বৃহস্পতিবার (২৩ ডিসেম্বর) দিবাগত রাতে ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীতে এমভি অভিযান-১০ নামের লঞ্চে অগ্নিকাণ্ড ঝরিয়েছে অন্তত ৪২ প্রাণ। দগ্ধ বা আহত হয়েছেন শতাধিক মানুষ। অনেকে এখনো স্বজনদের খুঁজে ফিরছেন।
সেই বিভীষিকা থেকে স্বামী-কন্যাসহ প্রাণে বেঁচে ফিরেছেন ক্রীড়া সাংবাদিক মেহেরিনা কামাল মুন। ভয়াবহ ওই ঘটনার অভিজ্ঞতা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে তুলে ধরেছেন মুন।
ফেসবুক স্ট্যাটাসে তিনি লিখেছেন—
“অনেকেই জানতে চান। একে একে বলা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। আর বারবার বলা মানেই বারবার ওই মুহূর্তের মধ্যে ঢুকে যাওয়া। এক কথায় যদি বলি, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করা বা মৃত্যু আসতে দেখা।
২৩ তারিখ (দিবাগত) রাত তখন আনুমানিক ২.১৫-২.২০টা। আমার ঘুম ভেঙে গেছে এমনিতেই। ওয়াশরুমে গেলাম। এর মধ্যে মেয়েও উঠে বলে, ফিডার দুদু খাবে। মেয়েকে খাইয়ে মাত্রই শুয়েছি। এরই মধ্যে চিল্লাচিল্লি শুনে রুম থেকে বের হলাম দেখার জন্য। কেবিনের সামনের রেলিং দিয়ে উঁকি দিয়েই দেখি আগুন। এক সেকেন্ডও কোনো কিছু চিন্তা না করে রুমে ঢুকে জাস্ট মোবাইল আর বাচ্চাটা কোলে নিলাম।
দৌড়ে গেলাম তিনতলার একেবারে সামনের দিকে। মাথায় ছিল খোলা জায়গায় থাকতে হবে। কিন্তু নামবো কীভাবে কোনো পথ পাচ্ছিলাম না। এইটুকু বাচ্চা নিয়ে এই তিনতলা থেকে পানিতে নামা মানে বাঁচার সম্ভাবনা কমে যাওয়া।
লঞ্চ ঝালকাঠির ঘাটের কিছুটা কাছাকাছি আসার পরে ৪০-৫০ জন পানিতে ঝাঁপ দিয়ে নেমে গেছে। আমরা ওপর থেকে সেটাও সাহস করতে পারিনি। আমিই বেশি আতঙ্কিত ছিলাম৷ কীভাবে নামবো এই বাচ্চা নিয়ে। ওর বাবা বললো, পানিতে নামা লাগলেও নিচতলা থেকে নামবো। এই বলে সে পরে থাকা জিন্স প্যান্ট খুলে ফেলে। এসব চলার মধ্যে লঞ্চের ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে লঞ্চ মাঝনদীতে চলে আসছে।
তখন পানিতে নামা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। কিন্তু যতটা কাছ থেকে নামা যায়। এর মধ্যে আমাদের সামনে এক নারী নিজের পরনের শাড়ি খুলে রেলিংয়ে বেঁধে নেমে গেলেন নিচের দিকে। সেই শাড়ি ঝুলেছিল। রাজিব ভাবলো ওই শাড়ি দিয়েই নামবে মেয়ে নিয়ে। আমার জাস্ট ৫-৭ সেকেন্ডে মাথায় কাজ করলো যদি বেঁচে যাই তাহলে মোবাইলটা জরুরি।
আমি আমার মোবাইলটা ওড়নার এক মাথায় বেঁধে সেই ওড়না দিয়েই মেয়েকে ওর বাবার কোমরে বেঁধে দিলাম। কারণ চিন্তা এলো হাতে নিয়ে নামলে যে কোনো সময় হাত ছুটে যেতে পারে। এসব করতে করতে তখন আগুন তিনতলায়। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছি ভয়াবহ কালো ধোঁয়ার মধ্যে আগুনের হল্কা। মেয়ে শ্বাস নিতে পারছিল না।
মেয়ের বাবা নেমে গেলো। আমিও তার পেছনে পেছনে নামলাম, কিন্তু দোতলা পর্যন্ত নেমে সেই শাড়ি শেষ। অন্ধকার, ধোঁয়ায় রেলিং আর খুঁজে পাচ্ছিলাম না। এক লোক এক টানে আমাকে নিচের ফ্লোরে নামিয়ে আনলো। এর মধ্যে লঞ্চের অন্য পাশ থেকে লোকজন চিল্লাচ্ছে, ভাই আপনারা এদিকে আসেন, এপাশে আসেন, এদিকে মাটি আছে। পরে সেই ধোঁয়া, অন্ধকারের মধ্যেই ওপাশে গিয়ে কোনো কিছু না ভেবেই লাফ দিলাম। মনে হলো আল্লাহ যেনো নিজে ঠেলে লঞ্চটা সাইডে নিলেন। কাঁদার মধ্যে পা আটকে পা মচকালো।
উঠে দাঁড়ানোর শক্তি নেই। মেয়ের বাবা জাস্ট হাত ধরে মাত্রই দাঁড় করিয়েছে। এর মধ্যেই পেছন দিকে এক সিলেন্ডার ব্লাস্ট হয়ে গেলো। জাস্ট ভাবছি, এক-দেড় মিনিট দেরি হলে কী হতো জানি না, আল্লাহ জানেন।
আল্লাহ নিজ হাতে বাঁচিয়েছেন, আর সাথে মা-বাবা, বড়দের দোয়া ছিল। হয়তো জীবনে একটা হলেও ভালো কিছু করেছিলাম তার প্রতিদান আল্লাহ দিয়েছেন।জানি