করোনা সামাল দেয়া বাংলাদেশের জন্য কঠিন হয়ে পড়েছে। সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ছে। দীর্ঘ দিনের পরিশ্রমে চিকিৎসক, নার্সরা হয়ে পড়ছেন ক্লান্ত। ফলে পরিস্থিতি সামাল দিতে কিছু জরুরি ব্যবস্থা নিচ্ছে সরকার।
২৪ ঘণ্টায় করোনায় মৃত্যুতে আবারো নতুন রেকর্ড হয়েছে৷ আগের দিনও নতুন রেকর্ড ছিল৷ সংক্রমণের হার ২৮.৪৪ শতাংশ, মৃত্যুর হার ১.৬৬ শতাংশ৷
পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকার গত দুই দিনে বেশ কিছু সিদ্ধান্ত নিয়েছে৷ ডাক্তার ও নার্সের সঙ্কট মেটাতে কোনো নিয়োগ পরীক্ষা ছাড়াই চার হাজার ডাক্তার ও চার হাজার নার্স নিয়োগের সিদ্ধান্ত নিয়েছে৷ তাদের দ্রুত নিয়োগ দেয়ার জন্য পুলিশ ভ্যারিকেশনও বাদ দেয়া হয়েছে৷
মন্ত্রিসভার বৈঠকে সোমবার এই সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় বলা হয়েছে, চিকিৎসক ও নার্সরা দেড় বছর ধরে এই করোনায় চিকিৎসা সেবা দিয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন৷ তাই যত দ্রুত সম্ভব নতুন ডাক্তার ও নার্স নিয়োগ দেয়া প্রয়োজন৷
বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ) জানিয়েছে, করোনায় এ পর্যন্ত আট হাজার ৮৯০ জন চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মী আক্রান্ত হয়েছেন৷ তাদের মধ্যে চিকিৎসক তিন হাজার ৫৮ জন, নার্স দুই হাজার ১৭৫ জন এবং স্বাস্থ্যকর্মী তিন হাজার ৬৭৫ জন৷ আর করোনা এবং করোনার উপসর্গ নিয়ে ১৬৯ জন চিকিৎসক মারা গেছেন৷ ফলে করোনা চিকিৎসায় এখন চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীর সঙ্কট দেখা দিয়েছে৷
এর বাইরে মঙ্গলবার সরকারের এক উচ্চ পর্যায়ের সভায় আগামী ৭ আগস্ট থেকে ইউনিয়ন পর্যায়ে করোনার টিকা দেয়া শুরুর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে৷ আর টিকা দেয়ার জন্য জাতীয় পরিচয় পত্র নিয়ে গেলেই চলবে, অ্যাপে নিবন্ধন লাগবে না৷ আর ফ্রন্টলাইনারদের পরিবারের সদস্যদের ১৮ বছর বয়স হলেও টিকা দেয়া হবে৷
চলমান লকডাউনে শিল্প কারখানা খোলা রাখার দাবি নাকচও করা হয় বৈঠকে৷
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা: লেনিন চৌধুরী বলেন, ‘সরকারের সিদ্ধান্ত ভালো, কিন্তু অনেক দেরিতে হয়েছে৷ তিন মাস আগে চিকিৎসক ও নার্স নিয়োগ করা দরকার ছিল৷ আর এখন সিদ্ধান্ত হলেও রাতারাতি তো নিয়োগ দেয়া যাবে না৷ আমরা আসলে এখনো করোনাকে পেছন থেকে প্রতিরোধের চেষ্টা করছি৷ সামনে থেকে পারছি না৷ তাই মনে হচ্ছে, আমরা যেন সব কিছু নিয়তির হাতে ছেড়ে দিয়েছি৷ কারণ, আমাদের যে চিকিৎসক ও নার্স আছেন তারা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত৷ চিকিৎসা সেবাও পর্যাপ্ত নয়৷ ফলে করোনা ঠোকানো আরো কঠিন হয়ে পড়বে৷
তাছাড়া আমরা আগেই বলেছিলাম গ্রামের মানুষ অ্যাপ ব্যবহার করতে পারে না৷ তখন আমাদের কথায় কান দেয়া হয়নি,’ বলেন তিনি৷
গত ২৪ ঘণ্টায় বাংলাদেশে করোনায় মারা গেছেন ২৫৮ জন৷ শনাক্ত হয়েছেন ১৪ হাজার ৯২৫ জন৷ শুধু ঢাকা বিভাগেই মারা গেছেন ৮৪ জন৷ দ্বিতীয় অবস্থানে আছে খুলনা ৫০ জন৷ কয়েক দিন ধরেই ঢাকায় মুত্যু বাড়ছে৷ এর প্রধান কারণ হলো, ঢাকার হাসপাতালগুলোতে ভর্তি হওয়া রোগীদের ৭০ ভাগই গ্রাম থেকে আসা৷ গ্রামে সংক্রমণ ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ায় যারা অবস্থাসম্পন্ন তারা ঢাকায় আসছেন চিকিৎসার জন্য৷ পাশাপাশি গ্রামে করোনা উপসর্গ নিয়ে মুত্যুও বাড়ছে৷ অনেকেই সর্দি-কাশি নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন৷ টেস্ট কারাচ্ছেন না৷ চিকিৎসকের কাছেও যাচ্ছেন না৷
ঢাকার ১৬টি সরকারি কোভিড হাসপাতালের ১১টিতেই কোনো আইসিইউ বেড খালি নেই৷ দেশের ৬৪ জেলার মধ্যে ৪৫ জেলার হাসপাতালে কোনো আইসিইউ সুবিধা নেই৷
আইইডিসিআরের উপদেষ্টা ডা: মুশতাক হোসেন বলেন, ‘করোনা গ্রামে ছড়িয়ে পড়েছে৷ এখন ঈদের পর আবার শহরে নতুন ঢেউ হয়ে ফিরে আসছে৷ শহরের জন্য বিপদ অপেক্ষা করছে৷’
এক সপ্তাহের বিরতি দিয়ে আবার সারাদেশে লকডাউন চলছে৷ কিন্তু তারপরও গত সাত দিনে সংক্রমণ গড়ে ৬ ভাগ হারে বেড়েছে৷
ডা: লেনিন চৌধুরী বলেন, ‘ঈদের আগে দুই সপ্তাহ লকডাউন দিয়ে ঈদের জন্য এক সপ্তাহ বিরতি দেয়া হলো৷ কিন্তু করোনা তো আর ঈদ বোঝে না৷ সে তার গতিতেই এগিয়ে যাচ্ছে৷’
সরকার এবার স্থানীয় পর্যায়ে করোনা প্রতিরোধে কমিউনিটিকে সম্পৃক্ত করার উদ্যোগ নিয়েছে৷ ডা: মুশতাক হোসের বলেন, ‘এটা আগেই দরকার ছিল৷ আর নতুন চিকিৎসক ও নার্স নিয়োগের সাথে মেডিকেল কলেজের ছাত্রদেরও কাজে লাগানো দরকার৷ করোনার শুধু চিকিৎসা নয় এর ম্যানেজমেন্টও অনেক জরুরি৷ সেখানে ছাত্রদের কাজে লাগানো যায়৷ নয়তো পরিস্থিতি সামাল দেয়া কঠিন হবে৷
তিনি আরো বলেন, ‘লকডাউন গ্রামে, এমনকি শহরেও ঠিকমতো কার্যকর করা যাচ্ছে না৷ ফলে লকডাউনেও সংক্রমণ কমছে না৷ টিকার শুরুতেই আমরা ধাক্কা খেয়েছি৷ করোনার ঝুঁকি সম্পর্কে আমাদের সঠিক ধারণা না থাকায় আমরা ঠিকমতো পরিকল্পনা করিনি৷ আমরা মনে করেছিলাম করোনা চলে গেছে৷ ফলে পাত্তা দেইনি৷ ব্যবস্থাপনা ঠিক করিনি৷ প্রস্তুতি রাখিনি৷ যার ফল এখন আমরা পাচ্ছি৷