এক মাসেরও বেশি সময় বন্ধ থাকার পর শর্ত দিয়ে চালু করা হয়েছিল গণপরিবহন। অর্ধেক যাত্রীবহন, চালক-সহকারী ও যাত্রীদের বাধ্যতামূলক মাস্ক পরা এবং পরিবহন জীবাণুনাশক দিয়ে পরিষ্কার করার শর্ত দেয়া হয়েছিল সরকারের তরফে। গণপরিবহন চালুর এক মাসের মাথায় এসে দেখা যাচ্ছে নৈরাজ্যকর চিত্র। রাজধানীর বেশির ভাগ গণপরিবহনে স্বাস্থ্যবিধি মানার বালাই নেই। অর্ধেক আসন ফাঁকা রাখার কথা থাকলেও যাত্রী নেয়া হচ্ছে ইচ্ছামতো। কোনো কোনো বাসে দেখা যাচ্ছে সব আসন ভরেই যাত্রী নেয়া হচ্ছে।কিছু আসন শূন্য থাকলেও দাঁড়িয়ে যাত্রী নেয়া হচ্ছে কোনো কোনো বাসে। এ ছাড়া মাস্ক পরছেন না অনেক যাত্রী।
চালক-সহকারীরও একই অবস্থা। স্বাস্থ্যবিধি না মানলেও বাড়তি ভাড়া আদায়ে কোনো ব্যত্যয় হচ্ছে না। বরং বাড়তি যাত্রী নেয়ায় সাধারণ যাত্রীদের সঙ্গে বাসকর্মীদের বসচা হচ্ছে নিয়মিত।
এ অবস্থায় আবারো বিধিনিষেধের মেয়াদ বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছে সরকার। গত কয়েকদিন রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ও বাসস্ট্যান্ড ঘুরে এমন চিত্র দেখা গেছে। ট্রেনে আসন ফাঁকা রেখে সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী যাত্রী পরিবহন করলেও লঞ্চ এবং দূরপাল্লার বাসেও অনেক ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যবিধি মানা হচ্ছে না। শুধু গণপরিবহনই নয়, সরকারি দেয়া স্বাস্থ্যবিধির অন্যান্য নির্দেশনাও মানা হচ্ছে না খুব একটা। এ অবস্থায় নতুন করে বিধিনিষেধ কার্যকরের বিষয়েও সংশয় দেখা দিয়েছে।
গাবতলী এক্সপ্রেস পরিবহনের বাসে যাচ্ছিলেন যাত্রী শাকিল। সিট খালি না পেয়ে পাশাপাশি বসেছিলেন শাকিল ও তার বন্ধু। ফার্মগেট এলাকায় কথা হয় শাকিলের সঙ্গে। তিনি বলেন, সিট খালি না থাকায় পাশাপাশি বসেছি। পাশাপাশি সিটে বসলেও দুই বন্ধুর কাছ থেকে চার সিটের ভাড়া নিয়েছে। বাসে ওঠার সময় হ্যান্ড স্যানিটাইজার দেয়া হয়নি বলেও জানান তিনি। দেখা গেছে ওই বাসে কিছু যাত্রী দাঁড়িয়ে ছিলেন। অতিরিক্ত যাত্রী কেন নিচ্ছেন জানতে চাইলে চালকের সহকারী জানান, সামনে অনেকে নেমে যাবে। তখন সিট খালি হবে। তবে যাত্রীরা নিয়ম মানতে চায় না বলে জানান এই পরিবহন শ্রমিক।
ধানমণ্ডি এলাকায় বিআরটিসি বাসের যাত্রী আশিক জানান, মিরপুর-২ এলাকা থেকে সকালে অফিসের কাজে মতিঝিল গিয়েছিলেন। বাসের মধ্যে অতিরিক্ত বেশ কয়েকজন যাত্রী দাঁড়িয়ে ছিল। বাসটিতেও ছিল না কোনো স্যানিটাইজারেরও ব্যবস্থা। তবে এ নিয়ে কোনো প্রতিবাদ করেননি আশিক। কারণ হিসেবে জানান, সড়কে পরিবহন সংকট। বাধ্য হয়েই যাত্রীরা বাসে উঠছেন। স্বাস্থ্যবিধি না মানলেও করোনার অজুহাতে ভাড়া আদায় করা হচ্ছে দ্বিগুণ। কৌশল হিসেবে বাসের সামনে কয়েক সিটের ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যবিধি মেনে যাত্রী বসানোর কৌশলও অবলম্বন করছেন কেউ কেউ।
বাংলামোটরে লাব্বাইক বাসের যাত্রী রুমানা বেগম জানান, বাসে ওঠার সময় তাকে কোনো হ্যান্ড স্যানিটাইজার দেয়া হয়নি। সামনের দিকে দুই সিটে একজন করে যাত্রী বসালেও পেছনের দিকে দু-এক সিটে পাশাপাশি যাত্রী ছিল ওই বাসে।
নিউ ভিশন বাসের চালক রমজান জানান, অর্ধেক সিটে যাত্রী তোলার পর তারা গেট লাগিয়ে দেয়ার চেষ্টা করলেও অনেক যাত্রী জোর করে বাসে উঠে যান। সিট খালি নেই বললেও মানতে চান না। প্রজাপতি পরিবহন নামক বাসে স্যানিটাইজার থাকলেও তা ব্যবহার করতে দেখা যায়নি কাউকে। চালকের সহযোগী রাকিব জানান, স্যানিটাইজার বাসের মধ্যে রাখা আছে। যাত্রীরা অনেকে সিট খালি না থাকলেও উঠে দাঁড়িয়ে থাকে। তবে এ নিয়ে তদারকি করার কেউ নেই বলে অভিযোগ যাত্রীদের।
শাহবাগ এলাকায় বিকল্প পরিবহনের চালক আমজাদ জানান, অনেক যাত্রী আছে একসঙ্গে পাশাপাশি বসতে চায়। একই পরিবারের লোক বা বন্ধু-বান্ধব তারা। আমরা আলাদা বসতে বললে কথা কাটাকাটি করে। তাদের বললেও শুনতে চায় না। তাদের অনেকের মুখে মাস্কও থাকে না। খামারবাড়ি এলাকায় বিআরটিসি বাসের চালকের সহযোগী জুয়েল জানান, স্যানিটাইজার বাসের মধ্যে রাখা থাকলেও যাত্রীরা এখন আর ব্যবহার করতে চায় না। যাত্রীদের অনেকের মুখে মাস্কও থাকে না। স্বাধীন পরিবহন নামে একটি বাসে দেখা গেছে, যাত্রী থেকে শুরু করে বাসের চালক, সহযোগী অনেকের মুখে মাস্ক নেই। মাস্ক নেই কেন জানতে চাইলে পকেট থেকে আধ-ময়লা একটি মাস্ক বের করে পরেন চালকের সহযোগী কামাল।
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী জানান, যে উদ্দেশ্য গণপরিবহনে বাড়তি ভাড়া নেয়া হচ্ছে তার বিনিময়ে স্বাস্থ্যবিধি মেনে তারা গণপরিবহন চালাবে। অর্ধেক যাত্রী বহন করবে। সরকারের এমনই নির্দেশনা ছিল। অথচ এখন দেখা যাচ্ছে ভিন্নচিত্র। অতিরিক্ত যাত্রীর পাশাপাশি দ্বিগুণ ভাড়াও নেয়া হচ্ছে। এটা মনে করি, যাত্রী সাধারণের সঙ্গে প্রতারণা করা হচ্ছে। এই প্রতারণা নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব রাষ্ট্রের। এই ব্যাপারে সরকার যথাযথ পদক্ষেপ নিবেন।
কোথায় স্বাস্থ্যবিধি কোথায় আছে?: দেশজুড়ে বাড়ছে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে চলমান বিধিনিষেধ আগামী ১৬ই জুন পর্যন্ত বাড়িয়েছে সরকার। এনিয়ে চলতি বছরে ১০ ধাপে বাড়লো বিধিনিষেধ। তবুও মানানো যাচ্ছে না স্বাস্থ্যবিধি। নিশ্চিত হয়নি মাস্ক পরাও। ভাটা পড়েছে সামাজিক ও শারীরিক দূরত্বে।
রাজধানীর হাতিরঝিল, দিয়াবাড়ি, পূর্বাচল ৩০০ ফিট সড়ক ও পদ্মার পাড়ের মতো বিনোদন কেন্দ্রগুলোতে মানুষের ভিড় বাড়ছে। জনসমাবেশ হয় এ ধরনের সামাজিক অনুষ্ঠান বিবাহোত্তর অনুষ্ঠান, জন্মদিন, পিকনিক, পার্টি, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান বন্ধ রাখতে বলা হলেও মানছেন না অনেকেই। রাজধানীসহ সারা দেশের কমিউনিটি সেন্টারসহ বিভিন্ন স্থানে বিবাহোত্তর অনুষ্ঠান চলছে। বাসা বাড়িতে আয়োজন করা হয় জন্মদিনের পার্টিসহ নানা অনুষ্ঠান। চলে গান বাজনা, নৃত্য পরিবেশন। বিভিন্ন জেলা থেকে আসা লোকজনও এসব অনুষ্ঠানে অংশ নেন।
এদিকে খাবারের দোকান ও হোটেল-রেস্তরাঁসমূহে মানা হচ্ছে না কোনো বিধিনিষেধ। যে যেভাবে পারছেন নিজেদের ইচ্ছানুযায়ী এসব প্রতিষ্ঠান চালু রাখছেন। প্রতিদিন সকাল ৬টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত খাদ্য বিক্রয়/সরবরাহ করার জন্য নির্ধারিত সময় বেঁধে দিলেও বাস্তবে তা হচ্ছে না। রাজধানীর কাওরান বাজার, যাত্রাবাড়ীসহ বিভিন্ন এলাকায় ২৪ ঘণ্টাই খোলা থাকছে এসব হোটেল-রেস্তরাঁ। এ ছাড়া হোটেলের মোট আসনের অর্ধেক সংখ্যক ক্রেতা বসানোর কথা থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। সরজমিন দেখা যায়, প্রায় প্রতিটি হোটেল-রেস্তরাঁয় ক্রেতার উপস্থিতি বাড়ছে। প্রতিটি চেয়ারেই বসছেন গ্রাহকরা। হোটেলের প্রবেশপথে রাখা হচ্ছে না কোনো জীবাণুনাশক। ঠিকমতো পরিষ্কার করা হচ্ছে না টেবিল, চেয়ার। খাবার সরবরাহকারীদের মুখে নেই মাস্ক। খালি হাতে টেবিল পরিষ্কার করে, সেই হাতে তোয়ালে মুছে অন্যজনকে খাবার পরিবেশন করছেন।
স্বাস্থ্যবিধি ভেঙে পড়ছে মার্কেট-শপিংমলেও। এসব স্থানে বাড়ছে ক্রেতা বিক্রেতার উপস্থিতি। তবে কোথাও স্বাস্থ্যবিধির বালাই নেই। রাজধানীর অধিকাংশ শপিং সেন্টারে মানা না হচ্ছে সরকারের বিধিনিষেধ। উদাসীন ক্রেতা- বিক্রেতা ও মার্কেট কর্তৃপক্ষ। এখনো অনেক মার্কেট-শপিংমলে নেই জীবাণুনাশক টানেল। দু’একটি মার্কেটে থাকলেও ছিটানো হচ্ছে না জীবাণুনাশক তরল পদার্থ। নেই হাত ধোয়ার ব্যবস্থাও। স্বাস্থ্যবিধির অবহেলা নিয়ে অনেক মার্কেট কর্তৃপক্ষ ক্রেতাদের ওপর দোষ চাপাচ্ছেন। গতকাল সকাল থেকে মৌচাক, মালিবাগ, পান্থপথ এলাকার বেশ কয়েকটি শপিংমল ঘুরে স্বাস্থ্যবিধি মানার বিষয়ে উদাসীনতা দেখা যায়। কোথাও স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিতের কোনো মনিটরিং ব্যবস্থা চোখে পড়েনি।
জরুরি সেবায় নিয়োজিত প্রতিষ্ঠান ছাড়া সব সরকারি-বেসরকারি অফিস, প্রতিষ্ঠান, শিল্পকারখানা ৫০ শতাংশ লোকবল দিয়ে পরিচালনা করতে বলা হলেও তা মানছে না বহু প্রতিষ্ঠান। এদিকে হাট-বাজারগুলোতে মানুষের সমাগম বেড়েছে। রাজধানীর হাট-বাজারে আসা অধিকাংশ মানুষের মুখে নেই মাস্ক। মাস্ক ছাড়াই সারছেন কেনাকাটা। সরকারের নির্দেশনায় নো মাস্ক, নো সার্ভিসের কথা উল্লেখ করা হলেও তারও বাস্তবায়ন দেখা যাচ্ছে না অনেক ক্ষেত্রে।