দেশে করোনার নতুন ভ্যারিয়েন্ট ডেল্টা ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে এই অদৃশ্য ভাইরাস। গতকালও দেশে একদিনে করোনার শনাক্ত ও মৃত্যুতে সৃষ্টি হয়েছে নতুন রেকর্ড। অথচ সাড়ে ১৭ কোটি মানুষের দেশে এখনো নমুনা পরীক্ষা হয়েছে মাত্র সাড়ে ৫৭ লাখ। প্রতিদিন নমুনা পরীক্ষা হচ্ছে ৩০ হাজারের ঘরে।
এ অবস্থায় লকডাউন চলছে। লকডাউন কঠোরভাবে কার্যকর করাই এখন সময়ের দাবি। লকডাউন অকার্যকর হলে দেশ পড়ে যাবে দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক সঙ্কটে। বিশ্বের অনেক দেশ করোনার কারণে অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল হয়ে গেছে। অনেক দেশ অর্থনীতির গতিধারা পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়েছে। বাংলাদেশের চলমান উন্নয়ন অব্যাহত রাখতে হলে শহর থেকে শুরু করে গ্রাম-গঞ্জের মানুষের করোনার নমুনা পরীক্ষা, প্রয়োজনীয় চিকিৎসাসেবা, টিকা প্রদান, সামাজিক বিচ্ছিন্নতা রক্ষা, স্বাস্থ্যবিধি মানা নিশ্চিত করতে হবে। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ অনুযায়ী চলমান লকডাউন কার্যকর করতে হবে।
বৈশ্বিক মহামারি করোনার মধ্যেই বিশ্বের বহু দেশে বাংলাদেশের পণ্য সরবরাহের ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। সময়োপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণ ও করোনার নিয়ন্ত্রণ করা গেলে সুফল পাওয়া যাবে। তবে করোনার সবকিছু বন্ধ থাকায় দেশে বিনিয়োগ কমে গেছে। প্রবাসী শ্রমিকরা বিদেশে যেতে পারছেন না। মিল-কারখানা বন্ধ থাকায় উৎপাদন কমে গেছে। দীর্ঘদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিক্ষায় নেমে এসেছে বিপর্যয়। গণটিকা কার্যক্রম চালিয়ে, চিকিৎসাসেবা দিয়ে, স্বাস্থ্যবিধি মেনে, লকডাউন কার্যকর করে ‘করোনারভাইরাস নিয়ন্ত্রণ’ করা গেলে অর্থনৈতিকভাবে অল্পদিনের মধ্যে দেশ ঘুরে দাঁড়াবে। কিন্তু লকডাউন কার্যকর না হলে আগের মতোই করোনার সংক্রমণ আরো ছড়িয়ে পড়বে এবং কর্মক্ষেত্র বন্ধ থাকবে। তখন সম্ভাবনাময় দেশ অর্থনৈতিকভাবে দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারে। মৃত্যু হাতছানি দিয়ে ডাকবে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, টিকা নিশ্চিত করুন এবং লকডাউন কার্যকর করুন। কম সময়ের মধ্যে করোনার নিয়ন্ত্রণে লকডাউন বাড়াতে হবে।
আশার কথা এবার সেনাবাহিনী মাঠে নামায় লকডাউন কার্যকর হচ্ছে। মানুষের চলাফেরা কিছুটা নিয়ন্ত্রণ হয়েছে। এর আগে করোনার সামাজিক সংক্রমণ ঠেকাতে গত ১৬ মাসে কয়েক দফায় জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে লকডাউন দেয়া হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দায়িত্ব পালন করেছেন। কিন্তু বেশির ভাগ সময় দেখা গেছে মানুষ রাস্তায় নেমেছে; লকডাউন ঢিলেঢালাভাবে পালিত হয়েছে। এবার সেনাবাহিনী মাঠে নামায় লকডাউন সফল হওয়ায় এটা পরিষ্কার দেশপ্রেমী সেবাবাহিনীর প্রতি আমজনতার আস্থা ও বিশ্বাস রয়েছে। এ জন্য সেনাবাহিনীকে অভিনন্দন জানাই। কিন্তু করোনাকে ‘গুডবাই’ জানাতে শহর থেকে গ্রামের মানুষের চিকিৎসা দিতে হবে, নমুনা পরীক্ষা করতে হবে।
এখনো দেখা যাচ্ছে করোনা রোগীর চিকিৎসা, টিকা দেয়া এবং নমুনা পরীক্ষায় গ্রাম-গঞ্জের মানুষের প্রতি অবহেলা করা হচ্ছে। অথচ স্বাস্থ্য অধিদফতর বলছে শতকরা ৫০ জন রোগী গ্রাম থেকে চিকিৎসার জন্য আসছেন। গতকাল করোনার মারা গেছেন ১৬৪ জন। এর মধ্যে রাজধানী ঢাকায় মাত্র ২৫ জন আর সারাদেশে মারা গেছে ১৩৯ জন। গতকাল শনাক্তের হার ছিল ২৯ দশমিক ৩০ শতাংশ। সারাদেশে ৬০৫টি পরীক্ষাগারে নমুনা পরীক্ষা করা হচ্ছে। অথচ এর বেশির ভাগ পরীক্ষাগার ঢাকায়। সরকারি পরিসংখ্যানে দেখা যায় দেশের ৬৪ জেলার মধ্যে এখনো ৪৭ জেলায় আইসিইউ ইউনিট নেই। হাসপাতালের পর্যাপ্ত চিকিৎসাসেবা নেই। অক্সিজেনের অভাবে খুলনা ও রাজশাহী বিভাগে কয়েকজন রোগী মারা গেছেন। করোনা নিয়ন্ত্রণ করে দেশের অর্থনীতিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রয়োজনেই গ্রামের রোগীদের চিকিৎসাসেবা বাড়ানো উচিত। রাজধানী ঢাকা করোনা মুক্ত হলে গ্রামে করোনা ভাইরাস থেকে গেলে দেশে স্বাভাবিক কর্মপরিবেশ সৃষ্টি হবে না। করোনা ঠেকাতে হলে জেলা ও উপজেলায় করোনা নমুনা পরীক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। অধিকহারে পরীক্ষা বাড়াতে হবে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের হিসাবে দেখা যায় রাজধানীতে করোনার সংক্রমণ হারের চেয়ে এখন গ্রামে সংক্রমণ হার বেশি। এটা নিয়ন্ত্রণে গ্রামের দিকে চিকিৎসাসেবা বাড়িয়ে দিতে হবে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অধিকাংশ জেলায়ই এখনো করোনার নমুনা পরীক্ষা করা হচ্ছে না। উপজেলা পর্যায়ে করোনার নমুনা পরীক্ষা চোখেই পড়ে না। প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে উপজেলা ও জেলা শহর পেরিয়ে বিভাগীয় শহরে গিয়ে নমুনা পরীক্ষা গ্রামের মানুষের সবার পক্ষে অসম্ভব। তাই শুধু দেশের অর্থনীতিকে ধরে রাখাই নয়, মানবিকভাবে হলেও গ্রামের মানুষের নমুনা পরীক্ষার জন্য উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ের ক্লিনিক পর্যন্ত নমুনা পরীক্ষার ব্যবস্থা করা উচিত।
গতকাল স্বাস্থ্য অধিদফতর বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, গত ২৪ ঘণ্টায় ৩৫ হাজার ৪২টি নমুনা সংগ্রহ এবং ৩৪ হাজার ২টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত ৬৭ লাখ ৫৭ হাজার ৫৬২টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। বিপুল জনসংখ্যার দেশে এভাবে নমুনা পরীক্ষা হলে সময় লাগবে প্রায় ১০ বছর। করোনা থেকে রক্ষা পেতে যাকে যেখানে প্রয়োজন কাজে লাগাতে হবে। তথ্য প্রযুক্তির যুগে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির কারণে শহর ও গ্রাম খুব কাছাকাছি এসেছে। এক জেলা বা রাজধানী থেকে জেলা-উপজেলা পর্যায়ে চিকিৎসা সরঞ্জাম ও ওষুধ দ্রুত আনা-নেয়া কোনো বিষয় নয়। সরকারের বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেলিকপ্টার রয়েছে, বিভিন্ন ব্যক্তিমালিকানাধীন হেলিকপ্টার রয়েছে; দেশের প্রয়োজনে সেগুলো অনায়াসে করোনার নমুনা পরীক্ষার সরঞ্জাম, চিকিৎসা সামগ্রী এমনকি চিকিৎসকদের আনা-নেয়ার কাজে লাগানো যেতে পারে।
করোনা ভাইরাসকে নিয়ন্ত্রণ করে দেশের অর্থনীতিকে কাজে লাগানোর ব্যাপারে কেবল একজনকেই ব্যতিব্যস্ত দেখা যায়। তিনি হলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা । সংসদে বাজেট অধিবেশনে এমপি যখন গভীর রাতে ক্লাবে গিয়ে হেনস্তা হওয়া নায়িকা পরীমনির ‘মান-ইজ্জত’ রক্ষায় তুমুল বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন; তখন প্রধানমন্ত্রী দেশের মানুষের কথা ভাবেন; করোনাকে বিদায় করে দেশের অর্থনীতিকে কিভাবে চালু রাখা যায় তা নিয়ে চিন্তামগ্ন থাকেন। করোনা মোকাবিলায় কোথায় জনপ্রতিনিধি, কোথায় বিশিষ্টজন, কোথায় পেশাজীবী কোথায় আমলাদের কাজে লাগানো যায়; ঘরে বসে থাকা নিম্ন আয়ের মানুষের কাছে খাদ্য পৌঁছানো যায় তা নিয়ে ভাবেন, সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। কিন্তু জনপ্রতিনিধিরা সব দায় আমলাদের ওপর চাপিয়ে নিজেদের দায়িত্ব এড়িয়ে যান। ডেল্টা ঠেকাতে ‘সীমান্ত বন্ধ’ রাখার যে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল; সীমান্ত জেলার জনপ্রতিনিধি তা বাস্তবায়নে চেষ্টা করেননি।
সার্বিক চিত্র : করোনা পরিস্থিতিতে সবকিছুই বন্ধ। নিম্ন আয়ের গরিব মানুষ, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, স্বল্প আয়ের চাকরিজীবী, কর্মক্ষম বেকার যুবক চরম দুরবস্থায় রয়েছেন। ২০২০ সালের করোনা প্রথম ঢেউয়ে লকডাউনে সরকার নানাভাবে মানুষকে সহায়তা করছে। প্রধানমন্ত্রীর মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে ৫০ লাখ পরিবারকে সহায়তা করেছেন। কিন্তু এবার বৃহৎভাবে কোনো সহায়তা দেখা যাচ্ছে না।
ব্যক্তিপর্যায়ে কিছু দানশীল ব্যক্তি ও সংগঠন লকডাউনে গরিবদের সহায়তা করছেন। এই বিচ্ছিন্নভাবে সহায়তার বদলে পরিকল্পিতভাবে সহায়তায় ভালো ফলাফল পাওয়া যেতে পারে। জেলা, উপজেলা, অঞ্চল এমনকি কেন্দ্রীয় পর্যায়ে কমিটি গঠন করে তাদের মাধ্যমে যারা ত্রাণ পাওয়ার যোগ্য তাদের সহায়তা করা যায়। এতে বিপন্ন সকলের ঘরে খাবার পৌঁছে যাবে। এমনকি ব্যবসায়ীদের সংগঠন বিজিএমইএ, বিকেএমইএ, বিটিএমএ এবং ব্যাংক মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন ব্যাংকস ইত্যাদির মাধ্যমে কেন্দ্রীয়ভাবে ত্রাণ আর্থিক সহায়তা কমিটি গঠন করা যেতে পারে। এই সংগঠনগুলোই কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যায়ে কমিটি গঠন করে তাদের মাধ্যমে সারাদেশের গ্রাম-গঞ্জের বিপন্ন মানুষকে সহায়তা করতে পারেন। এরা অতীতে অনেক সহায়তা করেছেন, এখনো করছেন; তবে তা অপরিকল্পিতভাবে। জাতীয় প্রয়োজনে লকডাউন সফল করতে সকলকে বিপন্ন মানুষের প্রতি সহানুভূতির হাত বাড়িয়ে দিতে হবে।
অঞ্চলভিক্তিক পরিষেবা : দীর্ঘমেয়াদি সঙ্কট ঠেকাতে ‘করোনা ভাইরাসকে’ দেশ থেকে গুডবাই জানাতে হবে। এ জন্য রাজধানী ঢাকা থেকে শুরু করে টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া, রূপসা থেকে পাথুরিয়া পর্যন্ত গামের মানুষকে করোনা থেকে মুক্ত রাখতে হবে। করোনা ভাইরাসের জীবাণু যাতে কোথাও না থাকে সে জন্য গ্রামের সকলকে করোনার নমুনা পরীক্ষার আওতায় আনতে হবে। এ জন্য স্থানীয় ক্লাব, পাঠাগার, ্স্কুল, কলেজ, মাদরাসার শিক্ষক, সমাজসেবক, উঠতি বয়সের শিক্ষিত তরুণদের সমন্বয়ে কমিটি গঠন করে সাধারণ মানুষকে সচেতন করতে হবে। তারা প্রচারণার মাধ্যমে করোনার ভয়াবহতা মানুষের কাছে তুলে ধরবেন এবং মানুষকে সচেতন করার পাশাপাশি সবাই যাতে নমুনা পরীক্ষা করেন, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলেন সে বিষয়গুলো দেখভাল করবেন। এতে সরকারি দলসহ বিভিন্ন দলের স্থানীয় নেতাকর্মীদের সম্পৃক্ত করা যেতে পারে।
নমুনা পরীক্ষা ও চিকিৎসা : লকডাউন সফল করতে হলে শহরের মানুষের পাশাপাশি গ্রামের মানুষকে সচেতন করতে হবে। শুধু শহরের মানুষের সচেতনতা দিয়ে কনোরাভাইরাস নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। গতকালও স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম বলেছেন, দেশের বিভিন্ন স্থানে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন করোনা আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে অর্ধেকের বেশি গ্রামের। অর্থাৎ ৫০ শতাংশের বেশি রোগী গ্রাম থেকে এসে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। ৪৫টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের কর্মকর্তা ও চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলেছি। তারা জানিয়েছেন, রোগীর অধিকাংশের বেশি গ্রামের। অতএব গ্রামের মানুষের নমুনা পরীক্ষা বাড়াতে হবে। একই সঙ্গে তাদের স্বাস্থ্যসেবা ও চিকিৎসা নিশ্চিত করতে হবে। এ জন্য স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের নিয়ে বিভিন্ন কমিটি গঠন করা যেতে পারে। এর সঙ্গে বিভিন্ন মেডিক্যালে পড়ুয়া ছাত্র-ছাত্রীদের সম্পৃক্ত করা যেতে পারে। ডাক্তারদের বিভিন্ন সংগঠনের সদস্যদের এতে সম্পৃক্ত করা যেতে পারে।
তারা নমুনা পরীক্ষা করাবেন, জেলা, উপজেলা এমনকি পৌরসভা, ইউনিয়ন পর্যায়ের হাট-বাজারে ক্লিনিকে নমুনা পরীক্ষার ব্যবস্থা করবেন এবং করোনা চিকিৎসা দেবেন। অক্সিজেন সঙ্কটের কারণে অনেক রোগী মারা গেছে জেলা পর্যায়ে। অথচ সরকার বলছে অক্সিজেনের সঙ্কট নেই। এতে পরিষ্কার সমন্বয়ের অভাব। এই কমিটি চিকিৎসার পাশাপাশি কোথায় অক্সিজেনের প্রয়োজন, কোথায় রোগী চিকিৎসার দরকার, কোন হাসপাতালে সিট ফাঁকা রয়েছে সেগুলো দেখভাল করবেন এবং কার্যকর পদক্ষেপ নেবেন।
পশুর হাট ও অনলাইন কেনাকাটা : মুসলমানদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব ঈদুল আজহা আসছে। এই ঈদে সারাবিশ্বের মুসলমানরা ঈদের নামাজের পর পশু কোরবানি দেন। কোনোভাবেই ধর্মীয় এই উৎসব বন্ধ করা যাবে না। ফলে এই উৎসবের আগে পশুর হাটে গরু-ছাগল ক্রয় বিক্রয়কে কেন্দ্র করে যাতে করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়তে না পারে সে লক্ষ্যে পরিকল্পিত পদক্ষেপ নিতে হবে। ঈদে সারাদেশ থেকে পশু ঢাকার হাটগুলোতে আনা হয়। বিশেষ করে সীমান্ত জেলাগুলো থেকে পশু নিয়ে ব্যবসায়ীরা ঢাকায় আসেন। অথচ সেই সীমান্ত জেলাগুলোতে করোনা ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। ট্রাকে বা যে কোনো পরিবহনে পশু আনা হলে তার সঙ্গে পাইকার ও কর্মীরা আসবেন। তাদের কার শরীরে করোনা রয়েছে কেউ জানে না। আবার পশুর হাটে গাদাগাদি করে চলাফেরা করায় একে অপরের শরীরে সংক্রমণ ছড়িয়ে দেবেন। গত বছরের ঈদুল আজহার পর দেশে করোনা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ার তিক্ত অভিজ্ঞতা আমাদের রয়েছে। ফলে সীমান্ত জেলাগুলোতে নমুনা পরীক্ষা করেই পশুর ব্যাপারীদের ঢাকায় আসার ছাড়পত্র দেয়া উচিত। এদিকে পশুর হাটে ভিড় এড়াতে অনলাইনে কোরবানির পশু কেনাবেচায় মানুষকে উদ্বুদ্ধ করা যেতে পারে।
গত বছর ঈদের আগে বিপুল পরিমাণ পশু অনলাইনে কেনাবেচা হয়েছে। এবারও অনলাইনে কোরবানির পশু ক্রয়-বিক্রয় শুরু হয়েছে। স্থানীয় সরকারমন্ত্রী সম্প্রতি অনলাইনে পশু কেনাবেচা উদ্বোধন করেছেন। অনলাইনে পশু কিনলে ইজারাদারকে টোলও দিতে হয় না। ফলে অনলাইনে পশু কেনাবেচার জন্য ব্যবসায়ী ও ক্রেতাদের উদ্বুদ্ধ করে প্রচারণা চালানো প্রয়োজন। একই সঙ্গে ক্রেতা বা বিক্রেতা অনলাইনে পশু বিক্রি করে বা ক্রয় করে যাতে হয়রানি ও প্রতারণার শিকার না হন সে ব্যাপারে সরকারি পর্যায়ে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত।
কর্মচারী ও কর্মকর্তাদের সহায়তা : দীর্ঘ ১৬ মাস ধরে দেশে করোনা ভাইরাস দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। সারাদেশে সংক্রমণ বেড়ে গেছে। দীর্ঘ এই সময়ে নানাভাবে লকডাউন হয়েছে; চাকরি হারিয়েছে বহু মানুষ। এক কথায় করোনায় দেশের কোটি কোটি মানুষ আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কিন্তু যারা সরকারি চাকরি করেন তাদের আর্থিক সঙকটে পড়তে হয়নি। বরং তাদের বেতন বাড়ানো হয়েছে; নানাভাবে তাদের ভাতা ও সুযোগ-সুবিধা দেয়া হচ্ছে। ১৬ মাস থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ অথচ সরকারি স্কুল-কলেজের শিক্ষকরা নিয়মিত বেতন পাচ্ছেন। জাতির এই ক্রান্তিলগ্নে তাদের উচিত জনগণের পাশে দাঁড়ানো। করোনা ভাইরাসের চিকিৎসাসেবা দেয়ার ক্ষেত্রে ডাক্তারদের ঝুঁকি নেয়া, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দায়িত্ব পালনসহ নানাভাবে তারা মানুষকে সহায়তা করছেন। তারপরও করোনা কে পুঁজি করে অনেকেই কোটি কোটি টাকা লুটপাট করছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। সেটা অন্য প্রসঙ্গ। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের শীর্ষ পর্যায়ের নেতৃত্বদানকারীদের উচিত করোনার এই সঙ্কটময় মুহূর্তে জনগণের চিকিৎসা সহায়তার জন্য আর্থিক সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেয়া। সেটা হতে পারে মাসিক বেতন থেকে এক দিন বা দশ দিনের বেতন সরকারি কোষাগার বা করোনা চিকিৎসাজনিত কাজে দান করা। অথবা যতদিন করোনা রয়েছে ততদিন বেতনের শতকরা একটা সামান্য অংশ সরকারপ্রধানের হাতে তুলে দেয়া।
নানাভাবেই সরকারি কর্মচারীরা করোনা ভাইরাসের এই ভয়াবহ ঝুঁকি মোকাবিলায় সরকারকে সহায়তা করে আর্তমানবতার পাশে দাঁড়াতে পারেন। এছাড়াও সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী থেকে শুরু করে সব পর্যায়ের সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন থেকে কিছু অর্থ কেটে করোনায় মোকাবিলার কাজে লাগানো যেতে পারে। অবশ্য এটা নির্ভর করে সরকারি কর্মকর্তাদের দেশপ্রেম ও মানবপ্রেমের ওপর। অন্যের কাছ থেকে সংগ্রহ করব আর আমি আমার অর্থ দেবো না এ মানসিকতা থেকে সরে আসা উচিত।
জনপ্রতিনিধিদের দায়িত্বশীলতা : করোনার ভয়াবহতা ঠেকাতে জনপ্রতিনিধিদের দায়িত্বশীল ও দেশপ্রেমের পরিচয় দেয়া উচিত। রাজনীতি হচ্ছে জনসেবা, জনপ্রতিনিধিরা জনগণের সেবা করবেন। এটাই নিয়ম। কিন্তু বর্তমান জাতীয় সংসদ থেকে শুরু করে সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভা, জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন পর্যায়ের জনপ্রতিনিধিরা কতটুকু দায়িত্ব পালন করছেন?
সংসদ সদস্যসহ বর্তমানে সারাদেশে জনপ্রতিনিধি রয়েছেন ৬৮,২৯৮ জন। করোনার কালে তাদের কার ভূমিকা কি? নির্বাচনের সময় এমপি ও অন্য জনপ্রতিনিধিরা নমিনেশনের জন্য কে কত টাকা খরচ করেছেন সে খবর মানুষ জানে। নমিনেশনের জন্য দৌড়ঝাঁপ জনগণ দেখেছে। সেই এমপিরা কি নিজ নিজ এলাকার মানুষের খোঁজ নিচ্ছেন? স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা কি বিপন্ন মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন এই করোনা কালে? মানুষ তাদের কাজ দেখতে চায়। মানুষের দুর্বিষহ জীবনযাপনের সময় জনপ্রতিনিধিরা কি ভূমিকা রাখছেন তা দেখতে ও বুঝতে চায়। মানুষ দেখছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একই সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন, মানুষকে সহায়তার উদ্যোগ নিচ্ছেন। তিনি কেন্দ্র থেকে শুরু করে তৃণমূল পর্যায়ে মানুষের প্রয়োজনীয় চিকিৎসাসেবা, আর্থিক সহায়তা, মানুষের স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা, চলমান অর্থনীতি গতিশীল করা, বিদেশের কর্মরত প্রবাসীরা যাতে বিদেশ যেতে পারেন সে জন্য টিকার ব্যবস্থা করা,শিক্ষার্থীদের টিকা দিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়ার চেষ্টা সবকিছু প্রধানমন্ত্রী একাই করছেন। অথচ সংসদে আমরা কি দেখছি?
দেশে করোনায় প্রতিদিন শত মানুষ মারা যাচ্ছে; অথচ সংসদে উত্তাপ ছড়ানো হয় নায়িকা পরীমনিকে নিয়ে। সিনেমার নায়িকা পরীমনি রাত ১২টার পর মদ খেতে ক্লাবে গিয়ে হয়রানির শিকার হয়েছেন এটাই যেন এমপিদের মাথাব্যথার কারণ। অথচ অক্সিজেনের অভাবে রোগী মারা যাচ্ছে, করোনার নমুনা পরীক্ষা পর্যাপ্ত হচ্ছে না, লকডাউনে নিম্ন আয়ের মানুষ না খেয়ে রয়েছেন এগুলো নিয়ে তাদের যেন কোনো মাথাব্যথা নেই। অথচ একজন এমপি বৈধভাবেই প্রতি মাসে বেতন-ভাতাসহ নানান সুবিধায় ৮ লাখ থেকে ৯ লাখ টাকা পেয়ে থাকেন। স্থানীয় অন্য জনপ্রতিনিধিরাও সরকার থেকে নিয়মিত বেতন-ভাতা পাচ্ছেন। করোনা কালে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরতদের অনেকের বেতন কমানো হয়েছে।
অনেকের চাকরি গেছে, অনেকেই বেকার হয়ে পরিবার-পরিজন নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। অথচ জনপ্রতিনিধিরা নিয়মিত বেতন নিচ্ছেন। সরকারের দায়িত্বশীলদের উচিত জনপ্রতিনিধিদের বেতনের একটা অংশ করোনা ভাইরাস ঠেকানো এবং করোনা কালীন সময়ে লকডাউনে বিপন্ন মানুষের সহায়তার কাজে ব্যবহার করা যেতে পারে। জনপ্রতিনিধিরা জনগণের সেবক হলে নিজেদের থেকেই এমন ধরনের উদ্যোগ নিজেরাই নিতেন। পরীমনি কোথায় নির্যাতিত হলো আর আমলারা কি সিদ্ধান্ত নিলো তা নিয়ে সংসদ গরম করা এ মুহূর্তে কোনো কাজের কাজ নয়। মানুষের পাশে দাঁড়ানো উচিত।
চিকিৎসক ও নার্সদের ভূমিকা : করোনার প্রথম ঢেউয়ের সময় দেখা গেছে অধিকাংশ চিকিৎসক করোনার রোগীদের চিকিৎসা করতে আগ্রহ দেখাননি। হাজার হাজার চিকিৎসক দায়িত্ব ভুলে গিয়ে ঘরে বসে ছিলেন। পরবর্তীতে অনেক চিকিৎসক জীবনের ঝুঁকি নিয়ে করোনা রোগীদের চিকিৎসা দেন। হাসপাতালের হাজার হাজার নার্স, আয়া করোনা রোগীদের চিকিৎসা দিচ্ছেন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে। অথচ তাদের বিশেষ প্রণোদনা দেয়া হয়েছে বলে জানা যায় না। সংসদ অধিবেশন এক মাস চললে সংসদ সচিবালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রণোদনা হিসেবে এক মাসের অতিরিক্ত বেতন দেয়া হয়। অথচ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে করোনা রোগীদের মাসের পর মাস চিকিৎসাসেবা দিচ্ছেন যে ডাক্তার ও নার্সরা তাদের প্রণোদনা দেয়া হয়নি? অথচ করোনা রোগীদের চিকিৎসাসেবা দিতে গিয়ে অনেক ডাক্তার মারা গেছেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনার সম্মুখযোদ্ধা ডাক্তার ও নার্সদের প্রণোদনা দেয়া হলে অন্যান্য পেশার লোকজনও করোনামুক্ত দেশ গড়তে উদ্বুদ্ধ হতেন।
দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার বিকল্প নেই : করোনা ভাইরাস মোকাবিলায় দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার বিকল্প নেই। এ জন্য লকডাউন সফল করতে হবে সর্বাত্মকভাবে। লকডাউন যাতে সফল হয় এবং মানুষ যাতে বাইরে বের না হয়ে কর্মসূচিকে সফল করতে পারেন সে লক্ষ্যে সুচিন্তিত পরিকল্পনা করা উচিত। বিগত দিনগুলোর অভিজ্ঞতা আমাদের কাছে তিক্ত। স্বাস্থ্যবিধি না মানা ও হেলাফেলা করায় করোনার দ্বিতীয় ঢেউ এখন দেশে আছড়ে পড়েছে। সীমান্ত বন্ধ ঘোষণা করেও সীমান্ত দিয়ে মানুষকে আসা-যাওয়া করতে দেয়ায় সীমান্ত জেলায় ডেল্টার পাদুর্ভাব ঘটার পর সেটা সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে। বিগত ঈদগুলোতে গণপরিবহন বন্ধ থাকার পরও গার্মেন্টস কর্মী থেকে শুরু করে চাকরিজীবী ও বিভিন্ন পেশাজীবী গাদাগাদি করে গ্রামে ফিরে গেছেন; আবার ঈদের পর ঢাকায় ফিরে এসেছেন। তাদের এই নানা পদ্ধতি গ্রামে যাতায়াতে করোনা সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়েছে। এখন দেশের অর্থনীতি বাঁচাতে হলে করোনা কে বিদায় জানানো ছাড়া বিকল্প নেই। অতএব সকলের উচিত দায়িত্বশীল আচরণ করা উচিত।