নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতার সবচেয়ে জঘন্যতম নির্যাতন ধরা হয় ধর্ষণকে। দেশের সামাজিক প্রেক্ষাপটে ধর্ষণের শিকার হওয়ার পরের পরিস্থিতি আরও বেশি যন্ত্রণাদায়ক। সমাজের নানা দৃষ্টিভঙ্গির মধ্য দিয়ে জীবন অতিবাহিত করতে হয় তাদের। শুনতে হয় নানা কটু কথাও। আর শিশু বা অবিবাহিত নারীরা যখন ধর্ষণের মতো অমানসিক নির্যাতনের শিকার হন তাদের সামাজিক অবস্থা আরও বেদনাদায়ক হয়ে ওঠে। ধর্ষণ প্রতিরোধে মৃত্যুদণ্ডের মতো আইন, সচেতনতার জন্য নানা পদক্ষেপসহ আলোচনা-পর্যালোচনা হলেও তা কমেনি। দেশজুড়ে প্রতি মাসেই নারী ও শিশুর প্রতি ঘটছে ধর্ষণের মতো সহিংস অপরাধ।
২০১৯ ও ২০২০ সালে বেশ কয়েকটি ধর্ষণ ও নারীর প্রতি যৌন সহিংসতার ঘটনায় আলোচনায় আসে ধর্ষণ প্রতিরোধে করণীয় নিয়ে। প্রশ্ন ওঠে বিদ্যমান আইনের সংশোধন নিয়েও। আইন সংশোধনের জন্য সারাদেশে শুরু হয় আন্দোলন-প্রতিবাদ। দাবি ওঠে ২০০০ সালের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ৯ (১) উপ-ধারায় বর্ণিত—‘যদি কোনো পুরুষ কোনো নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করেন, তাহলে তিনি যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হবেন এবং এর অতিরিক্ত অর্থদণ্ডেও দণ্ডনীয় হবেন।’ এই আইন সংশোধনের। ফলে সারাদেশে নারী নির্যাতনবিরোধী আন্দোলনের মুখে ধর্ষণকারীদের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান রেখে আইনটি সংশোধনের পদক্ষেপ নেয় সরকার। নতুন আইনের ৯ (১) উপ-ধারায় ‘যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড’ এর স্থলে ‘মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড’ এই পরিবর্তন আনা হয়।
আইনের পরিবর্তন হলেও কমেনি ধর্ষণের সংখ্যা। দেশজুড়ে আগের অবস্থাই বিরাজ করছে। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ কেন্দ্রীয় লিগ্যাল এইড উপ-পরিষদের প্রকাশিত তথ্য মতে, ২০১৯ সালে দেশে এক হাজার ৩৭০ জন, ২০২০ সালে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন এক হাজার ৩৪৬ জন নারী ও কন্যাশিশু। ২০২১ সালে সারাদেশে এক হাজার ২৩৫ জন ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে কন্যাশিশু ৬২৯ জন। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৩১ জনকে, যেখানে কন্যাশিশুই ২২ জন। ধর্ষণের কারণে আত্মহত্যা করেছেন আরও সাতজন। ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে ৯৩ জন কন্যাশিশুসহ ১৫৫ জনকে।
মহিলা পরিষদের লিগ্যাল এইডের তথ্য বলছে, বিদায়ী বছরে এক হাজার ২৩৫ জন নারী ও কন্যাশিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছেন/প্রতীকী ছবি
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য বলছে, সারাদেশে ধর্ষণ ও দলবেঁধে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ২০১৮ সালে ৭৩২ জন, ২০১৯ সালে ১ হাজার ৪১৩ ও ২০২০ সালে ১ হাজার ৬২৭ জন নারী। ২০২১ সালে হয়েছেন মোট এক হাজার ৩২১ জন। এর মধ্যে ধর্ষণ-পরবর্তী হত্যার শিকার হয়েছেন ৪৭ এবং ধর্ষণের পর আত্মহত্যা করেছেন ৯ জন।
সংস্থা দুটির তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত কয়েক বছরে প্রতি বছরই ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৬০০ ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। ২০২১ সালেও ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ১২ শতাধিক নারী ও শিশু। নতুন আইনে শাস্তির বিধান মৃত্যুদণ্ড করা হলেও কমছে না ধর্ষণের সংখ্যা। নিরাপত্তাহীনতার পাশাপাশি পরিবারের মধ্যেও যৌন সহিংসতার আশঙ্কা বাড়ছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য নারীরা মনে করেন, সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টি ও পরিবারে নিরাপত্তা বিধানে পারিবারিক মূল্যবোধের বিকাশে কাজ করা জরুরি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী তনিমা হোসেন তমা জাগো নিউজকে বলেন, পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীরা কোথাও নিরাপদ নয়। পরিবার থেকে শুরু করে সমাজের সর্বত্র নারীদের একটা ভয়-শঙ্কা নিয়েই চলতে হয়। শিশুদের ক্ষেত্রে অধিকাংশই দেখা যায়, পরিবারের নিকটাত্মীয় বা প্রতিবেশীদের দ্বারাই ধর্ষণের শিকার হয়। সেই জায়গা থেকে বেরিয়ে আসতে হলে প্রথমে দরকার পুরুষদের দৃষ্টিভঙ্গি ও মানসিকতার পরিবর্তন। একই সঙ্গে পারিবারিক মূল্যবোধের বিকাশ না হলে এ অবস্থা থেকে উত্তরণ ঘটা পুরোপুরি সম্ভব নয়।