মহামারির মধ্যে বাংলাদেশের অর্থনীতি দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে ভালো অবস্থানে আছে বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা । প্রধানমন্ত্রী বলেন, করোনা ভাইরাস আমাদের যথেষ্ট কষ্ট দিচ্ছে সারা বিশ্বব্যাপী, এটা একটা বিরাট সমস্যা। তারপরও আমরা আমাদের অর্থনীতির গতিটা সব সময় ঠিক রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছি। যদিও করোনায় অনেক ক্ষতি হচ্ছে, তারপরও হয়তো যে লক্ষ্যটা ছিল সেটা হয়তো পূরণ করতে পারিনি। কিন্তু তারপরও আমি বলতো এই দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশই সবচেয়ে ভালো স্থানে আছে এবং থাকবে। সেটা হলো বড় কথা।
গতকাল গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সে আওয়ামী লীগের ৭২তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত আলোচনা সভায় একথা জানান তিনি। বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আওয়ামী লীগের আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়।
আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা বলেন, রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে চিন্তা করলে বাংলাদেশে একটি মাত্র মূল দল রয়েছে। সেটি হচ্ছে আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগের লক্ষ্যই হলো দেশকে জাতির পিতার স্বপ্নের ‘সোনার বাংলাদেশ’ এবং বাঙালিদের বিশ্বের বুকে একটি আত্মমর্যাদাশীল জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা। আমার দৃঢ় বিশ্বাস দলের মধ্যে শক্তিশালী সাংগঠনিক কাঠামো ও গণতন্ত্রের চর্চা অটুট থাকলে কেউ আমাদের দাবায়ে রাখতে পারবে না।
শেখ হাসিনা বলেন, রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে চিন্তা করলে, এদেশে কতগুলো দল আছে? তৃণমুলের মানুষকে নিয়েই আওয়ামী লীগ। কমিউনিস্ট পার্টিসহ আরও কয়েকটি দল আছে। কিন্তু মূল একটা দলই, সেটা আওয়ামী লীগ। বিএনপিবা জাতীয় পার্টি তো জনগণ থেকে উঠে আসেনি। ক্ষমতা দখলকারীর হাতে সৃষ্টি করা দল। সমালোচকদের এটা মনে রাখা উচিত। শেখহাসিনা বলেন, আইয়ুব খান যেভাবে ক্ষমতা দখল করেন, জিয়াউর রহমানও একইভাবে ক্ষমতায় আসেন। মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় সংগ্রাম ও রক্ত দিয়েছে একমাত্র আওয়ামী লীগ। তারা রক্ত দিয়েছে বলেই আজ গততন্ত্র ফিরে এসেছে।
আওয়ামী লীগ যখনই ক্ষমতায় এসেছে মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন করেছে। সত্যিকার গণমানুষের দল একমাত্র আওয়ামী লীগ। অনেকে অনেক কিছু বলেন। কিন্তু এটা কখনোই উপলব্ধি করেন না। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে যা করে, জনকল্যাণে করে। একটি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য আছে। উন্নয়নের বিষয়ে শেখ হাসিনা বলেন, আমাদের উন্নয়ন কোনো ম্যাজিক না, এটা আমাদের পরিকল্পনা, এটা আমাদের একটা দর্শন, একটা আদর্শ। গ্রামের মানুষকে সবার আগে গুরুত্ব দিয়েছি, যেটা জাতির পিতা চেয়েছিলেন- যে গ্রাম থেকে উন্নয়ন করা, গ্রামের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন করা। গ্রামের মানুষের সুখ-দুঃখের সাথী হয়ে তাদের দুঃখ দূর করা। আমরা ঠিক সেভাবে পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছি বলেই কিন্তু আজ আমরা ধীরে ধীরে অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী হচ্ছি, এগিয়ে যেতে পারছি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, এদেশের মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে রাজপথে রক্ত দিয়েছেন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। আওয়ামী লীগ দেশের গণমানুষের সংগঠন। অধিকারহারা মানুষের সেই বঞ্চনা ও শোষণ আওয়ামী লীগ দেখেছে। তাই মানুষের দুঃখকষ্ট ও যন্ত্রণা উপলব্ধি করেন দলের নেতাকর্মীরা। তিনি বলেন, সত্যিকারের গণমানুষের দল হিসেবে যদি বাংলাদেশের জন্য কেউ থেকে থাকে সেটা হচ্ছে একমাত্র আওয়ামী লীগ। আপনার অনেকে অনেক কিছু বলেন, কিন্তু আপনারা এই জিনিসটা কখনো কেউ উপলব্ধি করেন না।
বলেন, ১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ বিজয় লাভ করে পুনরায় সরকার গঠন করে। জাতির পিতার আহ্বানে জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং বন্ধু দেশসমূহ দ্রুত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান করে। অতি অল্পদিনের মধ্যেই বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশ মাথা উঁচু করে দাঁড়ায় এবং মাত্র সাড়ে তিন বছরেই স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। তিনি বলেন, ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট স্বাধীনতা বিরোধী ও যুদ্ধাপরাধী চক্র আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করার উদ্দেশ্যে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করে ’৭১-এর পরাজয়ের প্রতিশোধ গ্রহণ করে। বিদেশে থাকায় আমি এবং আমার বোন শেখ রেহানা প্রাণে বেঁচে যাই। ২৬ সেপ্টেম্বর দায়মুক্তি অধ্যাদেশ জারি করে এই হত্যাকান্ডের বিচারের পথ রুদ্ধ করে। ৩ নভেম্বর কারাগারে জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করে। মোস্তাক-জিয়া চক্র খুনিদের বাংলাদেশ দূতাবাসগুলোতে চাকরি দিয়ে পুরস্কৃত করে ও রাজনৈতিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করে। তারা মার্শাল ল’ জারির মাধ্যমে গণতন্ত্রকে হত্যা করে পাকিস্তানি কায়দায় দেশ শাসন করতে থাকে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে বিকৃত করে। সংবিধানকে ক্ষত-বিক্ষত করে। শেখ হাসিনা বলেন, বিদেশে থাকা অবস্থায় ’৮১ সালের ১৩-১৫ ফেব্রুয়ারি সম্মেলনে তাকে আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। প্রায় ৬ বছর রিফিউজি জীবন শেষে ’৮১ সালের ১৭ মে তিনি দেশে ফিরে এসে দলের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন, সারা দেশে প্রান্তিক মানুষের দুঃখ-দুর্দশা চিত্র স্বচক্ষে অবলোকন করেন এবং আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে স্বৈরাচারী সরকারের বিরুদ্ধে জনমত গঠন ও গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলন সংগঠিত করেন। এরআগে বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয় প্রান্তে সূচনা বক্তব্য রাখেন দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের । আলোচনায় অংশ নেন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য বেগম মতিয়া চৌধুরী, ড. আব্দুর রাজ্জাক, অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর কবির নানক, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ, নির্বাহী সদস্য মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া প্রমুখ।
রোহিঙ্গাদের অনির্দিষ্টকালের জন্য আশ্রয় দেয়া সম্ভব নয় :
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থীকে মর্যাদার সাথে ও শান্তিপূর্ণভাবে তাদের নিজে দেশে প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করতে সহায়তার জন্য বিশ্ব সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। গতকাল আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা সংক্রান্ত নবম মস্কো সম্মেলনে বক্তব্য প্রদানকালে এ আহ্বান জানান।
তিনি রোহিঙ্গা সংকটের বিষয়টি পুনরুল্লেখ করে বলেন, আপনারা নিশ্চয়ই অবগত আছেন যে, প্রায় চার বছর আগে মিয়ানমারের ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা নাগরিককে জোরপূর্বক বাস্তু্যুচ্যূত করা হলে, বাংলাদেশ এদের আশ্রয় দেয়। এরা বাংলাদেশ ও গোটা অঞ্চলের জন্য মারাত্মক নিরাপত্তা ঝুঁকি সৃষ্টি করছে। আমরা মানবিক কারণে তাদের আশ্রয় দিয়েছি। কিন্তু এই বিপুল সংখ্যক জনগোষ্ঠীকে অনির্দিষ্টকালের জন্য আশ্রয় দেয়া আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়।
প্রধানমন্ত্রীর রেকর্ড করা এই বক্তৃতা তিন দিনব্যাপী আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা সংক্রান্ত নবম মস্কো সম্মেলনে সম্প্রচার করা হয়। ভার্চুয়াল প্লাটফরমে ২১ জুন থেকে এই আন্তর্জাতিক সম্মেলন শুরু হয়। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তার বক্তৃতায় রোহিঙ্গাদের মর্যাদার সাথে শান্তিপূর্ণভাবে প্রত্যাবাসনে সহায়তার জন্য আবারও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানান।
তিনি আরো বলেন, আমরা যতক্ষণ পর্যন্ত মানুষকে বঞ্চনা ও শোষণ থেকে মুক্তি এবং সকলের জন্য শিক্ষা ও মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করার জন্য যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ না করব, ততক্ষণ পর্যন্ত শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়।
এই সম্মেলন আয়োজন করার জন্য প্রধাননমন্ত্রী রুশ ফেডারেশন সরকারকে ধন্যবাদ জানান এবং আশা করেন যে, এই সম্মেলন জরুরি বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক নিরাপত্তা ইস্যুগুলো নিয়ে কাজ করবে।শেখ হাসিনা কোভিড-১৯ মোকাবেলায় সবার জন্য ভ্যাকসিন নিশ্চিত, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে মানবিক সাহায্য প্রদান, রোহিঙ্গাদের নিজ ভূমিতে নিরাপদে প্রত্যাবাসন, সন্ত্রাসীদের অর্থায়ন ও অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ ও বৈশ্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিতে সেনা সংস্থাগুলোর মধ্যে সহযোগিতা বৃদ্ধি করার উপর জোর দেন।
এ প্রসঙ্গে, তিনি বলেন, আমি ইসরাইল ও ফিলিস্তিনের মধ্যকার সাম্প্রতিক অস্ত্রবিরতিকে স্বাগত জানাই। আমি আশা করি যে, মধ্যপ্রাচ্য এবং বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলেও শান্তি ও স্থিতিশীলতা বিরাজ করবে।
দেশে দেশে সংঘাত আন্তঃদেশীয় নিরাপত্তা সমস্যা বাড়িয়ে দিচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, নিরাপত্তা সংজ্ঞায় এখন মানুষের সামরিক ঝুঁকি, আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রয়োজন, অ-স্বেচ্ছাপ্রণদিত গণ অভিযোজন, পরিবেশগত নিরাপত্তা ও অন্যান্য নতুন নতুন নিরাপত্তা ঝুঁকিও অন্তর্ভূক্ত।
সন্ত্রাস ও চরমপন্থার বিরুদ্ধে বাংলাদেশের ‘জিরো টলারেন্স’ এর কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, সন্ত্রাসবাদ, চরমপন্থা, বিচ্ছিন্নতাবাদ, গণ-বিধ্বংসী অস্ত্র, সাইবার অপরাধ, আঞ্চলিক সংঘাত ও প্রতিবেশগত বিপর্যয়ের কারণেই আন্তর্জাতিক নিরাপত্তার নতুন চ্যালেঞ্জ ও ইস্যুগুলো আবির্ভূত হয়েছে।
কোভিড-১৯ মহামারিকে বর্তমান সময়ে অন্যতম বৈশ্বিক ইস্যু উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এই মহামারির কারণে শুধু বহু মানুষই মারা যায়নি, অধিকন্তু অর্থনীতির উপরও এর বিরূপ প্রভাব পড়েছে এবং বিশ্বব্যাপী লাখ লাখ মানুষ জীবিকা হারিয়েছে।
শেখ হাসিনা বলেন, তাঁর সরকার সকলের জন্য স্বাস্থ্য-সেবা নিশ্চিত ও বিভিন্ন খাতে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে মহামারি মোকাবেলা করে পরিস্থিতির সাথে খাপ খাইয়ে নিয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী আরো বলেন, বাংলাদেশ প্রতিটি নাগরিককে বিনামূল্যে কোভিড-১৯ ভ্যাকসিনের আওতায় নিয়ে আসবে। তাই সরকার সম্ভাব্য সকল উৎস থেকে ভ্যাকসিন সংগ্রহের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তিনি বলেন, আমাদের সরকার এই ভ্যাকসিনের জন্য রুশ কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে চলছে। আমি জানাতে চাই যে- বাংলাদেশের ভ্যাকসিন তৈরির সক্ষমতা রয়েছে এবং যদি উৎপাদনে যেতে পারি, তবে বিশ্ব সম্প্রদায়কে সহায়তা করতে পারব।
প্রধানমন্ত্রী আরো বলেন, একটি গণতান্ত্রিক ও শান্তিপ্রিয় দেশ হিসেবে বাংলাদেশ শান্তিপূর্ণ উপায়ে সব ধরনের আন্তর্জাতিক বিবাদ মিমাংসায় বিশ্বাস করে। কারণ, যুদ্ধ-সংঘাতে প্রিয়জন হারানোর বেদনা বাংলাদেশ বোঝে। ১৯৭১ সালের দেশটির মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ লোক প্রাণ হারিয়েছে।
তিনি আরো বলেন, জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনীতে তাঁর দেশের সর্বাধিক সদস্য রয়েছে। এভাবে বাংলাদেশ বিশ্বে শান্তি বজায় রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে এবং স্বাধীনতার পরপর যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটি পুর্নগঠনে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন ও দেশটির জনগণের সাহায্য ও সহযোগিতার কথা গভীর কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করেন।