ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট ডেল্টার সংক্রমণ ঠেকাতে আজ থেকে শুরু হয়েছে সারা দেশে সর্বাত্মক লকডাউন । আজ সকাল ৬টা থেকে ৭ জুলাই মধ্যরাত পর্যন্ত বিধিনিষেধ আরোপ করে সর্বাত্মক লকডাউনের প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। গতকাল বুধবার সরকারের জারিকৃত প্রজ্ঞাপনে স্বাক্ষর করেন মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের উপ-সচিব রেজাউল ইসলাম। ২১ দফা নির্দেশনা সম্বলিত প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে ৭ দিনের এই লকডাউনে কেউ বিনা প্রয়োজনে ঘর থেকে বাইরে বের হলেই কঠোর শাস্তি দেওয়া হবে। এতে বলা হয়েছে, লকডাউন কার্যকরে অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পাশাপাশি সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হবে। বৈশ্বিক মহামারি করোনাকালীন সময়ে গত ১৬ মাসে দেশব্যাপী, অঞ্চলভিক্তিক, সীমান্ত জেলাভিক্তিক কয়েক দফায় লকডাউন এবং বিধিনিষেধ জারি করা হয়েছে। কিন্তু লকডাউন কার্যকরে এই প্রথম সেনাবাহিনী মাঠে নামানো হচ্ছে। আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদফতর (আইএসপিআর) থেকে এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে ‘করোনা ভাইরাসের বিস্তার রোধে আরোপিত বিধিনিষেধ বাস্তবায়নের জন্য ‘ইন এইড টু সিভিল পাওয়ার’ এর আওতায় ১ থেকে ৭ জুলাই সারা দেশে সশস্ত্র বাহিনী মোতায়েন থাকবে। পুলিশের পক্ষ থেকে জনগণকে অহেতুক বাইরে বের না হওয়ার পরামর্শ দিয়ে বলা হয়েছে, ঘোষণাকৃত কঠোর বিধিনিষেধ না মেনে সঙ্গত কারণ ছাড়া বের হলে ২৬৯ ধারায় মামলা হবে; এতে ৬ মাসের জেল হতে পারে। শুধু তাই নয় বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের ১০৬ জন কর্মকর্তাকে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটকে মোবাইল কোর্ট পরিচালনায় মাঠে থাকবেন।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, সারা দেশে লকডাউন চলার সময় সরকারি, আধাসরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে। ‘আর্মি ইন এইড টু সিভিল পাওয়ার’ বিধানের আওতায় মাঠ পর্যায়ের কার্যকর টহল নিশ্চিত করার জন্য সশস্ত্র বাহিনী বিভাগ প্রয়োজনীয় সংখ্যক সেনা মোতায়েন করবে। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট স্থানীয় সেনা কমান্ডারের সঙ্গে যোগাযোগ করে বিষয়টি নিশ্চিত করবেন। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট জেলা পর্যায়ে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের নিয়ে সমন্বয় সভা করে সেনাবাহিনী-বিজিবি-পুলিশ-র্যাব ও আনসার নিয়োগ এবং টহলের অধিক্ষেত্র, পদ্ধতি ও সময় নির্ধারণ করবেন। সেই সঙ্গে বিশেষ কোনও কার্যক্রমের প্রয়োজন হলে সে বিষয়ে পদক্ষেপ নেবেন। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়/বিভাগগুলো এই বিষয়ে মাঠ পর্যায়ে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রদান করবে।
নতুন এই নির্দেশনা অনুযায়ী সকল সরকারি, আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও বেসরকারি অফিস বন্ধ থাকবে। সড়ক, রেল ও নৌপথে গণপরিবহন (অভ্যন্তরীণ বিমানসহ) সব যন্ত্র চালিত যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকবে। তবে অ্যাম্বুলেন্স ও চিকিৎসা সংক্রান্ত কাজের জন্য শুধু যানবাহন চলাচল করতে পারবে। গণমাধ্যম (প্রিন্ট মিডিয়া ও টেলিভিশন, অনলাইন) এই বিধিনিষেধের আওতামুক্ত থাকবে বলেও প্রজ্ঞাপনে জানানো হয়।
২০২০ সালে বৈশ্বিক মহামারি করোনার পাদুর্ভাবের পর ওই বছরের এপ্রিল মাসে প্রথম রাজধানীর টোলারবাগ এলাকায় লকডাউন দেয়া হয়। অতপর ২৯ এপ্রিল রাজধানীর ১০ এলাকাসহ দেশের ৫২টি এলাকায় লকডাউন দেয়া হয়। অতপর দেশব্যাপী এবং আঞ্চলিক পর্যায়ে লকডাউন দেয়া হয়েছিল। সে জন্য সরকার থেকে নানান পর্যায়ে নিম্নআয়ের মানুষ ও নিম্নমধ্যবিত্তদের আর্থিক সহায়তা দেয়া হয়। সে কারণে লকডাউন কর্মসূচি মোটামুটিভাবে পালিত হয়েছে। কিন্তু ২০২১ সালে করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে সীমান্ত জেলায় লকডাউন সহ বিভিন্ন এলাকায় এমনকি রাজধানী ঢাকায় বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়। কিন্তু কোনোটিই সফলভাবে পালিত হয়নি। সরকারের দ্বিমুখীনীতি তথা কোনো প্রতিষ্ঠান বন্ধ, আবার কোনোটি খোলা রেখে লকডাউন দেয়ায় মানুষ সরকারের নীতিনির্ধারকদের বিরুদ্ধে বৈষম্যের অভিযোগ তোলে।
এবার গার্মেন্টস, ব্যাংক ছাড়া লকডাউনে প্রায় সবকিছুই বন্ধ রাখার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
২১ দফা নির্দেশনা : ১. সকল সরকারি, আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও বেসরকারি অফিস বন্ধ থাকবে। ২. সড়ক, রেল ও নৌপথে গণপরিবহনসহ সকল প্রকার যন্ত্রচালিত যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকবে। অভ্যন্তরীণ বিমান চলাচলও বন্ধ থাকবে। ৩. শপিংমল/মার্কেটসহ সকল দোকানপাট বন্ধ থাকবে। ৪. সকল পর্যটনকেন্দ্র, রিসোর্ট, কমিউনিটি সেন্টার ও বিনোদনকেন্দ্র বন্ধ থাকবে। ৫. জনসমাবেশ হয় এই ধরনের সামাজিক (বিবাহোত্তর অনুষ্ঠান, জন্মদিন, পিকনিক পার্টি ইত্যাদি ) রাজনৈতিক ও ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান বন্ধ থাকবে।
৬. বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট আদালতগুলোর বিষয়ে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা জারি করবে। ৭. ব্যাংকিং সেবা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রয়োজনীয় নির্দেশনা জারি করবে। (বাংলাদেশ ব্যাংক প্রজ্ঞাপনে বলেছে, ১ জুলাই সকাল ৬টা থেকে ৭ জুলাই সীমিত পরিসরে খোলা থাকবে ব্যাংক। তবে শুক্র ও শনিবার সপ্তাহিক বন্ধের সঙ্গে রোববারও ব্যাংক বন্ধ থাকবে। অন্য চারদিন সকাল ১০টা থেকে দুপুর ১.৩০টা পর্যন্ত ব্যাংকে লেনদেন চলবে। তবে লেনদেন-পরবর্তী আনুষঙ্গিক কার্যক্রম শেষ করার জন্য ব্যাংক খোলা থাকবে বিকাল ৩টা পর্যন্ত)। ৮. আইনশৃৃঙ্খলা এবং জরুরি পরিষেবা, যেমন কৃষি পণ্য ও উপকরণ (সার, বীজ, কীটনাশক, কৃষি যন্ত্রপাতি ইত্যাদি ) খাদ্যশস্য ও খাদ্যদ্রব্য পরিবহন, ত্রাণ বিতরণ, স্বাস্থ্যসেবা, কোভিড-১৯ টিকা প্রদান, রাজস্ব আদায় সম্পর্কিত কার্যাবলী, বিদ্যুৎ, পানি, গ্যাস/জ্বালানি, ফায়ার সার্ভিস, টেলিফোন ও ইন্টারনেট (সরকারি-বেসরকারি), গণমাধ্যম (প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া), বেসরকারি নিরাপত্তা ব্যবস্থা, ডাকসেবা, ব্যাংক, ফার্মেসি ও ফার্মাসিউটিক্যালসসহ অন্যান্য জরুরি/অত্যাবশ্যকীয় পণ্য ও সেবার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অফিসের কর্মচারী ও যানবাহন প্রাতিষ্ঠানিক পরিচয়পত্র প্রদান সাপেক্ষে যাতায়াত করতে পারবে। ৯. পণ্য পরিবহনে নিয়োজিত ট্রাক-কাভার্ডভ্যান, কার্গো ভেসেল এ নিষেধাজ্ঞার আওতাবহির্ভূত থাকবে। ১০. বন্দরগুলো (বিমান, সমুদ্র ও স্থল) এবং এ সংশ্লিষ্ট অফিস এই নিষেধাজ্ঞার আওতাবহির্ভূত থাকবে।
১১. শিল্প-কারখানাগুলো স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণপূর্বক নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় চালু থাকবে। ১২. কাঁচাবাজার এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত উন্মুক্ত স্থানে স্বাস্থ্যবিধি মেনে ক্রয়-বিক্রয় করা যাবে। সংশ্লিষ্ট বাণিজ্য সংগঠন/বাজার কর্তৃপক্ষ ও স্থানীয় প্রশাসন বিষয়টি নিশ্চিত করবে। ১৩. অতি জরুরি প্রয়োজন ছাড়া (ওষুধ ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি ক্রয়, চিকিৎসাসেবা, মৃতদেহ দাফন/সৎকার ইত্যাদি ) কোনোভাবেই বাড়ির বাইরে বের হওয়া যাবে না। নির্দেশনা অমান্যকারীর বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। ১৪. টিকা কার্ড প্রদর্শন সাপেক্ষে টিকা গ্রহণের জন্য যাতায়াত করা যাবে। ১৫. খাবারের দোকান, হোটেল সকাল ৮টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত খাবার বিক্রয় (অনলাইন/টেকওয়ে) করতে পারবে।
১৬. আন্তর্জাতিক ফ্লাইট চালু থাকবে এবং বিদেশগামী যাত্রীরা তাদের আন্তর্জাতিক ভ্রমণের টিকিট প্রদর্শন করে গাড়ি ব্যবহারপূর্বক যাতায়াত করতে পারবে। ১৭. স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করে মসজিদে নামাজের বিষয়ে ধর্মবিষয়ক মন্ত্রণালয় নির্দেশনা প্রদান করবে (ধর্ম মন্ত্রণালয় প্রজ্ঞাপনে মসজিদের ইমাম, মেয়াজ্জেম ও মুসল্লিদের স্বাস্থ্যবিধি মানার ৯ দফা নির্দেশনা দিয়েছে)। ১৮. ‘আর্মি ইন এইড টু সিভিল পাওয়ার’ বিধানের আওতায় মাঠ পর্যায়ে কার্যকর টহল নিশ্চিত করার জন্য সশস্ত্র বাহিনী বিভাগ প্রয়োজনীয় সংখ্যক সেনা মোতায়েন করবে। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট স্থানীয় সেনা কমান্ডারের সঙ্গে যোগাযোগ করে বিষয়টি নিশ্চিত করবেন। ১৯. ম্যাজিস্ট্রেট জেলা পর্যায়ে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের নিয়ে সমন্বয় সভা করে সেনাবাহিনী, বিজিবি, পুলিশ, র্যাব ও আনসার নিয়োগ এবং টহলের অধিক্ষেত্র, পদ্ধতি ও সময় নির্ধারণ করবেন। পাশাপাশি স্থানীয়ভাবে বিশেষ কোনো কার্যক্রমের প্রয়োজন হলে সে বিষয়ে পদক্ষেপ নেবেন। ২০. জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় মাঠ পর্যায়ে প্রয়োজনীয় সংখ্যক নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগের বিষয়টি নিশ্চিত করবে। ২১. স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক তার পক্ষে জেলা প্রশাসন ও পুলিশ বাহিনীকে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের প্রয়োজনীয় ক্ষমতা প্রদান করবেন।
এদিকে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার মোহা. শফিকুল ইসলাম বলেছেন, করোনা ভাইরাসের পরিস্থিতি বিবেচনায় সরকারের ঘোষণাকৃত কঠোর বিধিনিষেধ না মানলে ২৬৯ ধারায় মামলা হতে পারে। বাইরে বের হওয়ার সঙ্গত কারণ না দেখাতে পারলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ২৬৯ ধারায় মামলায় ৬ মাসের জেল ও জরিমানা হতে পারে। রাজধানীর মিন্টো রোডের ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি আরো বলেন, পুলিশ রাস্তায় থাকবে। কোনো যানবাহন বের হলে দণ্ডবিধির ২৬৯ ধারায় মামলা করা হবে। সঙ্গত কারণ দেখাতে না পারলে তাকে গ্রেফতার করে আদালতে তোলা হবে। এর পাশাপাশি ভ্রাম্যমাণ আদালতেও সাজা দেয়া হবে। এবার পুলিশ শক্ত অবস্থানে থাকবে। পুলিশ শক্ত অবস্থানে থাকবে বলেই আপনারা নিরাপদে থাকবেন।
করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ রোধে সরকারের বিধিনিষেধের মধ্যে মোবাইল কোর্ট পরিচালনার জন্য বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের ১০৬ জন কর্মকর্তাকে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ দিয়েছে সরকার।
গতকাল বুধবার জন প্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে দ্য কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউর, ১৮৯৮ এর ১০(৫) ধারা অনুযায়ী এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেটের ক্ষমতা দিয়ে মোবাইল কোর্ট আইন, ২০০৯ এর ৫ ধারা মোতাবেক বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ের আওতাধীন মোবাইল কোর্ট পরিচালনার নির্দেশনা আদেশ জারি করা হয়েছে। এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেটদের সংশ্লিষ্ট বিভাগীয় কমিশনারের নির্দেশনা অনুযায়ী দায়িত্ব পালনের নির্দেশনা দেওয়া হয়।
এতে বলা হয়, জেলা ম্যাজিস্ট্রেট জেলা পর্যায়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের নিয়ে সমন্বয় সভা করে সেনাবাহিনী, বিজিবি, পুলিশ, র্যাব ও আনসার নিয়োগ ও টহলের অধিক্ষেত্র, পদ্ধতি সময় নির্ধারণ করবেন। সেই সঙ্গে স্থানীয়ভাবে বিশেষ কোনো কার্যক্রমের প্রয়োজন হলে সে বিষয়ে পদক্ষেপ নেবেন। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়/বিভাগসমূহ এ বিষয়ে মাঠ পর্যায়ে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেবে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় মাঠ পর্যায়ে প্রয়োজনীয় সংখ্যক নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগের বিষয়টি নিশ্চিত করবে বলে প্রজ্ঞাপনে বলা হয়।