বিভিন্ন দেশে লেখাপড়া করতে গিয়ে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের কেউ কেউ মাদকাসক্ত হচ্ছে। তারা নিত্যনতুন সব মাদকের সঙ্গে জড়াচ্ছে। পরে এসব শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন কৌশলে ভয়ঙ্কর সব মাদক দেশে এনে তাদের সহপাঠী, বন্ধুবান্ধব ও আত্মীয়স্বজনদের মধ্যে ছড়িয়ে দিচ্ছে। চাহিদা থাকায় বিভিন্ন মাধ্যমে দেশে এনে অনেকে ব্যবসাও করছে। ব্যয়বহুল এসব মাদক সেবন করে আসক্ত হয়ে পড়ছে সমাজের এক শ্রেণির যুবক ও তরুণরা।
ক্ষতিকারক এসব মাদকের নেতিবাচক প্রভাবে সেবনকারীরা বেপরোয়া আচরণ করছে। ঘটাচ্ছে নানা অঘটন। সম্প্রতি দেশে পুলিশ ও ডিবির অভিযানে ডি-লাইসার্জিক এসিড ডায়েথিলামাইড বা এলএসডি এবং ডাইমিথাইল ট্রিপটামাইলের (ডিএমটি) চালান আটকের পর গোয়েন্দারা এসব তথ্য জানতে পেয়েছেন।
গোয়েন্দারা অনুসন্ধানে জানতে পেরেছেন, দেশে সম্পূর্ণ নতুন, ব্যয়বহুল ও ভয়ঙ্কর চারটি মাদকের অস্তিত্ব রয়েছে। এসবের মধ্যে এলএসডি, ডিএমটি, ম্যাজিক মাশরুম এবং এমডিএমএ নামের মাদক রয়েছে। এই চারটি মাদকই অন্যান্য মাদকের চেয়ে ব্যয়বহুল। মূলত উন্নত দেশগুলোতে এসব মাদকের ব্যবহার রয়েছে। ক্ষতিকারক ও নেতিবাচক প্রভাব থাকায় কিছু দেশে এসব মাদককে নিষিদ্ধও করা হয়েছে। কিছুদিন আগেও বাংলাদেশ এসব মাদকের সঙ্গে পরিচিত ছিল না। তবে বিদেশে পড়তে গিয়ে কিছু শিক্ষার্থী নিজেরা এসব মাদকের কবলে পড়ে আসক্ত হয়েছে। পরে তারা দেশে আসার সময় সঙ্গে করে এনেছে। এখন কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে এনে নিজেরাও সেবন করছে, পাশাপাশি বিক্রি করছে।
দেশে নতুন কিসিমের এসব মাদক নিয়ে কাজ করছেন এমন কর্মকর্তারা বলেছেন, এখন পর্যন্ত যে কয়টি নতুন মাদকের অস্তিত্ব দেশে পাওয়া গেছে তার প্রত্যকটির প্রভাব ভয়ঙ্কর। এলএসডি হলো এক ধরনের সিনথেটিক ড্রাগ। অর্থাৎ মানুষের তৈরি রাসায়নিক দিয়ে এটা তৈরি করা হয়। শস্যদানার ওপর জন্মানো বিশেষ ধরনের ছত্রাক থেকে উৎপাদিত লাইসার্জিক অ্যাসিড থেকে রাসায়নিক সংশ্লেষের মাধ্যমে এলএসডি তৈরি করা হয়।
সাধারণভাবে এলএসডি হয় বর্ণ ও গন্ধহীন। ব্লটার কাগজ, চিনির কিউব বা জেলটিনের আকারে এ মাদক বিক্রি করা হয়। এ মাদক মস্তিষ্কের ক্রিয়ার ওপর বড়ধরনের প্রভাব ফেলে, তাতে উদ্বেগ প্যারানয়া কিংবা বিভ্রম ঘটার মতো পরিস্থিতি দেখা দিতে পারে। সাইলোসাইবিন মাশরুম এক ধরনের অপ্রচলিত ছত্রাক। তবে ভ্রম বা মায়া উৎপাদনকারী ভেষজ হিসেবে এর ব্যবহার প্রায় ৬ হাজার বছরের পুরোনো। সারা বিশ্বের মাদক রাজ্য এটি ম্যাজিক মাশরুম বা জাদুকরি ছত্রাক হিসেবে পরিচিত।
এটি সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ও বিপজ্জনক মাদক। ম্যাজিক মাশরুমের পাশাপাশি এমডিএমএ নামে দেশে আরেকটি মাদকের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। এমডিএমএ হলো- ৪ মেথাইলিন ডাইঅক্সি মেথা এমফিটামিন। কোকেন সেবনের মতো এটি শরীরে প্রভাব ফেলে। এছাড়া ডিএমটি নামক মাদকও ভয়ঙ্কর। এলএসডি সেবনের মতো ধোঁয়ার মাধ্যমে শ্বাস নিয়ে বা ইনঞ্জেকশনের মাধ্যমে এটি শরীরে নেয়া যায়। সেবনের ৩০ থেকে ৪০ মিনিটের ভেতরে গভীর আসক্তি তৈরি হয়।
সেবনকারীদের মধ্যে দ্রুত হ্যালুসিনেশন হয় এবং তারা কল্পনার জগতে প্রবেশ করে। যা থেকে মারাত্মক দুর্ঘটনা এমনকি জীবননাশের ঘটনা ঘটতে পারে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে, এলএসডির ভয়াবহতা বিবেচনায় ১৯৯০ সালে বাংলাদেশের মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনেও এটাকে নিষিদ্ধ মাদকের তালিকায় রাখা হয়। নিষিদ্ধ ঘোষণার প্রায় ২৯ বছর পর দেশে প্রথমবারের মতো এলএসডির একটি চালান জব্দ করে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর। ২০১৯ সালের ১৫ই জুলাই রাজধানীর মহাখালীর ডিওএইচএসের একটি বাড়ি থেকে এলএসডির ২৫টি স্ট্রিপ (ব্লট) এবং ৫ মিলিলিটার তরল এলএসডি উদ্ধার করেন অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা।ওই ঘটনায় কাফরুল থানায় একটি মামলা করেন অধিদপ্তরের তখনকার সুপার ফজলুল হক খান। সেই মামলার দুই আসামি ইয়াসের রিদওয়ান আনান (২১) এবং সৈয়দ আহনাফ আতিফ মাহমুদ (২১) এখন জামিনে রয়েছেন। অভিযোগপত্র দেয়ার পর মামলাটি এখন বিচারাধীন। ইয়াসের রিদওয়ান কানাডার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তেন। সেখান থেকে তিনি তেলের বোতলে ভরে তরল এলএসডি এবং ডাকটিকিটের মতো দেখতে এলএসডি স্ট্রিপ নিয়ে আসেন।
এই ঘটনাটি তদন্ত করতে গিয়ে অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা আরও কয়েকটি চক্রের সন্ধান পান। চক্রগুলোতে নারীরাও জড়িত ছিলেন। তবে ইয়াসের রিদওয়ান গ্রেপ্তার হওয়ার পর তারা গা-ঢাকা দেয়। সেসব চক্রে নারীরাও যুক্ত ছিলেন। গ্রেপ্তার হওয়া ওই শিক্ষার্থী তখন জানিয়েছিল, কানাডায় লেখাপড়া করে এরকম আরেক শিক্ষার্থীও দেশে এলএসডির চালান নিয়ে এসেছিল। সূত্রগুলো জানায়, ওই শিক্ষার্থীরা বিদেশে গিয়েই ভিন্ন কিসিমের মাদকের সঙ্গে জড়িয়েছিল।
পরে তারা দেশে আসার সময় পরীক্ষামূলকভাবে এলএসডি নিয়ে আসে। অভিজাত এলাকার বিভিন্ন পার্টিতে অংশগ্রহণ করা তরুণ ও যুবকদের মাঝে তারা এটি ছড়িয়ে দেয়। এতে করে খুব দ্রুত মাদকটির চাহিদা বাড়তে থাকে। এসব তরুণদের অনেকেই দেশের বাইরে লেখাপড়া করতো।
এদিকে গত শনিবার র্যাবের অভিযানে যে চারজনকে আটক করা হয়েছে তাদের মধ্যে দুজন বিদেশে লেখাপড়া করছে। এরমধ্যে একজন হলো- সৈয়দ মঈন উদ্দিন আহমেদ শাদাব (২৯)। সে ঢাকার উত্তরার একটি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল হতে ও লেভেল শেষ করার পর ভারতের দার্জিলিংয়ে ২০১৩ সালে এ লেভেলে পড়াশোনা করে।
এরপর ২০১৫ সালে বিবিএ পড়ার জন্য থাইল্যান্ডে যায়। সেখানে থাকাকালীন বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে এলএসডি ও ডিএমটিতে আসক্ত হয়। পরে বাংলাদেশে আসার পরও সে এই মাদক সেবন করে। এক সময় পোস্টাল সার্ভিসের মাধ্যমে বিদেশ থেকে এনে নিজে সেবন করতো, পাশাপাশি বিক্রিও করতো। আরেক বিদেশ ফেরত শিক্ষার্থী আব্রাহাম জোনায়েদ তাহের (২৫) আরেকটি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল থেকে ও লেভেল শেষ করে মালেশিয়া যায়। ২০১৫-১৬ সাল পর্যন্ত সে সেখানেই অবস্থান করে।
পরে উচ্চ শিক্ষার জন্য ইংল্যান্ডে চলে যায়। সেখানে গিয়েই এলএসডি ও ডিএমটির সঙ্গে পরিচিত হয়। ২০২০ সালে বাংলাদেশে আসার সময় সঙ্গে করে এলএসডি ও ডিএমটি নিয়ে আসে।
র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক খন্দকার সাইফুল আলম গতকাল বলেছেন, পৃথিবীর উন্নত দেশে যেসব মাদক পাওয়া যায় সেগুলো এখন দেশেও পাওয়া যাচ্ছে। র্যাবের অভিযানে তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল এলাকার লাভ রোড থেকে চারজন শিক্ষার্থীকে আটকের পর ভয়ঙ্কর মাদক এলএসডি পাওয়া যায়।
এ সময় তাদের কাছে ডিএমটি নামের আরেকটি মাদক পাওয়া গেছে। ডিএমটি নামক এই মাদকটি এলএসডি মতো করে মুখে দিয়ে, সিগারেট, ইনজেকশনের মাধ্যমে সেবন করা যায়। সেবনকারীদের মধ্যে অল্প সময়েই আসক্তি তৈরি হয়। তারা কল্পনার জগতে প্রবেশ করে। এতে করে দুর্ঘটনা বা জীবননাশও হতে পারে। তিনি বলেন, থাইল্যান্ড ও ইংল্যান্ডে থেকে আসা দুজন শিক্ষার্থী লেখাপড়া করতে গিয়ে এতে আসক্ত হয়। পরে তারা এগুলো দেশে নিয়ে এসে ছড়িয়ে দেয়। তাদের সঙ্গে আরও কিছু গ্রুপ রয়েছে। আমরা তাদেরকে ধরার চেষ্টা করছি।
ডিএমটি এখনো একটি মহলে সীমাবদ্ধ আছে। তবে ছড়িয়ে পড়ার শঙ্কা রয়েছে। অভিভাকদের উদ্দেশ্য তিনি বলেন, লেখাপড়ার জন্য বিদেশে গিয়ে সন্তানরা কি করছে, কাদের সঙ্গে চলাফেরা করছে এসব বিষয়ে সচেতন হতে হবে। কারণ আমাদের তদন্তে বের হয়েছে যারা বিদেশে লেখাপড়া করতে যাচ্ছে তারা উচ্চমূল্যের ভয়ঙ্কর এসব মাদকে জড়িয়ে যাচ্ছে। পরে সে মাদক দেশে নিয়ে আসছে।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের গোয়েন্দা শাখার পরিচালক কুসুম দেওয়ান বলেন, বিমানবন্দরগুলোতে মাদক শনাক্তের মেশিন না থাকার কারণে অনেক নতুন কিসিমের মাদক যাত্রীরা বহন করতে পারছে। তাই বিমানবন্দরগুলোতে আধুনিক ডিটেকটর বসানোসহ মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের সংযুক্ত করতে হবে। কিছু আন্তর্জাতিক কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে অনেকে মাদক আনছে। এসব কুরিয়ার সার্ভিসকে নজরদারি করা হচ্ছে। বেশ কয়েকটি চালানও ধরা হয়েছে।