বিধি-নিষেধেই বাজিমাত লেনদেন আর মাত্র ১০ কোটি টাকা বেশি হলেই হবে রেকর্ড টানা এক বছর ভালো অবস্থানে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থার নানামুখী পদক্ষেপে ঘুরে দাঁড়িয়েছে শেয়ারবাজার।
করোনা ইস্যুতে দেশে টানা বিধি-নিষেধ চলছে। তবে বিধি-নিষেধের মধ্যে চলছে পুঁজিবাজারের লেনদেন। শুধু তাই নয়, এই বিধি-নিষেধের মধ্যেই বাজিমাত করছে দেশের পুঁজিবাজার। সর্বকালের সেরা লেনদেন করে ইতিহাস গড়ার পথে পুঁজিবাজার। কেননা লেনদেন আর মাত্র সাড়ে ১০ কোটি টাকা বেশি হলেই হবে সেই রেকর্ড।সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের পুঁজিবাজার গত সাড়ে ১০ বছরের মধ্যে সব থেকে ভালো সময় পার করেছ। বিধি-নিষেধের মধ্যেই বাজিমাত করছে। যতোদিন যাচ্ছে ততোই লেনদেন বৃদ্ধি পাচ্ছে, বাজারও চাঙ্গা হচ্ছে।
২০১০ সালের ডিসেম্বরে ব্যাপক ধস নামে শেয়ারবাজারে। সূচক কমার পাশাপাশি লেনদেনের পরিমাণও কমে যায় ব্যাপকভাবে। তবে চলতি বছরে আবারো লেনদেনে ভালো গতি ফিরে এসেছে ডিএসইতে। এমনকি ইতিহাসের সর্বোচ্চ লেনদেনের কাছাকাছি চলে এসেছে।বাজার সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, শুধু বাংলাদেশ নয় করোনার মধ্যে ভারত-যুক্তরাষ্ট্রসহ অনেক দেশের শেয়ারবাজার বেশ ভালো করছে। বাংলাদেশের শেয়ারবাজারের ভালো করার বিষয়টি বিচ্ছিন্ন ঘটনা না। তবে তারা বলছেন, করোনার মধ্যে মানুষের বিকল্প বিনিয়োগের সুযোগ নেই। ব্যাংকের সুদের হার কম। আবার বাজারে স্বচ্ছতা প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি বিনিয়োগকারীদের শেয়ারবাজারে টানতে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। তার প্রতিফলনই দেখা যাচ্ছে পুঁজিবাজারে।
গতকাল বুধবার সপ্তাহের চতুর্থ কার্যদিবসে আগের সব রেকর্ড ভেঙে নতুন উচ্চতায় উঠেছে লেনদেন। এদিন ডিএসইতে লেনদেন হয়েছে দুই হাজার ৭০০ কোটি ৫৫ লাখ টাকা, যা গত সাড়ে ১০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ লেনদেন। এর আগে ২০১০ সালের ৬ ডিসেম্বর ডিএসইতে দুই হাজার ৭১১ কোটি টাকার শেয়ার লেনদেন হয়। অর্থাৎ আর মাত্র সাড়ে ১০ কোটি টাকা বেশি লেনদেন হলেই নতুন রেকর্ড সৃষ্টি হবে পুঁজিবাজারে। এর আগে চলতি সপ্তাহের প্রথম কার্যদিবসে গত রোববার দুই হাজার ৬৬৯ কোটি টাকার লেনদেন হয়। চার দিনের মধ্যে সেই লেনদেনের পরিমাণ আবার ছাড়াল ডিএসই।
তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, বাংলাদেশে প্রথম করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয় গত বছরের ৮ মার্চ। আতঙ্কে ওই দিন প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান মূল্যসূচক ৯৭ পয়েন্ট পড়ে যায়। পরের দিন ৯ মার্চ আরো বড় ধস নামে বাজারে। একদিনে ২৭৯ পয়েন্ট কমে যায় ডিএসইর প্রধান মূল্য সূচক। এ সময় লোকসানের আতঙ্কে শেয়ার বিক্রি করে দিয়ে অনেকে শেয়ারবাজার ছাড়েন। পরিস্থিতি সামাল দিতে না পারায় টানা ৬৬ দিন বন্ধ রাখা হয় পুঁজিবাজারের লেনদেন। এর মধ্যেই বিএসইসির নতুন চেয়ারম্যান হিসেবে যোগদান করেন প্রফেসর শিবলী রুবাইয়াত-উল ইসলাম। তার সঙ্গে কমিশনার হিসেবে যোগ দেন আরো তিনজন। নতুন কমিশন দায়িত্ব নেয়ার পর বাজারে লেনদেন চালু করার উদ্যোগ নেন।
ফলে টানা ৬৬ দিন বন্ধ থাকার পর ৩১ মে থেকে পুঁজিবাজারে আবার লেনদেন চালু হয়।নতুন নেতৃত্বের অধীনে বাজারে লেনদেন চালু হলেও অব্যাহত থাকে লেনদেন খরা। তবে জুলাই মাসে এসে অনিয়মকারীদের বিরুদ্ধে কড়া বার্তা দেয় নতুন কমিশন। অনিয়মে জড়িত থাকায় একাধিক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে বড় অংকের জরিমানা করা হয়। সতর্ক করা হয় সরকারি বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশকে (আইসিবি)।
একই সঙ্গে বিভিন্ন ব্রোকারেজ হাউসকে জরিমানার পাশাপাশি সতর্ক করা হয়। পরবর্তীতে আইসিবিকে পুনর্গঠনের উদ্যোগ নেয়া হয়। বাতিল করা হয় এক ডজনের বেশি দুর্বল কোম্পানির আইপিও। নিয়ন্ত্রক সংস্থার এ ধরনের একের পর এক পদক্ষেপের ফলে ঘুরে দাঁড়ায় শেয়ারবাজার। তবে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে এসে কিছুটা ছন্দপতন ঘটে। আর করোনা সংক্রমণ উদ্বেগজনক হারে বেড়ে গেলে মার্চের শেষ ও এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহ এক প্রকার ধস নামে শেয়ারবাজারে। অবশ্য করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে সরকার ৫ এপ্রিল থেকে কঠোর লকডাউন দিলে শেয়ারবাজার বেশ তেজি হয়ে উঠে। আতঙ্ক কাটিয়ে লকডাউনের মধ্যে হু হু করে বাড়ে লেনদেন, সূচক ও বাজার মূলধন। এতে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের মুখেও হাসি ফুটেছে পুরনো ক্ষতো ভুলে যাচ্ছে।এবিষয়ে ডিএসইর পরিচালক মো. শাকিল রিজভী বলেন, করোনার মধ্যে বাজার চাঙ্গা থাকা এটা ইতিবাচক। তবে বিশ্বের অনেক দেশেই করোনার মধ্যে পুঁজিবাজার ভালো অবস্থায় রয়েছে। এখন ব্যাংকের সুদের হার কম এবং বিএসইসির নতুন নেতৃত্ব বেশ কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ নিয়েছে।
এসব কারণে আমাদের বাজার করোনার মধ্যে ভালো করছে।এক বছর ধরেই শেয়ারবাজার ভালো অবস্থানে রয়েছে। এর পেছনে বেশকিছু বিষয় কাজ করেছে। করোনার কারণে মানুষের বিকল্প বিনিয়োগকারীদের সুযোগ কমে গেছে। ব্যাংকের সুদের হারও কম। আবার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি বেশকিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ নিয়েছে। যা বাজারের ওপর বিনিয়োগকারীদের আস্থা বাড়িয়েছে। এর সঙ্গে ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটে শেয়ারবাজারে কালো টাকা বিনিয়োগের সুযোগ দেওয়া হয়। এটিও শেয়ারবাজারে ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।এ বিষয়ে বিনিয়োগকারী এহতেশামুজ্জামান বলেন, ২০১০ সালের পর গত এক বছর শেয়ারবাজার সব থেকে ভালো সময় পার করেছে। এর অন্যতম একটি কারণ সুদের হার কম থাকা। ব্যাংকে টাকা রাখলে এখন খুব একটা মুনাফা পাওয়া যায় না। বরং শেয়ারবাজারে ভালো মৌলভিত্তিসম্পন্ন কোম্পানিতে বিনিয়োগ করে ব্যাংকের থেকে অনেক বেশি রিটার্ন পাওয়া যায়। আবার ঘরে বসেই মোবাইল, ই-মেইলে বিনিয়োগকারীরা শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করতে পারেন।
এসবের ইতিবাচক প্রভাব শেয়ারবাজারে দেখা যাচ্ছে। গত ২৬ কার্যদিবস টানা হাজার কোটি টাকার ওপরে লেনদেন হয়েছে ডিএসইতে। এর মধ্যে শেষ ৬ কার্যদিবস দুই হাজার কোটি টাকার ওপরে লেনদেন হয়েছে।গত বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে ২০২১-২২ অর্থবছরের জন্য ছয় লাখ তিন হাজার ৬৮১ কোটি টাকার প্রস্তাবিত বাজেট উপস্থাপন করেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। প্রস্তাবিত বাজেটে করপোরেট করহার কমানোর প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।অর্থমন্ত্রী নতুন বছরের প্রস্তাবিত বাজেট দেয়ার পর গত রোববার সাড়ে ১০ বছর পর ডিএসইতে সর্বোচ্চ লেনদেন হয়। সেই থেকে গতকাল পর্যন্ত টানা দুই হাজার কোটি টাকার উপরে লেনদেন হচ্ছে।এ পরিস্থিতিতে গতকাল লেনদেনের শুরুতেই শেয়ারবাজারে বড় অঙ্কের লেনদেনের আভাস পাওয়া যায়। মাত্র আধা ঘণ্টার লেনদেনেই ডিএসইতে সাড়ে ৫০০ কোটি টাকার লেনদেন হয়।
লেনদেনের গতি অব্যাহত থাকে শেষ পর্যন্ত। ফলে দিন শেষে ডিএসই লেনদেনের পরিমাণ দাঁড়ায় দুই হাজার ৭০০ কোটি ৫৫ লাখ টাকা, যা ২০১০ সালের ৬ ডিসেম্বরের পর সর্বোচ্চ। রেকর্ড এই লেনদেনের দিনে ডিএসইতে লেনদেনের শুরুতে প্রায় সবকটি প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিটের দাম বাড়ে। এতে প্রথম মিনিটেই ডিএসইর প্রধান সূচক ডিএসইএক্স প্রায় ৫০ পয়েন্টে বেড়ে যায়। তবে শেষদিকে এসে সূচকের ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা কিছুটা কমে।এতে দিনের লেনদেন শেষে ডিএসইর প্রধান মূল্য সূচক আগের দিনের তুলনায় ৩১ পয়েন্ট বেড়ে ছয় হাজার ৫৫ পয়েন্টে উঠে এসেছে।
অপর দুই সূচকের মধ্যে ডিএসই-৩০ সূচক ছয় পয়েন্ট বেড়ে দুই হাজার ২০২ পয়েন্টে অবস্থান করছে। ডিএসইর শরিয়াহ্ সূচক পাঁচ পয়েন্ট বেড়ে এক হাজার ২৯৬ পয়েন্টে দাঁড়িয়েছে। দিনভর বাজারটিতে লেনদেনে অংশ নেওয়া ২০৮টি প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিটের দাম বাড়ার বিপরীতে দাম কমেছে ১২৪টির। ৩৭টির দাম অপরিবর্ততি রয়েছে।এদিকে রেকর্ড লেনদেনের দিনে টাকার অঙ্কের ডিএসইতে সব থেকে বেশি লেনদেন হয়েছে বেক্সিমকোর শেয়ার।
কোম্পানিটির ১৫৫ কোটি ৪৫ লাখ টাকার শেয়ার লেনদেন হয়েছে। দ্বিতীয় স্থানে থাকা লংকাবাংলা ফাইন্যান্সের ৭৩ কোটি ৪০ লাখ টাকার লেনদেন হয়েছে। ৬৫ কোটি ৯০ লাখ টাকার লেনদেনের মাধ্যমে তৃতীয় স্থানে রয়েছে ন্যাশনাল পলিমার।অন্যদিকে দেশের অপর বাজার চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের (সিএসই) সার্বিক মূল্য সূচক বেড়েছে ৮৪ পয়েন্ট। বাজারটিতে লেনদেন হয়েছে ৭৬ কোটি ৫২ লাখ টাকা। লেনদেনে অংশ নেওয়া ৩০৯টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ১৮২টির দাম বেড়েছে। বিপরীতে ৯৬টির দাম কমেছে এবং ৩১টির দাম অপরিবর্তিত রয়েছে।