বাংলাদেশে হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা বাড়ছে। তবে মেয়েদের তুলনায় ছেলেরা এ রোগে বেশি আক্রান্ত হয়- এ ধারণা ভুল, একেবারেই ভিত্তিহীন। এটি বয়স কিংবা লিঙ্গভেদে হচ্ছে না। যে কোনো বয়সের মানুষ, এমনকি ছেলে-মেয়ে উভয়ই সমান হারে এ রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। আট বছর বয়সী শিশুও হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার নজির আছে।
রোববার (১২ ডিসেম্বর) একটি অনলাইন নিউজ চ্যানেলে স্বাস্থ্যকথা’ অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিভিশন অব ক্লিনিক্যাল কার্ডিওলজি, হার্ট ফেইলিওর রিহ্যাবিলিটেশন অ্যান্ড প্রিভেন্টিভ কার্ডিওলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. হারিসুল হক এসব তথ্য তুলে ধরেন। অনুষ্ঠানের মূল বিষয়বস্তু ছিল হার্টের যত্ন।
হার্ট অ্যাটাক কেন হয়, এ বিষয়ে ডা. হারিসুল হক বলেন, যাদের শরীরে বিশেষ জিন থাকে তাদের এ সমস্যা হতে পারে। আবার আমাদের শরীরে অনেক ধরনের হরমোন এবং অ্যানজাইমের ক্রিয়াকাণ্ড ঘটে। এর মধ্যে একটি হচ্ছে অ্যাড্রিনালিন হরমোন। আপনারা দেখবেন পরীক্ষা দিতে কিংবা বড় কিছু করতে গেলে অনেকে ভয় পান, এটা মূলত এই হরমোনের কারণে ঘটে। যাদের শরীরে এই হরমোন বেশি তাদের রক্তনালীগুলো সংকুচিত হওয়ার প্রবণতা থাকে। এ কারণে হার্ট অ্যাটাক হতে পারে। কোনো ব্লক না থাকার পরও হার্ট অ্যাটাক হয় এবং এর ফলে মৃত্যুও ঘটতে পারে। এজন্য ভয়ভীতি থেকে দূরে থাকতে হবে, অর্থাৎ দুশ্চিন্তামুক্ত জীবনযাপন করতে হবে। যতই দুশ্চিন্তামুক্ত থাকবেন ততই আপনার অ্যাড্রিনালিন হরমোন কমবে এবং হার্ট অ্যাটাক, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, ব্রেইন অ্যাটাকের ঝুঁকি কমবে।
ট্রাইগ্লিসারাইড জিন দেহের ক্ষেত্রে খুব গুরুত্বপূর্ণ। ট্রাইগ্লিসারাইড বা টিজি মূলত একধরনের ফ্যাট। স্থূলতা, ডায়াবেটিস, বেশি শর্করা খাওয়া এবং কম কায়িক শ্রমের কারণে ট্রাইগ্লিসারাইড বেড়ে যেতে পারে। বিপরীতে কমে যায় গুড কোলেস্টেরল বা হাই ডেনসিটি গ্লাইকোপ্রোটিন (এইচডিএল)। ট্রাইগ্লিসারাইড জিন যাদের কাজ করে তাদের শুধু হৃদরোগ না ডায়াবেটিসও হয়। যারা বেশি ভাত, রুটি ও বিস্কিট খায় তাদের শরীরে এটি বেশি অ্যাকটিভ থাকে। ভারতীয় উপমহাদেশে মানুষের শরীরে এ জিনটা সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। কারণ এ অঞ্চলের মানুষ সকাল-দুপুর-রাত তিনবেলাই ভাত খায়। এতে কার্বোহাইড্রেটযুক্ত খাবার শরীরে যাচ্ছে। পারিবারিক সূত্রেও এই জিনটা ছড়াতে পারে। খাদ্যাভ্যাস মানলেও পরিবারের অন্য সদস্যের কারণে এটি নিজের মধ্যে আসতে পারে।
হার্ট অ্যাটাক থেকে বাঁচতে আমাদের অনেক বেশি সচেতনভাবে চলতে হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, বাংলাদেশের মানুষের প্রতি আমার পরামর্শ, আপনি ডায়াবেটিস আক্রান্ত না হলেও এমনভাবে চলবেন যেন আপনার ডায়াবেটিস আছে। কারণ এতে আপনার ট্রাইগ্লিসারাইড কমবে। এজন্য আমাদের ভাত, চিনি, গুড় কম খেতে হবে। মিষ্টি খাওয়াই যাবে না এবং বেশি বেশি শাক-সবজি খেতে হবে। এলডিএল কোলেস্টেরল বেশি থাকে প্রাণিজ চর্বিতে। যেসব প্রাণীর শরীরে যত বেশি পা তাদের শরীরে ততবেশি এলডিএল কোলেস্টেরল থাকে। যেমন- গরু, খাসি, মহিষ এদের চার পা এবং মাছের মধ্যে যেমন চিংড়ি মাছের অনেক পা।
তিনি বলেন, সপ্তাহে একজন মানুষ সর্বোচ্চ এক টেবিল চামচ তেল খেতে পারেন। তেল নিয়েও অনেক আলোচনা আছে। এর মধ্যে সয়াবিন, অলিভ ও ভেজিটেবল তেল স্বল্প পরিমাণে খেতে পারেন। বিস্কিট, আলু এসবে শর্করা রয়েছে। এসব খাবারও কম খেতে হবে। আরেকটি বড় কাজ হচ্ছে নিয়মিত হাঁটা। হাঁটার গতি থাকতে হবে প্রতি ঘণ্টায় পাঁচ থেকে ছয় কিলোমিটার। সেটা কমপক্ষে দৈনিক ৪৫ মিনিট হতে হবে। কোনো বিষয়ে ভয় পাওয়ার প্রবণতা কমাতে হবে। সচেতন থাকতে হবে, ভীত নয়। আমি মনে করি, হৃদরোগ অবশ্যই নিরাময়যোগ্য। এজন্য নিরাপদ খাদ্যাভ্যাস গুরুত্বপূর্ণ।
ডা. হারিসুল হক আরও বলেন, যখন কোনো ব্যক্তি অন্যরকম কোনো ব্যথা বা হার্ট অ্যাটাক অনুভব করে তাকে দ্রুত এস্পিরিন-৩০০ এম জি ওষুধটি খাওয়াতে হবে। তাহলে মৃত্যুর ঝুঁকি তাৎক্ষণিকভাবে কিছুটা কমবে। সেটা যদি হার্ট অ্যাটাক নাও হয়, সাময়িক গ্যাস্ট্রিকও হয়, তারপরও বড় ঝুঁকি থেকে বাঁচবে।
তিনি বলেন, আজকাল অনেকেই বলেন আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার জন্য চিকিৎসকরা অনেক সময় হার্টে রিং পরানোর পরামর্শ দেন। আসলে এটি কোনো দেশ বা প্রতিষ্ঠানের কথা বলে লাভ নেই, এটা একটি বৈশ্বিক সমস্যা। এসময়ে এসে দেখা যায় সবাই হুট করে ধনী হতে চায়। যেমন ধরেন আমার আয়া, পিয়ন, ড্রাইভার সবাই দ্রুত ধনী হতে চায়। ফলে মানুষের নৈতিক স্খলন হচ্ছে। চিকিৎসকদের অবশ্যই নৈতিকতাসম্পন্ন হতে হবে। যেমন- কোনো একজন সাধারণ রোগীকে আমরা যদি বলি আজই রিং পরাতে হবে না হলে মারা যাবে, তবে তিনি নিজের বাড়িঘর বিক্রি করে হলেও টাকার ব্যবস্থা করবে। এক্ষেত্রে চিকিৎসকদের নৈতিকতা আগে প্রয়োজন। তথ্যসুত্র: জানি