঁচ প্রার্থী এবং সাধারণ ওয়ার্ডে কাউন্সিলর পদে ১০৬ জন ও সংরক্ষিত নারী ওয়ার্ডের কাউন্সিলর পদে ৩৬ জনসহ তিনটি পদে মোট ১৪৭ জন প্রার্থীর মধ্যে নির্বাচনি প্রতীক বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। শুক্রবার (২৭ মে) সকাল ৯টায় জেলা শিল্পকলা একাডেমিতে প্রার্থীদের প্রতীক বরাদ্দ দেওয়া শুরু করেন সিটি নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তা মো. শাহেদুন্নবী চৌধুরী।
প্রতীক বরাদ্দ উপলক্ষ্যে সকাল থেকেই পুরো শিল্পকলা একাডেমি এলাকার নিরাপত্তায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পর্যাপ্তসংখ্যক সদস্য উপস্থিত ছিলেন। এদিন প্রার্থীরা তাদের অনুসারী নেতাকর্মী-সমর্থকদের নিয়ে জাঁকজমকপূর্ণ পরিবেশে নির্বাচনি প্রতীক গ্রহণ করেন।
আর এই প্রতীক পাওয়ার মধ্য দিয়ে ভোটের মাঠে প্রার্থীদের প্রতিদ্বন্দ্বিতার দিনক্ষণ গণনা শুরু হয়ে গেছে। প্রতীক হাতে পেয়েই নির্বাচনি প্রচারণায় মাঠে নেমেছেন প্রার্থীরা। দুপুর ২টার পর থেকে প্রার্থীদের পক্ষে নগর এলাকায় মাইকে প্রচার-প্রচারণা শুরু হয়।
মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীদের পক্ষে নগরীর রাস্তায় রাস্তায় বাহারি স্লোগানে চলে মাইকিং। প্রার্থীদের প্রচারণায় উৎসবমুখর হয়ে উঠছে নগরী। প্রার্থীদের অনেকে পোস্টার লাগানোসহ লিফলেট বিতরণ শুরু করে দিয়েছেন। এছাড়া প্রযুক্তির ব্যবহারে ফেসবুকসহ নানাভাবে চলছে ডিজিটাল প্রচারণাও। আগামী ১৫ জুন অনুষ্ঠেয় কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের এটা তৃতীয় নির্বাচন।
তবে এবারের নির্বাচনে রাজপথের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার ঘোষণায় অটল রয়েছে। এ অবস্থায় দলের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে প্রার্থী হওয়ায় দুই জনকে (মনিরুল হক সাক্কু-নিজাম উদ্দিন কায়সার) দল থেকে বহিষ্কারের ফলে তাদের অনুসারী দলীয় নেতাকর্মীরা সাংগঠনিক শাস্তি এড়াতে কৌশলে প্রচারণায় থাকছেন। প্রতীক বরাদ্দের দিন ঐ দুই প্রার্থীর সঙ্গে বিএনপি দলীয় কোনো নেতাকে দেখা যায়নি। তবে আওয়ামী লীগের প্রার্থীকে প্রতীক বরাদ্দের সময় রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয়ে দেখা যায়নি, তার পক্ষে প্রতীক গ্রহণ করেন এ প্রার্থীর নির্বাচন পরিচালনা কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক ও কুমিল্লা মহানগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আতিক উল্লাহ খোকন ও আবিদুর রহমান জাহাঙ্গীরসহ নেতৃবৃন্দ। তবে সশরীরে প্রতীক বরাদ্দ নিতে আসা অধিকাংশ প্রার্থী তাদের প্রতীক গ্রহণের পর শিল্পকলা একাডেমি প্রাঙ্গণে উপস্থিত লোকজনকে জড়িয়ে ধরে কোলাকোলি ও কুশল বিনিময় করেন।
এদিকে কুমিল্লা শিল্পকলা একাডেমিতে যখন প্রার্থীদের প্রতীক বরাদ্দ চলছিল, তখন একাডেমি প্রাঙ্গণে বসেছে প্রার্থীদের পছন্দের প্রতীক সংবলিত স্টিকার, প্ল্যাকার্ড, গলা ঝুলানোর ফিতাসহ আইডি কার্ড বিক্রেতাদের ‘হাট’ বসে। সেখান থেকে প্রার্থীদের কর্মী ও সমর্থকরা এগুলো কিনে নিয়ে যান। এক বিক্রেতা সারোয়ার বলেন, বিক্রি অনেক ভালো হয়েছে, প্রার্থীদের কর্মীরা আগ্রহ ভরে কিনে নিয়েছেন।
মেয়র পদে পাঁচ প্রার্থীর প্রতীক: মেয়র পদে পাঁচ প্রার্থীর মধ্যে প্রতীক বরাদ্দ দেন রিটার্নিং কর্মকর্তা। তাদের মধ্যে ৩ জন-ই হলেন স্বতন্ত্র প্রার্থী। এখানে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী আরফানুল হক রিফাত পেয়েছেন দলীয় প্রতীক ‘নৌকা’। তিনি কুমিল্লা মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। অপর প্রার্থী বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত সদ্য সাবেক মেয়র স্বতন্ত্র প্রার্থী মো. মনিরুল হক সাক্কু ‘টেবিল ঘড়ি’, স্বেচ্ছাসেবক দল থেকে বহিষ্কৃত স্বতন্ত্র প্রার্থী নিজাম উদ্দিন কায়সার ‘ঘোড়া’, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের রাশেদুল ইসলাম ‘হাতপাখা’ এবং স্বতন্ত্র প্রার্থী কামরুল আহসান বাবুল ‘হরিণ’।
প্রতীক বরাদ্দের দিনে প্রার্থীদের পোস্টার-প্রচারণা: শুক্রবার প্রতীক বরাদ্দের পর থেকে প্রার্থীদের নির্বাচনি প্রচারণার আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়। এদিন জুমার নামাজ শেষ করেই অনেক প্রার্থী প্রচারণায় মাঠে নামেন। বিকাল থেকে নগরীর বিভিন্ন এলাকায় মেয়র পদে নৌকা, হাতঘড়ি ও হরিণ প্রতীকের প্রার্থীর জন্য ভোট চেয়ে গানের সুরে সুরে মাইকিং-প্রচারণা শুরু হয়। প্রতীক বরাদ্দের পর প্রার্থীদের কর্মীরা তাদের নিজ নিজ ওয়ার্ডের পাড়া-মহল্লায় প্রতীক সংবলিত পোস্টার লাগানোর কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। নগরীর শুভপুর, আশ্রাফপুর, জাঙ্গালিয়া, দক্ষিণ চর্থাসহ বিভিন্ন এলাকায় মই ব্যবহার করে পোস্টার লাগাতে দেখা গেছে এবং নগরীর বিভিন্ন মসজিদে জুমার নামাজ শেষে প্রার্থীর পক্ষে ভোট ও দোয়া চেয়ে এলাকার উন্নয়নে নানা প্রতিশ্রুতির লিফলেট বিতরণ করেন কর্মীরা। এরই মধ্যে প্রার্থীদের পক্ষে তাদের কর্মী-সমর্থকরা ফেসবুক পেইজ খোলে ডিজিটাল প্রচারণাও শুরু করে দিয়েছেন, যা এবারের প্রচার-প্রচারণায় ভিন্নমাত্রা যোগ হয়েছে।
প্রার্থীদের গণসংযোগ:
শুক্রবার নৌকা প্রতীক বরাদ্দপত্র হাতে নিয়ে প্রার্থীর নির্বাচন পরিচালনা কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক ও মহানগর আওয়ামী লীগ নেতা আবিদুর রহমান জাহাঙ্গীর বলেন, নৌকার প্রার্থী আরফানুল হক রিফাত একটি সামাজিক অনুষ্ঠানে ব্যস্ত আছেন, তাই তিনি প্রতীক বরাদ্দ নিতে আসতে পারেননি। এ সময় তিনি বলেন, নৌকা স্বাধীনতার প্রতীক, নৌকা বঙ্গবন্ধুর প্রতীক, নৌকা উন্নয়নের প্রতীক। তাই নৌকার বিজয়ের প্রশ্নে কোন সংশয় ও মতবিরোধ নেই। তিনি আরো বলেন, আজ (শুক্রবার) বাদ মাগরিব নির্বাচনি প্রধান কার্যালয় উদ্বোধন ও মিলাদ শেষে দলীয় নেতাকর্মীরা বসে কর্মপরিকল্পনা ঠিক করবেন এবং শনিবার (আজ) সকাল থেকে আনুষ্ঠানিক প্রচারণা শুরু করা হবে।
স্বতন্ত্র প্রার্থী ও সদ্য সাবেক মেয়র মো. মনিরুল হক সাক্কু (টেবিল ঘড়ি) শুক্রবার আনুষ্ঠানিক প্রচারণায় নামেননি। তবে তিনি প্রতীক পাওয়ার পর নগরীর নানুয়া দীঘির পাড়স্থ নিজ বাড়িতে ফিরে এলাকাভিত্তিক তার অনুসারী নেতাকর্মীদের নিয়ে পর্যায়ক্রমে বৈঠক শুরু করেন। তিনি বলেন, কুমিল্লা সিটি করপোরেশন প্রতিষ্ঠার নগরবাসী আমাকে টানা দুই মেয়াদে বিপুল ভোটের ব্যবধানে মেয়র নির্বাচিত করেছে। গত ১০ বছর মেয়রের চেয়ার ছিলাম। নগরবাসীর পাশে থেকেছি, তাদের সেবা করেছি। আশা করি এবারও নগরবাসী আমার পক্ষে তাদের মূল্যবান রায় দেবেন। তিনি আজ শনিবার সকাল থেকে প্রচারণা শুরু করবেন বলে জানান।
স্বতন্ত্র প্রার্থী নিজাম উদ্দিন কায়সার শুক্রবার বিকাল ৪টা থেকে গণসংযোগে মাঠে নামেন। তিনি নগরীর দক্ষিণ এলাকার নোয়াগাঁও, জাঙ্গালিয়া, পদুয়ার বাজার, কচুয়া চৌমুহনী, উত্তর রামপুরসহ আশপাশের এলাকায় স্নানীয় বাসিন্দাদের নিকট দোয়া চেয়ে কোলাকোলি করেন এবং ভোট চান। এ সময় তার সঙ্গে দলের বেশ কয়েক জন নেতাকর্মীকে দেখা গেছে। তিনি বলেন, পৃথিবীর সকল দুঃশাসনের অবসানে যুদ্ধের ময়দানেও ‘ঘোড়া’র ব্যবহার ছিল। এবার কুমিল্লা নগরবাসী অন্যায় ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘ঘোড়া’ প্রতীকে ভোট দিয়ে তাকে নির্বাচিত করে দুঃশাসনের অবসান ঘটাবে। তিনি কুমিল্লা নগরীকে ক্লিন অ্যান্ড গ্রিন সিটিতে রূপান্তর করার অঙ্গীকারও ব্যক্ত করেন এবং সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ ভোট হলে তিনি জয়ের ব্যাপারে আশাবাদী বলে জানান। অপর স্বতন্ত্র প্রার্থী কামরুল আহসান বাবুল এবং ইসলামী আন্দোলনের রাশেদুল ইসলামকে শুক্রবার প্রচারণায় মাঠে দেখা যায়নি।
সিইসির সঙ্গে প্রার্থীদের মতবিনিময় আগামীকাল:
কুমিল্লা সিটি নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তা মো. শাহেদুন্নবী চৌধুরী জানান, রবিবার (২৯ মে) প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কুমিল্লা সিটি নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী প্রার্থীদের সঙ্গে কুমিল্লা আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তার কার্যালয়ের হলরুমে মতবিনিময় সভায় মিলিত হবেন।