এই শহরে তোমাকে আমি বহুবার খুঁজেছি। কিন্তু পাইনি। আমার কোন দোষ ছিল না, তবুও আমাকে ক্ষমা করে দিও।’ শেষ এ কথাটি বলে চোখ মুছতে মুছতে মঞ্চ থেকে নেমে শ্রোতার আসনে এসে বসেন লায়লা আরজুমান বানু। সেখানেও ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকেন তিনি। লায়লা বীর মুক্তিযোদ্ধা সার্জেট তোফাজ্জল হোসেনের স্ত্রী।
১৯৭৭ সালের ২ অক্টোবর অভ্যুত্থানের অভিযোগে সশস্ত্র বাহিনীর যেসব সদস্যকে হত্যা করে লাশ গুম করা হয়েছে, লায়লার স্বামী তোফাজ্জল হোসেন তাদের একজন। স্বামীর সঙ্গে মাত্র দেড় বছর সংসার করতে পেরেছিলেন লায়লা। স্বামী নিখোঁজ হওয়ার পর বহুবার বহু জায়গায় খুঁজেও সন্ধান পাননি। তাই অশ্রসিক্ত নয়নে স্বামীর উদ্দেশে লায়লার এমন হৃদয়বিদারক উক্তি উপস্থিত জনতার মনকে নাড়া দেয়। কিন্তু তাকে সান্ত¡না দেয়ার ভাষা যেন কারও জানা নেই। কেননা, মঞ্চে আর শ্রোতার আসনে বসা সবার গল্প একই। কেউ এসেছেন স্বামী ছাড়া ৪৪ টি বছর অতিবাহিত করে জীবনযুদ্ধে টিকে থাকার গল্প শোনাতে, কেউ এসেছেন বাবা হারা শোকের আর্তি জানাতে, কেউ এসেছেন অন্যায়ভাবে সন্তানকে হত্যার বিচার চাইতে।
শনিবার সকাল সাড়ে ১০টা থেকে বেলা ২টা পর্যন্ত জাতীয় প্রেসক্লাব অডিটরিয়ামে এক আলোচনা সভায় এমন করুণ চিত্র দেখা যায়। সভাটির আয়োজন করে ‘শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধা সন্তান কেন্দ্রীয় কমান্ড’। ১০ বছরের সাজাপ্রাপ্ত সার্জেন্ট এনামুল হকের সভাপতিত্বে সভায় লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন ২০ বছর কারাদণ্ডপ্রাপ্ত বিমান বাহিনীর কর্পোরাল গাজী গোলাম মাওলা হিরুর মেয়ে নাহিয়ান তাসনিম জয়ী।
সভায় উপস্থিত ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর একেকজন মঞ্চে উঠছেন, আর চোখের পানি মুছতে মুছতে মঞ্চ ছাড়ছেন। তারা বলছেন, কথিত অভ্যুত্থানের অভিযোগে সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান সশস্ত্র বাহিনীর শত শত সদস্যকে হত্যা করে লাশ গুম, কারাদণ্ড ও চাকরিচ্যুত করেছেন। জিয়ার প্রহসনমূলক বিচারের নামে সরাসরি হত্যার শিকার পরিবারগুলো মানবেতর জীবন যাপন করছে। তাই ’৭৭ সালের ঘটনা তদন্তে কমিশন গঠনের পাশাপাশি জিয়ার মরণোত্তর বিচার দাবি করছেন ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো।
সভায় সাবেক বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক বলেন, আমাদের দেশে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর থেকে বেশ কয়েকটি কলঙ্কজনিত হত্যাকাণ্ড ঘটেছে; তার মধ্যে ১৯৭৭ সালের ২ অক্টোবরের ঘটনা অন্যতম। এসব কলঙ্কময় দিনের মূল কুশীলব ছিল খুনী জিয়াউর রহমান। শুধু বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেই সে ক্ষান্ত হয়নি, এর পরও অসংখ্য দেশপ্রেমিককে হত্যা করা হয়েছে। গত চার শ’ বছরের ইতিহাস যদি ঘাটি তাহলে যে মানুষটিকে পৃথিবীর নিকৃষ্টতম খুনী বলে আমরা বিচার করব- সে আর কেউ নয়, সে খুনী জিয়াউর রহমান। তার হাত ছিল রক্তে কলঙ্কিত, তার হাতে রক্তের দাগ ছিল। সে সময়ে ফাঁসি দেয়ার পরে রায় দেয়া হয়েছিল। ফাঁসি দেয়া হলে তার লাশ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়। কিন্তু জিয়া সেটিও হতে দেয়নি। এতেই বোঝা যায়, সে কতটা নিষ্ঠুর ও নির্মম ছিল। লাশ কোথায় কবর দেয়া হয়েছে তাও কেউ জানে না। সেদিন কি ঘটেছিল তা কিন্তু এখনও দেশের মানুষ জানে না। প্রহসনের বিচারের নামে জিয়া সেদিন ২২শ’ মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা করেছিল। জিয়া প্রহসনের বিচারের নামে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর প্রভুদের নির্দেশে অনেক মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা করেছে। আমার মত, দেশের কোটি কোটি মানুষ বিশ্বাস করে জিয়াউর রহমান মুক্তিযোদ্ধা ছিল না। জিয়ার কর্মকাণ্ড খুশি হয়ে পাকিস্তান থেকে তাকে চিঠি পাঠিয়ে তার কাজে খুশি প্রকাশ করা হয়েছিল। সে যে মুক্তিযোদ্ধা নয়, সেটি অত্যন্ত নিবিড়ভাবে প্রমাণিত।
শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক বলেন, ১৯৭৭ সালের ২ অক্টোবরের ঘটনা জাতি জানতে চায়। তারা জানতে চায় সেদিন কী হয়েছিল, কেন, কীভাবে ফাঁসি দেয়া হয়েছিল, তাদের কবর দেয়া হয়েছিল কিনা, কোথায় তাদের কবর; সেসব চিহ্নিত করা এবং তাদের একটি তালিকা করতে একটি স্বাধীন শক্তিশালী তদন্ত কমিশন গঠন করা প্রয়োজন। আমরা অবশ্যই খুনী জিয়ার মরণোত্তর ফাঁসি চাই এবং তার মুখোশ জাতির সামনে তুলে ধরার দাবি জানাই। শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধা সন্তান কেন্দ্রীয় কমান্ডের দাবির সঙ্গে সংহতিও প্রকাশ করেন তিনি।
প্রখ্যাত সাংবাদিক আবেদ খান বলেন, জিয়াউর রহমান সকালবেলা হত্যাকাণ্ডের খবর নিয়ে কাজ শুরু করতেন। তার একমাত্র বিশ্বাসের জায়গা ছিল পাকিস্তান ও আইএসআই। তার ছাত্র ছিলেন রশিদ-ফারুক। ১৯৬৪-৬৫ সালে তাদের তিনি শিক্ষা দিয়েছেন। প্রহসনের বিচারের নামে জিয়ার সরাসরি হত্যাকাণ্ড দেখেছি, শুনেছি। বাংলাদেশকে সত্যিকারের মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় নিয়োজিত করতে চাইলে জিয়াউর রহমান কিংবা এরশাদের কোন চিহ্ন রাজনৈতিক অঙ্গনে রাখা যাবে না। জিয়াউর রহমানসহ যারা বাংলাদেশের রাষ্ট্রব্যবস্থাকে ধ্বংস করার চেষ্টা করেছে, তাদের প্রত্যেকের মরণোত্তর বিচার হওয়া উচিত। দ্রত বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠন করে হত্যাকাণ্ডের বিচার করা উচিত। যাদের ফাঁসি দিয়ে, কারাদণ্ড দিয়ে ও চাকরিচ্যুত করা হয়েছে তারা কী অপরাধ করেছিল তা চিহ্নিত করতে হবে। তারা মৃত হোক কিংবা বেঁচে থাকুক সেটা না দেখে।
ফায়ারিং স্কোয়াডে নিহত সার্জেন্ট দেলোয়ার হোসেনের স্ত্রী নুরুন নাহার বলেন, আমার একমাত্র ছেলে কখনও বাবা বলে ডাকতে পারেনি। বড় হয়ে ছেলে তার বাবার কথা জিজ্ঞেস করত। আমি কোন উত্তর দিতে পারিনি। এটা যে কত কষ্টের, কত যন্ত্রণার তা বলে বোঝানো যাবে না। স্বামীর শোকে ৪৪টি বছর ধুঁকে ধুঁকে মরছি। ক্ষতটা ৪৪ বছরের হতে পারে, কিন্তু এখনও তাজা। এতদিনেও কোন পেনশন পাইনি, সুযোগ-সুবিধা পাইনি। একমাত্র ছেলে ৯ম শ্রেণী থেকে টিউশনি করত। বাসায় জামা-কাপড় সেলাই করে বাড়ি বাড়ি বিক্রি করে সংসার চালাচ্ছি। এখন আর পারছি না। কিডনি সমস্যা, প্রেসারের রোগী। মাথা গোঁজার স্থান নেই। প্রধানমন্ত্রীর নিকট আবেদন জানাচ্ছি। শেষ বয়সে মরার আগে যদি শুনে যেতে পারতাম, আমার স্বামী নির্দোষ ছিল, তাহলে মরেও আত্মা শান্তি পেত।
মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত সার্জেন্ট মকবুল হোসেনের স্ত্রী রোকেয়া বেগম বলেন, আমার এতিম সন্তান তার বাবার মৃত্যুবার্ষিকী জানে না। আমরা তো মৃত্যুর কাছাকাছি এসে গেছি। সরকার যদি এখন স্বীকৃতি দেয়, শহীদ স্বামীর স্ত্রী। এটাই বড় পাওয়া। আর আমাদের সন্তানদের জন্য কিছু করা হোক।
বিমান বাহিনীর চাকরিচ্যুত কর্পোরাল সৈয়দ কামরুজ্জামান বলেন, জিয়াউর রহমান প্রহসনের বিচারের নামে প্রতিদিন সন্ধ্যা ৭টা থেকে গভীর রাত পর্যন্ত ১৪-১৫ জনকে সরাসরি হত্যা করত। পরে লাশ কি করত তা জিয়াই জানত। তিনি বলেন, আমাকে বিমানবন্দর এলাকা থেকে ধরে নিয়ে আটকে রাখা হয়। অথচ আমার মায়ের কাছে চিঠি পাঠিয়ে বলা হয়েছে, আপনার ছেলেকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তাকে এসে চাকরিতে যোগ দিতে বলবেন। এমন নাটক জিয়ার নির্দেশেই হয়েছে।
দুই বছর সাজাপ্রাপ্ত কর্পোরাল হাফিজুর রহমান বলেন, তাকে চোখ বেঁধে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে জেল দেয়া হয়েছে। কিন্তু কেন, তাও বলেনি। আজও জানতে পারিনি বলে জানতে চাই। আমাদের কি দোষ ছিল, তদন্ত কমিশন গঠন করে তা জানানো হোক।